জালাল উদ্দিন আহমেদ
টকশো ও মিডিয়া
টক ঝালের টকশো
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ অক্টোবর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
এ যেন যমুনার সরোবরীয় মহা জলরাশির স্রোতের সঙ্গে প্রমত্ত পদ্মার সর্বনাশী স্রোতের সঙ্গম স্থলের বেসুরো মিলন মেলা। সুর তাল লয় ছাড়া এক বেসুরো জলসার নিত্যদিনের মহা আয়োজন। যুক্তি তর্ক টক ঝাল মিষ্টির এক নতুন সংস্করন। এসব রাজনীতি ও রাষ্ট্র চিন্তার কথাবার্তা বা যুক্তি তর্ক বিদেশী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় হতে দেখেছি। এখনও হয় তবে তা ভাষার পরিমার্জন ও মিষ্টভাষ্যের শ্রুতি মধুরতায় কর্ণ কুহরের আদি গহ্বর হয়ে মস্তিষ্কের অন্দর মহলে আঘাত করে। কি রাজনীতিবিদ, কি সাংবাদিক বা রাষ্ট্র নায়ক বা আধিকারিক সর্ক্ষেত্রেই এক পরিমার্জিত শব্দ চয়নের কথামালা। বিষয় বস্তুর উপর প্রকৃত আলোকপাত করে সেসব হার্ড টক বা আলোচনা অনুষ্ঠানগুলি শ্রুতি মধুর ও শ্রুতি গ্রাহ্য হয় বলেই মন লাগিয়ে ওসব শোনার আগ্রহটা বেড়ে যায়।
বলছিলাম দেড় লাখ বর্গ কিলোমিটারের বাংলা ভূখন্ডে সৃষ্টি হওয়া গোটা পঞ্চাশেক টেলিভিশন চ্যানেলের রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির উপর আলোচনা সমালোচনা বিষয়ক টক-শো অনুষ্ঠানের কথা। এসব বিষয় বস্তুর উপর আলোচানা ইত্যাদি আমাদের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আগে হয়নি বা হোত না - তা কিন্তু নয়। তবে তৎসময়ে যেহেতু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বলতে ওই সবেধন নীলমনি বিটিভিকে বুঝাত, এমতাবস্থায় সেদিনের সেই টিভি সেটটিকে সবাই সরকারী ম্যাজিক বাক্স বলেই জানতো। সেই সরকারী ম্যাজিক বাক্সের মজেজা এখনো একই গতিতে চলমান। সময়ের বহমানতায় দেশে মিডিয়ার প্রসার ঘটে। ব্যক্তি মালিকানার সৌজন্যে দেশে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার জয় জয়কার শুরু হয়েছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে গত বিশ পঁচিশ বছরে চল্লিশ ঊর্ধ টেলিভিশন সেন্টারের গোঁড়া পত্তন হয়েছে। দর্শক সংখ্যার লিমিটেশন থাকলেও দেশে মিডিয়ার প্রচার ও প্রসারের কোন লিমিটেশন নেই। ফলে সৃষ্টি হওয়া অর্ধশত ছুঁই ছুঁই টেলিভিশন স্টেশন থেকে প্রচারিত হতে শুরু করে সমচিন্তার অনুষ্ঠানমালার পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ দেখাদেখি যাকে বলে। নতুন উদ্ভাবনী অনুষ্ঠানের আকালে টেলিভিশনগুলি তাদের জন্মলগ্ন থেকেই কিছুটা একঘেয়ামী চক্করের ঘুরপাকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাছাড়া সাপোর্ট সার্ভিসের অপ্রতুলতার কারনেও হয়তোবা তারা উচ্চমানের অনুষ্ঠান তৈরীর সাহসিকতা নিয়ে এগোতে পারেন না বলেই মনে হয়। কেননা একটি অনুষ্ঠানের নির্মান ব্যয় যদি ঠিকঠাক উঠে না আসে তবে বিনিয়োগকারীরা সেক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হন।
খুব কমন একটি অনুষ্ঠান আমাদের এই ব্যক্তি মালিকানাধীন টিভি গুলোতে বেশী করেই দেখা যায়। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও অনুষ্ঠানের গতি প্রকৃতি ও বক্তব্য গুলি যে এক, এতদিনে বাঙালীর হেঁসেলের মালকিনেরও তা জানা হয়ে গেছে। শুরুর এক "তৃতীয় মাত্রা" আজ বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়া কয়েক ডজন টেলিভিশনে কত যে মাত্রা পেয়েছে তার ইয়ত্ত্বা নেই। টক-শো নামক এসব অনুষ্ঠানের মাত্রাতিরিক্ত অপপ্রয়োগের সাইড এফেক্টে আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক মূল্যবান সম্পদের অপচয় করে ফেলেছি। ফলে রাষ্ট্রীয় অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যুতসই ম্যানেজার বা পরিচালক খুঁজে নিতে দ্বিধান্বিত হই। কেননা, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষনে এসব আলোচকদের পৈতা দেখলেই তাদের পরিচয় চিহ্নিত হয়ে যায়। রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে শুরু হওয়া এসব টক-শো এখন বহুমাত্রিক ভাব নিয়ে চলতে শুরু করেছে। অর্থাৎ একই প্রডাক্ট অথচ উঠান আলাদা। আবার অনুষ্ঠানগুলিকে সমৃদ্ধ করার জন্য যাদেরকে নিয়ে এসব আয়োজন করা হয় ব্যতিক্রম হিসাবে দু'একজনকে নিরপেক্ষতার নিক্তিতে ফেলা গেলেও নব্য বুদ্ধিজীবির খাতায় নাম লেখা এসব চেনা মুখগুলো পার্টজান রাজনীতির প্রডাক্ট বলেই মনে হয়। সাদা চোখে তারা এ অথবা বি এর ফ্রেমেই ধরা পড়ে। আর একটি বিষয় দৃষ্টিকটু ভাবে ধরা পড়ে তা হচ্ছে নতুন প্রতিষ্ঠিত চ্যানেলগুলি রাজনৈতিক মদদ ও আশীর্বাদ পুষ্ট হওয়ার ফলে তাদের অনুষ্ঠানমালাও কেমন যেন দলকানা সীল নিয়েই প্রচারিত হয়। এমনকি ২৪ ঘন্টা রোটেশনে ঘন্টায় ঘন্টায় প্রচারিত খবরের এক ঘেয়ামী এবং সংগে লম্বা বিরতির বিজ্ঞাপনী প্রচারনা এসব টিভির গ্রহন যোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
যাহোক রাজনীতির টক-শো গুলি প্রথম দিকে শ্রোতা দর্শকদের কাছে টানলেও সময়ের আবর্তে যখন সেগুলি রাজনৈতিক ঝগড়া-ঝাঁটির মঞ্চ বনে যায় তখন সাধারন মানুষ সেসব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে কয়েক ডজন টেলিভিশনের একই ধাঁচের ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া এই টক-শো গুলির কয়েক শত উচ্চ শিক্ষিত, পদাধিকারী, অবসরের সামরিক বেসামরিক আমলা, স্বনামধন্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ত্ব এমনকি আইন আদালতের ব্যক্তিত্ত্বরা যখন রাজনীতির বিচার বিশ্লেষনে নিজেদের বুদ্ধিজীবীয় মতামত ব্যক্ত করেন তখন তাদের রাজনীতির পক্ষাবলম্বনের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে ধরা পড়ে। ফলে আপতকালীন সময় বা ক্রাইসিস মোমেন্টে দেশের জন্য কোন যোগ্য এবং নিরপেক্ষ ম্যানেজার বা পরিচালক নির্বাচনে অমরা গলদঘর্ম হই। বিগত দিনে দেশের ক্রাইসিস মোমেন্টে আমাদের দেশের রাজনীতির এই পক্ষ বিপক্ষের ঘটনাগুলি সাধারন জনপদে অস্বস্তির কারন হিসাবেই চিহ্নত হয়ে আছে। অবশ্য নিরপেক্ষতার পরিমাপ করতে গিয়ে আমাদের দেশে যে অতি রাজনীতির প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে তা কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের রাজনৈতিক দৈনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যাহোক ইদানীং কিছু সুমতির লক্ষন দেখা যাচ্ছে। আজকাল প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার আয়োজন করা হয় যা ইতিবাচক। এসব বিষয় ভিত্তিক আলোচনা ও পরামর্শ পরিসেবা, টকশো নামক এক ঘেয়ামী রাজনীতির কচকচানি থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তির বাতাস ছড়াচ্ছে। শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, আইন আদালত সহ বেশ কিছু সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়কে সামনে রেখে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে প্রচারিত এসব টকশো বেশ গ্রহন যোগ্যতা পেয়েছে বলেই মনে হয়।
আজকাল টেলিভিশন বা অন্যান্য মিডিয়ার চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেভাবে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে তাতে করে ওই জায়গা দখলের অপচয় থেকে মানুষ বোধ হয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। কারন যে খেদমত বা সেবা স্রেফ পকেটে রেখেই পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে কোন দুঃখে মানুষজন ঘরের কোনে টেবিল লাগিয়ে টেলিভিশন লাগাবেন যার সঙ্গে ক্যবলের তার সংযোগ থেকে শুরু করে একটি নির্দিষ্ট পজিশনে বসে দেখা বা শুনার বিড়ম্বনায় সময় নষ্ট করবেন! তবে টেলিভিশন গুলোর অনুষ্ঠান বা টকশো যাই বলি না কেন - এমনকি খবরও, এসবের বেসিক তথ্য উপাত্তের একটা বাস্তব ভিত্তি আছে বলেই হয়তো এসবের প্রয়োজনীয়তা সহজে ফুরাবে না। আর সোশ্যাল মিডিয়ার খবর ও টকশোর বহুরূপী ভাষা ও উপস্থাপনা - চটকালো, চমকদার, ঝাঁঝালো হলেও তার সত্যতার মাপকাঠি সত্যই প্রশ্ন বোধক। সেক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগের ইউটিউব, ফেসবুক এমনকি গুগল নিউজের মধ্য্যেও ফাঁক ফোকর রয়ে গেছে যার বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনে আরো সময় লাগবে বলে মনে হয়। তারপরেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আমাদের চাহিদার জায়গাগুলি ক্ষনে ক্ষনে দিন বদলাচ্ছে এবং চাপে পড়েই হোক বা প্রয়োজনের তাগিদেই হোক আমরা সেসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।
গলির দোকানী কালাম মিয়া যখন তার ক্রেতা শফি মন্ডলের সাতানব্বই টাকার তিন চারটি আনাজের দামের হিসাবটা হাতে রাখা ক্যালকুলেটরের সাহায্য নিয়ে সাব্যস্ত বা কনফার্ম করে তখন বুঝতে পারি প্রযুক্তি আমাদের কতটা আসাড় করে রেখেছে। তবে টক ঝাল মিশ্রিত টকশোর তন্দ্রাচ্ছন্নতা দিয়ে শুরু হওয়া এই প্রযুক্তি বা ডিজিট্যালাইজেশনের যে সফর শুরু হয়েছে তা হয়তো সময়ের চাহিদায় আমাদেরকে আরও উন্নত কোন গলিপথে নোঙ্গর করাবে। সেক্ষেত্রে মনুষ্য বিকাশের বেসিক উঠানে তার প্রভাব কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।