জালাল উদ্দিন আহমেদ
জলবায়ুর কপ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৪ নভেম্বর,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০২:২৩ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
সাত'শ কোটি জন সমৃদ্ধ এই পৃথিবীটা সুন্দর করে সাজানোর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দুনিয়ার তাবড় ক্ষমতাধর ও মাথাওয়ালা ব্যক্তিরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানিনা মনুষ্য বসতির এই ভূমন্ডল এখন তার ধারন ক্ষমতার অপ্টিমামে আছে কি না? তবে জনঘনত্ব এবং তার চাহিদা ও পারিপার্শিকতার আদল দেখলে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায় যে আমাদের এই ধরাধাম সত্যিকার অর্থেই অধরা হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু থেকে শুরু করে মানব জাতির বেঁচে থাকার নিত্য চাহিদার অনুসঙ্গ সমূহের অপ্রতুলতাই বলে দেয় বসুন্ধরা এখন সত্যিকার অর্থেই অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির নিত্য নতুন ছোঁয়ায় মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে অবগাহনের সেই শাশ্বত বন্ধনটা আস্তেধীরে ম্লান হয়ে পড়ছে। প্রকৃতির বুকে জন্ম নেয়া মানুষ প্রকৃতি বর্জিত যন্ত্র দানবে পরিনত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রকৃতি গর্জে উঠছে। ফলে ঘুর্নিঝড়, তাপমাত্রার উষ্ণতা বৃদ্ধি, বন্যা ও দাবানলের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি সময়ে অসময়ে ভূভাগের এই জনপদকে নাকালে ফেলছে।
আমরা প্রকৃতি থেকে দু'হাত ভরে শুধু নিতেই শিখেছি। জানি সৃষ্টি কর্তা দুনিয়ায় যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তা মানব জাতির চাহিদা ও কল্যানের জন্যই করেছেন। দুনিয়াতে জল, স্থল, পাহাড়, জঙ্গল, সমভূমি, খনিজ - যা কিছু আছে তার প্রতিটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমরা জানি পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। সেই এক ভাগের অংশীদার আমরা পৃথিবীর সাত'শ কোটি মানব সন্তান। শুধু তাই নয়, এই ক্রমবর্ধমান বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে হাজারো প্রজাতির স্থলজ ও জলজ প্রানীকূলের বসবাস এই মানব বসতির ভূমন্ডলে। চাহিদার নিরিখে মানুষ তার জীবনের উৎকর্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্ভবতঃ প্রকৃতির সঙ্গে বিরূপ আচরনের মাত্রা বাড়িয়েছে। নইলে কেন আজকাল দুনিয়াজোড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের এত ঘন ঘন হানা! প্রকৃতিরও তো একটা টলারেন্স লিমিট আছে। এজন্য লক্ষ্য করা যায়, স্রষ্টার সৃষ্ট এই ভূভাগে যখনই কোন অস্তিত্ত্ব সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তখনই প্রকৃতির অনিয়ন্ত্রিত হানায় জনপদ তথা বিভিন্ন অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়েছে। অনেকেই এটাকে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে আখ্যায়িত করেন। তবে এটা যে ঘটছে তার সত্যতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিলানো যায়। এসব নিয়ে কথাও উঠেছে। মানুষ সতর্ক হচ্ছে। রাষ্ট্র সমূহ নিজেদের মধ্যে সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিবেশ ও পরিবেশ সজাগ করার কাজে মনোযোগী হচ্ছে। এমনকি বিশ্ব ক্লাব বলে চিহ্নিত জাতিসংঘের মাধ্যমেও পরিবেশ বিদ্ধংসী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার বিকল্প খোঁজার প্রচেষ্টা চলছে।
প্রকৃতি থেকেই পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতিগত অবস্থান থেকে সৃষ্টির প্রানীকুল তাদের জীবন ও জীবিকার স্বাচ্ছন্দময় পরিবেশ বান্ধবতা বেছে নেয়। পরিবেশের প্রতিকুলতায় মানুষ যখনই তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছে তখন প্রকৃতি তার স্বভাবসিদ্ধ আচরনে বৈরী হয়ে উঠেছে। ফলে ধ্বংসের তান্ডবলীলায় জনপদ ছিন্নভিন্ন হয়েছে। মানুষ নির্বিচারে গাছপালা বা জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলছে। এটা তাদের জ্বালানী সংকটের ব্যাপার ছিল বলেই হয়তো মানুষকে এতটা প্রকৃতি নির্ভর হতে হয়েছিল । অবশ্য শতাব্দী পূর্বে জনবসতির জ্বালানীর মূল উৎস বোধ হয় এই কাঠ,খড় খড়ির প্রাধান্যেই ছিল। তখন কিন্তু এটাই অবধারিত ছিল। কারন জনসংখ্যা ও স্থলভাগের প্রাপ্যতার অনুপাতে জনঘনত্বের চাপ তখন এতটা ছিলনা। তখন শিল্প কারখানা বা জনজীবনে কৃত্রিম জ্বালানীর উষ্ণতা সৃষ্টির ঝক্কি ঝামেলাও তৈরী হয়নি। এইতো ক'দিন আগে বিশ্বকবি বললেন,
'সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালী ক'রে মানুষ করনি'।
অথচ এই ক'টা দিনে বাঙালীর ভলিয়্যুম হয়েছে তিরিশ কোটির উপরে। পৃথিবীর বয়স যদি কয়েক হাজার বছর হয়, তবে এক'শ বছর আগে রবি ঠাকুরের এই উক্তিকে ক'দিন আগের বলাটা কি অন্যায় হবে? সেক্ষেত্রে সেদিনের তিন'শ কোটির পৃথিবী এখন সাত'শতে পৌঁছাবে তাতেই বা বিচিত্র কি! আর এর ফলে চাহিদার অতলান্তে যে রশির টান পড়বে তাতেও বিচিত্র হওয়ার কিছু নেয়। এবং সেটারই প্রতিফলন বোধ হয় ঘটছে ইদানীং। নইলে তপ্ত খরার দেশে অসময়ে বন্যা হচ্ছে। সবকিছু ভাসিয়ে নিচ্ছে। শীত প্রধান বরফের দেশে গরমের দাবদাহে বনাঞ্চলে দাবানল হয়ে জনপদে অতংকের সৃষ্টি করছে। শীতের দেশেও এখন নাতিশীতষ্ণ অঞ্চলের মত গ্রীষ্মকালের মত তাপমাত্রা ৩০-৪০ এ ঘুরাফিরা করে। হিমবাহের বরফ ধ্বসে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির খবরও পাওয়া যায়। সামুদ্রিক বিরূপতায় সারা বছর জুড়ে নিম্নচাপ, ঘুর্নিঝড়, টর্নেডোর তান্ডবে ভূমন্ডলের প্রণীকূল ও তাদের সাধের দুনিয়ার সাজানো জনপদে আহাজারির সুত্রপাত ঘটে। আর নিত্যদিনের পরিবেশ দূষনের যে কড়চা শুরু হয়েছে পৃথিবীময় তা থেকে নিস্কৃতির প্রচেষ্টার খামতি যে নেই, তার প্রমান তো ইদানীং দেখাও যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দৌড়ঝাঁপের সেই জলবায়ু সম্মেলন থেকে শুরু করে পরিবেশ দূষন ইত্যাদি নিয়ে এখন চলছে এক অলিখিত যুদ্ধ। এ যুদ্ধ টিকে থাকার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ পৃথিবীকে মনুষ্য বসতির যোগ্য হিসাবে স্থিতি দেয়ার এক কঠিন সংগ্রাম।
পৃথিবীতে মানুষ বৃদ্ধির সঙ্গে তার চাহিদার আনুসাঙ্গিকতাও বেড়েছে। বেড়েছে অন্যান্য প্রানীকুলেরও ভারসাম্যহীনতা। কিন্তু ভূখন্ডের পরিমান কি বেড়েছে? মানুষের জন্য বসতি ও রাষ্ট্র বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবন যাত্রার উন্নয়নে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের বহরও বেড়েছে। ফলে এসবের যোগানে ভূমন্ডলের ground water থেকে শুরু করে খনিজ, তেল-গ্যাসসহ প্রকৃতি ও ভূগর্ভস্থ সবকিছুর উপর নির্ভরশীলতার প্রতযোগিতা বেড়েছে। বিশ্ব এখন জ্বালানী নির্ভরশীলতার যুগে বাস করছে। মহাকাশের রকেট সাইন্স থেকে শুরু করে স্থলভাগের নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাত্রা ও ভূগর্ভস্থ সম্পদ আহরনেও আমরা এই energy নির্ভরশীলতার culture এ বেপরোয়া হয়ে পড়েছি। ফলে অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যবহারে জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোপানলে এই ভূমন্ডল ডুবতে বসেছে। অতিরিক্ত কার্বন নিঃস্বরনের খেসারতে ভূমন্ডলের উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। ফলে হিমবাহের বরফ গ'লে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। নিম্নভাগের সমভূমি সমুদ্রের লবনাক্ততায় বিরান হচ্ছে। জলবায়ুর এহেন বিরূপতায় জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জলজ যন্ত্রযানের দাপটে এবং সেসবের উষ্ণতা সৃষ্টি ও বর্জ্যের বেপরোয়া ও অপরিকল্পিত নিঃস্বরনে সামদ্রিক প্রানী কুলে মড়ক সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাকিতিক ভারসাম্যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। ভূগর্ভস্থ জলের পরিকল্পনাহীন ব্যবহারে জনপদে সুপেয় জলের স্বল্পতা সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলের অপরিকল্পিত ব্যবহারে ভূমন্ডলের ইকো সিস্টেমে সমূহ ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে জলবায়ু ও পরিবেশ দূষন ইত্যাদি নিয়ে এখন বিশ্বময় একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। দুনিয়ার তাবড় নেতা মাথারা তাদের এই বাসযোগ্য পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার মানসে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। জাতিসংঘের UN Framework Convention on Climate Change এর ব্যানারে ১৯৭ টি দেশ এখন জাতিসংঘের ছাতার নীচে একত্র হয়ে COP (conference of the parties) সৃষ্টির মাধ্যমে জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে।
১৯৯২ সালে জাতি সংঘের ব্যানারে রিও ডি জেনিরোতে Earth Summit অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জলবায়ুর পরিবর্তশীল বিরূপতা নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালে ১৯৬ টি দেশের স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে বার্লিন সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের টনক নড়ার পর থেকে ভূমন্ডলের জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। ফলে ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়ে এর বাধ্যবাধকতায় প্রাতিষ্টানিক রূপ নেয়। আর তখনই কপ(COP) নামক ধারনা নিয়ে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ সমূহ এই জলবায়ু সম্মেলনের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির ঘোষনায় এর দৃঢ়তা পায়। মোটের উপর জ্বালানীর বহুমুখী ব্যবহার ও তা থেকে কার্বন নিঃস্বরন এবং উষ্ণতা সৃষ্টির ফলে ভূ প্রকৃতিতে যে ভারসাম্যহীনতা ও প্রকৃতির বৈরিতা সৃষ্টি হচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরা দরকার। রাষ্ট্র সমূহকে সজাগ করা এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশকে রক্ষা করাই হচ্ছে এই কপের মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশ সমূহে যে হারে মানুষ বাড়ছে এবং তার চাহিদা পুরনে যেভাবে অপরিকল্পিত হারে নগরায়ন হচ্ছে তাতে করে বিশ্বে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। তদুপরি অযাচিত শক্তিমত্তা দেখাতে গিয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গোলাবারুদ ও অস্ত্রের ঝনঝনানি পৃথিবীর স্বাভাবিক জলবায়ু প্রতিবেশের সর্বনাশ করছে - সেটা অনুমান করেই বলে দেয়া যায়। যদিও এই আওয়াজটি এখনো অতটা স্পষ্ট আকারে এই সম্মেলনে প্রকাশ্য হয়নি।
UN ছাতার নীচে রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা সফল ভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার রূপরেখা বাস্তবায়নে কামিয়াব হোক - এই কামনাই করি। জলবায়ু সম্মেলনের এই কপ পৃথিবীকে মনুষ্য বসতির বাসযোগ্য করে টিকিয়ে রাখার স্বপ্নে সফল হোক।