জালাল উদ্দিন আহমেদ
অস্তিত্ব সংকটে মানব সভ্যতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:১১ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
একটি দেশের বুনিয়াদ মজবুত করতে হলে প্রথমে নজর দিতে হবে সেই দেশটির ভূ ভৌগলিক অবস্থানসহ তার পারপার্শিক প্রতিবেশ পরিবেশ ও অঞ্চলিক সহবস্থানের চালচিত্রের দিকে। পাশাপাশি নিজের অবস্থানগত বেসিক অনুসঙ্গের সামঞ্জস্যতা কতটুকু মজবুত সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে ভাগ্যবানই বলতে হয়। পলি বিধৌত সমতল ভূমির ছোট্ট ভূখন্ড এই বাংলাদেশের বয়স সবে পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকেও আমরা অনেক ভাগ্যবান। লাগোয়া প্রতিবেশী বলতে বন্ধু প্রতীম ভারতের সঙ্গে আমাদের সহবস্থানের চিত্রটা ঐতিহাসিক। জাতি হিসাবে আমরা অত্যন্ত সুসংহত। অর্থাৎ এক দেশ এক জাতি এবং এক পতাকার সংহতি নিয়ে আমাদের মজবুত অবস্থান। বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এই দেশটির আয়তন মাত্র সাতান্ন হাজার বর্গ মাইল। আমাদের শক্তি হচ্ছে আমাদের জাতীয়তাবাদ এবং বোধ। আমাদের শক্তির উৎস হচ্ছে জনবল এবং দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেম এবং বাঙালীর বাঙালীয়ানা নিয়েই আমরা স্বপ্নচারী হতে চাই। পৃথিবীর জনঘনত্বের দেশ হিসাবে আমরাই বোধ হয় সবচেয়ে এগিয়ে আছি। দেশীয় চাহিদায় চলার পথে হাজারো অভাব অভিযোগ থাকলেও আমাদের মহান পুর্ব পুরুষদের স্বকীয়তা ও সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, বাঙালী জাতীততাবাদকে নিজের করে লালন করার লক্ষ্যে আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের গর্বিত জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছি।
স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী এই কিছুদিন আগে আমরা সাড়ম্বরে পালন করলাম। যা কিছু করি আমরা এখন আমাদের মত ক'রে করে থাকি। আমাদের জাতির মহান স্থপতির জন্ম শতবর্ষও আমরা মহা ধুমধাম করে পালন করলাম। অর্থাৎ এখন আমরা যা কিছু করি তা আমাদের মত করেই করি, আমাদের প্রয়োজনেই করি। আমাদের দেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি থেকে শুরু করে আপাদমস্তক সবকিছু গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের। আমরা সে পথেই আছি। তবে পথটা যে মসৃন নয় সেটা আমরা গত পঞ্চাশ বছরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এবং পাচ্ছি। আমাদের রাজনীতি আছে, সমাজনীতি আছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যতসব নীতি এবং পথ, সবই আমাদের আছে। এবং তা আমাদের মত করে আমরা সাজিয়েছি বা সাজাতে চাই। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ দিয়ে গেছেন। মহান নেতার নির্মম প্রস্থানের পর টালমাটাল বিপথ গামিতার বিশৃংখল সময়ে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠের সিপাহশালার দেশটাকে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে সুযোগ সন্ধানী রিপার্টেড সেনা শাসকের উচ্চাভিলাষী এক দশকের শাসন ব্যবস্থায় দেশ এক আরব্য রজনীর সিরি ফারহাদের প্রেম কাহিনীর ক্ষেত্রভূমিতে অবগাহন করেছে। অবশেষে পিতা ও ঘোষকের বংশ পরম্পরার বিনি সুতোয় গাঁথা এক তথাকথিত অথচ অবধারিত গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার গ্যাঁড়াকলে বাংলাদেশকে এখন ঘুম পাড়ানি গানে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। তবুও আমরা এগোচ্ছি, বেশ আছি।
বিশ্বে এখন সংকট চলছে। এই তো বিগত বিশ একুশে আমরা মরন ব্যাধি করোনার ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গৃহবন্দী ছিলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে গা ঝাড়া দেয়ার সন্ধিক্ষনে সুপার পাওয়ার রাশিয়ার আগ্রাসনে পৃথিবীর শস্য ভান্ডার নামে খ্যাত একটি দেশ ইউক্রেন এখন আক্রান্ত। সেখানে এখন পুরোদস্তুর যুদ্ধ চলছে। ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতায় পুরো বিশ্ব এখন যুদ্ধজ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে জ্বালানী সংকট, খাদ্য সংকটের আগাম বার্তার এলার্ম বাজা শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে আমরাও সে জ্বরে আক্রান্ত। জ্বালানী সংকটের প্রভাবে দেশের নিত্যপন্য থেকে শুরু করে প্রতিটি শাখা প্রশাখায় মূল্যস্ফীতির সংকট শুরু হয়েছে। উৎপাদনশীলতায় মন্থর গতি সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দেশের খাদ্যপন্য থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনেও নিম্নগামিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সাধারন মানুষের নিত্য দিনের রোজনামচায় নাভিশ্বাস তুলেছে। ওদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়া শুরু হয়ে গেছে। সরকার ব্যবস্থার কপালের ভাঁজ এখন স্পষ্টাকারে সাধারন মানুষকে আতংকগ্রস্থ করছে।
সুপার পাওয়ার রাশিয়া তার নিজ উঠানকে পরিচ্ছন্ন রাখার অভিলাষে যে যুদ্ধবিগ্রহ এখন ইউক্রেনের ভূখন্ডে চালাচ্ছে তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। আটলান্টিকের অপর পারে অবস্থিত কয়েক হাজার মাইল দূরের স্বঘোষিত দুনিয়ার মোড়ল মার্কিনীরা ইউরোপ মহাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিকে শক্তি ও চাকচিক্যের জৌলুষে ন্যাটো নামের টকলেট খাইয়ে সেই ভূমন্ডলে নিজের সামরিক শক্তির প্রসার ঘটাতে চায়। তখন সেই ইউরোপেরই মাটির বাসিন্দা আরেক সুপার পাওয়ার রাশিয়া চুপ করে বসে থাকবে তা কি করে হয়! তারই কোল ঘেঁষে একই জাতিগোষ্ঠীর সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ শত্রুর সামরিক জোটে সামিল হয়ে তারই সীমান্তে নৃত্য করবে, এটা বিশ্বের দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার রাশিয়া মেনে নেয় কেমন করে! আমেরিকা নামক মোড়লটির ক্ষেত্রে এরকম ঘটলে তারা কি করতো? যাহোক, গরীবের আবার ভাসুরের নাম মুখে আনতে নেই - এই বাস্তবতায় আমি ঔদ্ধত্ব্য দেখালাম কিনা জানি না। তবে মরনঘাতি পরমানু অস্ত্র ছড়াছড়ির এই ভূমন্ডলে অসাবধানতার খেসারতে যদি কোন পক্ষের হাত ফস্কে ওই অস্ত্রটির ব্যবহার হয়েই যায়, তখন অসুরীয় শক্তির চুলকানিতে দুনিয়াটা ধংস হয় কিনা সেটার ক্ষন গননায় উদ্বিগ্ন পৃথিবীর সাত'শ কোটি আদম সন্তান। ক্ষমতা ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনের যে অনুশীলন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে করে শান্তিকামী পৃথিবী অশান্তি ও যুদ্ধ বিগ্রহের আশংকায় আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। স্রষ্ঠা তার আপন মহিমায় তারই সৃষ্ট সৃষ্টির সেরা প্রানী কূলকে প্রকৃত আশরাফুল মোখলুকাতের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার ক্ষমতায় বলীয়ান করুন - এই প্রত্যাশা করছি।
পৃথিবীকে শান্তির ঠিকানা হিসাবে গড়ে তোলার প্রত্যাশায় যুগে যুগে মানুষ তার প্রচেষ্টার সবকিছু দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু শক্তিমত্তার উন্মত্ততা, জাতিগত অহংকার, ক্ষমতার প্রসার ও প্রতিপত্তি, লোভ লালসা ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অধঃগতির কোপানলে পড়ে সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই এই মনুষ্য অধ্যুষিত গ্রহে যুদ্ধ বিগ্রহ মারামারি কাটাকাটি লেগেই আছে। লৌহ, প্রস্তর, তাম্র যুগ পেরিয়ে মানুষ প্রাচীন ও মধ্যযুগের কয়েক সহশ্রাব্দ পার করে এখন আধুনিক যুগে পদার্পন করেছে। জ্ঞান বিজ্ঞানে এবং মানব সভ্যতা ও রাষ্ট্রচিন্তার সূচকে মানুষ তার জীবন ও জীবিকার সর্বোৎকৃষ্ট সময় অতিবাহিত করছে এখন। ফলে চাহিদার সামঞ্জস্যতায় মানব জাতি তার নিজ ভূখন্ডে সার্বভৌমত্বের স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল রয়েছে। সর্বোপরি পূর্বের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত ও যুদ্ধ বিগ্রহের জেরে মানুষ তার নিজের গরজেই গোটা পৃথিবীকে এক বাহুডোরে বেঁধে একটি global village এ রূপ দিয়েছে। ফলে বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রপুঞ্জ তাদের এই আবাস ভূমি পৃথিবীতে নিজেদের সুখ দুঃখ হাসি কান্না আজ ভাগাভাগি করে নিতে পারে। কিন্তু ঐযে বলেছি পশুশক্তি। এই পশুশক্তি যখন একজন ক্ষমতাসীন শাসন কর্তার মাথায় ভর করে বসে তখনই অঘটনের সূত্রপাত শুরু হয়। এবং এখন যা হচ্ছে সেটা তাইই। এটা যুগে যুগে চলে এসেছে। দেশে দেশে ক্ষমতার দন্ডে পরাক্রমশালী শাসকেরা যুগ যুগান্তে চলমান থাকে। কোন্দল কোলাহল সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনীতি শাসননীতি ইত্যাদির চাওয়া পাওয়ায় বিভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামোয় এসব ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে। আর এর ফলে শান্তিপ্রিয় পৃথিবীর বুকে ওইসকল ক্ষমতালিপ্সু অপশাসকদের করতলে দেশে দেশে অনাচার, অপকর্ম ও যুদ্ধ বিগ্রহ - পৃথিবীকে অশান্ত ও অসহিষ্ণু করে দেয়।
বয়ঃসন্ধির পঞ্চাশ পেরোনো মুক্ত ভূখন্ডের বাঙালী জাতি - আমরাও মনে হয় সেই অক্টোপাশের থাবায় খাবি খাচ্ছি।