জালাল উদ্দিন আহমেদ
জনস্বার্থ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৩৮ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
জানি না এসব আইন কানুন কবে তৈরী হয়েছিল এবং কোন স্বার্থে হয়েছিল। তবে অবশ্যই তা পঞ্চাশ বছর আগেকার নয় বলেই অনুমিত হয়। তাছাড়া পঞ্চাশ বছর আগে বোধ হয় এই সব জনস্বার্থ, জনকল্যান ইত্যাদি গালভরা রাজনৈতিক কথা বার্তার খুব প্রয়োজন পড়তো না। "জনস্বার্থ" নামক কথাটি কখন প্রয়োগে এল তা কিন্তু আন্দাজ করেই বলে দেয়া যায়। জনগন নিয়ে যারা কথা বলতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নির্ঘুম রাত কাটানোর তথাকথিত বয়ান বাজিতে সরব থাকেন তারাই তো জনস্বার্থের বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। এটাই তো স্বতঃসিদ্ধ। জনগনের সেবকের(!) ওজিএল পাওয়া মান্যবরেরাই তো রাজনীতির স্বার্থে এসব জন সপৃক্ততার কথা বলে তাদের চলার পথকে মসৃন করার মহৎ উদোক্তা হবেন - এতে সন্দেহ আছে কি!
একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ড তার রাষ্ট্র পরিচালনার মোড়কে অনেক কিছুই করে থাকে। এসবের অনেক কিছুই জনগন জানে না, জানতে চায় না বা সেসব জানার ইচ্ছেও তাদের থাকার কথা নয়। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জনগন তাদের বেঁচে থাকার ন্যুনতম চাহিদার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কথা বলা ও মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকার নিয়েই স্বপ্নচারী হতে চায়। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মোড়কে জনগন তার মুক্তচিন্তায় রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। রাজনীতির পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে সমাজ চিন্তায় তাদের নিজেদের অবস্থানকে নিশ্চিত করে। এমনকি দেশের রাষ্ট্র নায়ক থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগনও তাদের অধিকার সচেতনতার প্রাপ্য মর্যাদায় সম্মানিত হন। অর্থাৎ পেশাগত জীবনে যার যার স্থানে সবাই সেই গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুসংহত থাকে। পাশাপাশি রাষ্ট্র কাঠামোর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগনও তাদের যোগ্যতা ও কর্ম দক্ষতার সুবাদে কর্মকালীন স্থান কাল পাত্রে সমুন্নত ও সম্মানিত থাকেন।
জানিনা এই মতামত বা প্রশ্ন সম্বলিত লেখাটি এই মুহূর্তে যথাযত হচ্ছে কিনা! কেননা আইন কানুনের বেড়ি লাগানো শিকড় বাকড় কোন্ সময় যে কাকে অক্টোপাশের বহুপদী থাবায় জড়িয়ে ধরে, তার শংকা কিন্তু থেকেই যায়। তারপরেও মানুষ তো। মোদ্দাকথা বাঙালী এবং মহান নেতার পুত্রসম বাঙালী আমরা। তাছাড়া হক কথা বলার সবক তো পিতৃগুরু মাওলানা সাহেবের কাছ থেকেই শিখেছি। অধিকার আদর্শ ও নৈতিকতার স্খলন দেখলে তো বাঙালী নিঃশ্চুপ থাকার কথাও নয়। ঠিকুজি তাইই বলে। কে যেন সেদিন এক পাকা বুদ্ধিজীবির মত মাথা ঝাঁকিয়ে বলছিলেন, এত কথা কেন? দেশ চালাতে, সরকারী কার্যক্রমের সুষ্ঠতা বজায় রাখতে এসব জনস্বার্থের বিষয়টি সামনে এসে যায়। এটা নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে? আবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সচিবদের কথার মধ্যে বেশ অসংলগ্নতাও ধরা পড়ে। এটা নিয়ে রাজনীতির আধিকারিকগনও কথা বলছেন। জনতার কর্মচারীরাও দু'একটা ফোঁড়ন কাটছেন। আবার রাজনীতির পৃষ্টপোষকতায় সৃষ্ট জনতার মঞ্চের কুশীলব রাজ কর্মচারীরাও (যারা এই মঞ্চ আশীর্বাদে রাজা হয়েছিলেন) কথা বলার সুযোগ নিচ্ছেন। কারন তাদের সময় এই "জনস্বার্থ" কথাটি বোধ হয় "রাজস্বার্থ" হিসাবে লিখিত ছিল! ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সমস্ত শাখা প্রশাখা এই "জনস্বার্থ" বিষয়টিকে নিয়ে বেশ জাম্পেশ ভাবেই তাদের রঙিন/সাদাকালোর দেখনি ও লেখনীর মাধ্যমে সরব রয়েছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা নিয়ে মোটামুটি ঝড় উঠেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
যেটা বলতে শরমও পাচ্ছি আবার না বললেও পেটটা ভুটভাট করছে তা হচ্ছে অবসরের সচিব মহাশয়দের যুক্তিতক্কো। বেশ ঝাঁঝালো এবং সুঁচালো যুক্তি দিয়ে তারা মোটামুটি সবাই এই "জনস্বার্থ" কথাটিকে একই ভাষায় খন্ডন করেছেন। সেক্ষেত্রে যারা বলছেন, তারা মোটামুটি তাদের চাকুরীকালীন সময়ে সচিব শিরোমনি হিসাবেই বিচরন করেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সবাই সমস্বরে বলছেন জানার অধিকার, শুনার অধিকার, বলার অধিকার একজন নাগরিক হিসাবে সমভাবে কর্যকরী হওয়া উচিত। কিন্তু যারা বলছেন তারা তো ওই একই পাটাতনে কর্মজীবন কাটিয়ে সচিব শিরোমনি হয়েছিলেন। এই জনস্বার্থ কথাটি কি তাদের নজরে এখন এলো? কেনইবা এখন তাদের মৌলিক অধিকারের এত প্রয়োজন পড়লো? প্রয়াত মেয়র হানিফের জনতার মঞ্চের কথা কমবেশী সবারই মনে থাকার কথা। সেটা ছিল রাজনীতির মঞ্চ। সরকার বিরোধী একটি সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে সেই জনতার মঞ্চ করা হয়েছিল। মনে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে সেই মঞ্চ বানিয়ে দিনরাত সেই মঞ্চ থেকে সরকার পতনের শ্লোগান বক্তৃতা ইত্যাদি চালানো হোত। অথচ দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ভবন অর্থাৎ সচিবালয় এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সেই জনতার মঞ্চের আশেপাশে লাগোয়া অবস্থায় বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপুর্ন দপ্তরটির হেড কোয়ার্টারও সেই জনতার মঞ্চের মুখামুখি অবস্থানে বিদ্যমান। অথচ রাজনীতি আমাদের দেশে এত শক্তপোক্ত এবং উদারচেতা যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন অঙ্গেরই টু শব্দটি করার জো ছিলনা সেদিনের সেই কথিত চেতনাবিহীন সরকার(?) ব্যবস্থার শাসনামলে! আর আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী শাসন ব্যবস্থার সোনাঝরা(!) দিনে মানুষজন গলিপথেও তাদের মতামত ব্যক্ত করার জন্য ন্যুনতম মানব বন্ধনও করতে পারছে না। যেটা বলতে গিয়ে কিছুটা ন্যারেটিভ হয়ে গেলাম তা হোল জনস্বার্থ। হাঁ, এই জনস্বার্থের কুশীলবরা সদলবলে সেদিন তাদের চেয়ার ছেড়ে সেই রাজনীতির জনতার মঞ্চে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে গনতান্ত্রিক আচরনের প্রতীক হয়েছিলেন। সেদিন কিন্তু তাদেরই সৃষ্ট "জনস্বার্থ" বিষয়ক চাকুরী প্রবিধানমালায় কোন শংকা সৃষ্টি হয় নি! দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কোন আশংকাও তৈরী হয় নি। বরঞ্চ তিরস্কার কিংবা চাকুরীচ্যুতির পরিবর্তে তারা পরবর্তীকালে চাকরী তথা রাজনীতির উঠানে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
দ্বিচারিতা শব্দটি আমাকে প্রায়শঃই বিচলিত করে। চাকুরী জীবনে এই শব্দটি বেশ ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম। কিন্তু চাকুরী করি তো তাই চাকরের মতই বিচরন করাটা অবশ্যিক ছিল বিধায় ওসব নিয়ে ভাববার সময় কম পেতাম। সেক্ষেত্রে ঐ যে বলেছি পিতৃগুরুর হক কথার ট্রেনিং। সেটা মাঝে মধ্যে প্রকাশ্য হয়ে যেত। এ নিয়ে কর্মজীবনে কম তো ঝক্কি ঝামেলা সইতে হয়নি। অবশ্য এখন এই অবসরের বৃদ্ধ বয়সে এসে এসব দ্বিচারিতা সত্যই অসহ্য লাগে। চেতনাবিহীন(!)সেই সকল দিনে সচিব বা আধা সচিবের চেয়ারে বসা অবস্থায় জনতার মঞ্চে গিয়ে ভাষন দিয়ে পুরস্কার পদোন্নতি পাওয়া যায় আর এখনকার চেতনার নহর বয়ে যাওয়া দিনে কে কোথায় কার অফিসে গিয়ে এককাপ চা খেয়েছে তার জন্য তাকে চাকরী হারানোর খেসারতে পড়তে হয়। সত্যই সেলুকাশ! কি বিচিত্র এই দেশ। রাজনীতির একপক্ষ হরতাল মিটিং মিছিল করে দেশ জনপদকে ঝাঁঝরা করে দিতে পারবে আর অন্যপক্ষকে মিটিং মিছিল করার জন্য জনতার কর্মচারীর বারান্দায় লাইন ধরে দাঁড়াতে হবে! কেউ ক্ষমতার চেয়ারে বসে একজনের বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টির শ্রাদ্ধ করে বেড়াবেন আর অন্যজন তার সামান্য সমালোচনা টুকুও করতে গেলে আইনের বেড়াজালে খাবি খাবেন। আবার মিডিয়ারও বলিহারি! একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বিভাগীয় জনসভাকে সামঞ্জস্যতায় ফেলে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন দলের একটি জেলা সম্মেলনের কর্মী উপস্থিতির তুলনামুলক চিত্র দেখানো হচ্ছে। এবং সেটাকে হেডলাইনও করা হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও রাষ্ট্রের জনগনকে ধোঁকা দেয়ার আয়োজন নয় কি এসব! রাষ্ট্র যন্ত্র ও পরিপাশের কোন্ অনুসঙ্গ আজ 'জনস্বার্থে' আছে বলা যাবে কি? কোন্ গনতন্ত্রিক রাষ্ট্রের হবুচন্দ্রীয় আচার আচরন এসব!
মনে পড়ে কোন এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু সরকারী কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তোমরা জনতার কর্মচারী। নিজেদেরকে রাজ কর্মচারী ভেবো না। এই রাজ কর্মচারীর হাওয়াটা বোধ হয় আজকের দিনে আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মীদের কানে ইদানীং খুব বেশী করেই বাতাস দিচ্ছে। নইলে কোন্ মধু-মক্ষিকার অন্বেষায় চাকুরীরত কর্ম চারীরা তাদের কর্মস্থলে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জিয়া পরিষদ ইত্যাদি নাম দিয়ে তাদের অফিসার সমিতি বা কর্মচারী সমিতি গঠন করে? তারা তো রাষ্ট্র যন্ত্রের অনুসঙ্গ। তারা কেন রাজনীতির ব্যানারে কর্মস্থলে বিচরন করবেন? রাজনীতির কলুষিত বার্তাগুলি যখন একজন শপথ নেয়া প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর কাঁধে সওয়ার হয়ে প্রশাসনিক শ্রেনীবিন্যাসে মনোনিবেশ করবে তখন সেই পরিবেশ থেকে দেশের সর্বময়তার নিশ্চয়তা স্বাভাবিকভাবেই বিচ্যুত হবে। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বলুন আর জেনারেল জিয়ার স্বনির্ভর বাংলাদেশের কথাই বলুন, সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন স্বাধীন সার্বভৌম ও গনতান্ত্রিক আচরনের মূল চালিকা শক্তির সর্বজনগ্রাহ্য নিরপেক্ষ প্রশাসন কাঠামো। যার মাধ্যমে দেশের সমগ্র জনপদের মৌলিক অধিকারের জায়গাটিকে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রটি নিশ্চিত করা হবে। যতই সিটিজেন চার্টার বা আরও সব গালভরা নাগরিক অধিকারের কথা বলি না কেন, ব্যাখ্যা ছাড়া বা জবাব দিহিতা ছাড়া এইসব "জনস্বার্থ" যতদিন আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বসে থাকবে ততদিন আমরা সেই আইয়ুবীয় থ্রি নট থ্রির ঘুর্নাবর্তেই ঘুরপাক খেতে থাকবো।