জালাল উদ্দিন আহমেদ
আর্য-অনার্য
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ অক্টোবর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:২৯ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
১। ভারত নামের বিশাল দেশটি তো একদিনের নয় যে আঙুল গুনে দিনক্ষন বলে দেয়া যাবে। সেই প্রাচীন যুগ পূর্ববর্তী লৌহ, ব্রোঞ্চ, তাম্র, এমনকি অন্ধকার যুগেও এর অস্তিত্ব ছিল। তারপরেও অত ভিতরে না ঢুকে প্রাচীন যুগের শুরুর কাল হতে এই উপমহাদেশে যে বিবর্তনের ঘটনাগুলি ঘটেছে তা থেকে মোটা দাগে দুটি শব্দ ভারতবাসীকে প্রতিনিয়ত আলোচনায় রাখতে বাধ্য করে। আর করবেই বা না কেন! যেখানে জাত্যাভিমান ও আপন অস্তিত্ত্বের ঠিকুজি নিয়ে কাইজ্যা ফাসাদ হয় তখন তো এর দ্বারোদঘাটনে পন্ডিত মশাইদের গলদঘর্ম হতেই হয়। এবং সেটারই পোস্ট মর্টেমে পরিশ্রান্ত হয়ে তারা এখন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে ভারত হচ্ছে আর্য অনার্যের সংমিশ্রনে গঠিত একটি জনপদ।
২। প্রকৃত অর্থে আর্য সভ্যতার ছোঁয়া নিয়েই তৈরী হয়েছে বর্তমান ভারতবর্ষের হিন্দু ধর্মের প্রথা ও সভ্যতার বিকাশ। হিন্দু বলে কোন ধর্ম ছিল না এবং এখনো ধর্ম হিসাবে এটার স্বীকৃতি আছে কিনা সেটাও সন্দেহের জালে জর্জরিত। প্রাচীন ভারতের চিত্রপটে যা দেখা যায় তা হচ্ছে নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির আবাসভূমি ছিল এই ভারতীয় উপমহাদেশ। তারা সময় ও অঞ্চল ভিত্তিক স্থায়িত্বে ছয়টি স্তরে সজ্ঞায়িত হয়েছেন। তারা হচ্ছেন নেগ্রিটো, অস্ট্রোলয়েড, প্রত্ন দ্রাবিড়, আলপাইন, নর্ডিক এবং মঙ্গোলীয়। তারা আদিবাসীয় পরম্পরায় ভারতবর্ষের মূল অধিবাসী। এদের মধ্যে দ্রাবিড়রা ছিলেন সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি যার চরমতম বিকাশ ঘটে সম্রাট অশোকের শাসনামলে। খ্রীষ্টপুর্ব পাঁচ শতকে ভারতের গয়ায় আবির্ভাব ঘটে গৌতম বুদ্ধের। তার অহিংস বাণী ও ধর্মমত শান্তিপ্রিয় আদি ভারতীয়দের আলোর পথ দেখায়। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠী বুদ্ধের অহিংস বাণীর ছায়াতলে সমবেত হন। বলা হয়ে থাকে সম্রাট অশোকের শাসনামলে ভারতবর্ষের নব্বই ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। জানা যায় প্রাচীন ভারতের সেই মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার সভ্যতা ছিল আদি ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ। দ্রাবিড় জাতির উন্নয়ন ও উৎকর্ষতার প্রকৃষ্ট উদাহারন ছিল ওই সকল ভারতীয় সভ্যতা। তবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রকাশ ও বিকাশ হওয়ার বহু আগে থেকে এই উপমহাদেশে ককেশীয় ও এশিয়া মাইনরের কিছু মানুষ দলবদ্ধভাবে হিন্দুকুশ গিরিপথের মাধ্যমে ভারতে আসা যাওয়া করতো। প্রাথমিকভাবে যারা আসতো তারা সাধারনতঃ চলনে বলনে বাঞ্জারান বা যাযাবরীয় স্টাইলে চলাফেরা করতো। ক্রমে এই আসা-যাওয়ার সুবাদে তারা যখন দেখলো ভারত এক উর্বরা মাটির দেশ এবং এখানকার মানুষজন কিছুটা অন্তর্দশী ও আদিবাসীয় আচরনের প্রভাবযুক্ত, তখন তারা তাদের লক্ষ্যবস্তু স্থির ক'রে ধনে জনে ভারতমুখী হওয়া শুরু করে।
৩। আর্যরা মূলতঃ ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিনে জর্জিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ইত্যাদি এলাকার সমতল ভূমির অধিবাসী। গোচারন, পশুপালন ইত্যাদি পেশার অধিকাংশ এরিয়ানরা যখন খরা ও দুর্ভিক্ষের টানায় পড়ে, তখন তারা নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে গো-চারনের সমতল ভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কথিত আছে তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পুর্ব ও পশ্চিম মুখী হয়ে তাদের গরু গাধা ঘোড়ার পাল নিয়ে গমন করে গো-চারন ভূমির অন্বেষায় পুবে তারা পেয়ে যায় সমতল ভূমির হরিয়ানা পাঞ্জাব এবং গাঙ্গেয় উপতক্যার শস্য শ্যামল চারন ভূমি। আস্তেধীরে তাদের বিদ্যবুদ্ধি ও শক্তির ভারসাম্যতায় ভারতবর্ষের সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপনে ব্রতী হয়।
আর্য কথাটি হচ্ছে একটি পদবী। এটা স্বঘোষিত পদবী। পশ্চিম হতে আগত পারস্য ও তৎসংলগ্ন অধিবাসীরা যারা ফার্সী উচ্চারনে আরিয়ান বলে পরিচিত, মূলতঃ তারাই আর্য। আরিয়ান কথাটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিশ্বস্ত। তারা ছিল গৌর বর্নের। লম্বা চওড়া, টিকালো নাক। তারা সাধারনতঃ সংস্কৃত, কেল্টিক, গ্রীক প্রভৃতি সাতটি ভাষায় কথা বলতো। তাহলে অনার্য কারা? হাঁ, ভারতে আগত ওইসকল পশ্চিমের আরিয়ান লোকগুলি বাদে ভারত বর্ষের মূল ভূখন্ডের বাকী অধিবাসীরাই অনার্য বলে চিহ্নিত। এই অনার্যরা প্রাচীন ভারতের অধিবাসী। পুরাতন প্রস্তর যুগের অধিবাসী। দ্রাবিড়িয় তিব্বতীয় ও বিলুপ্ত আদিবাসীর সামষ্টিক আদি ভারতীয়রাই হচ্ছে অনার্য যারা লম্বায় খাটো, গায়ের রঙ কালো ও ধুসর, নাক চেপ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আর্য অনার্য শব্দ দুটি তাদেরই সৃষ্টি যারা নিজেদের পার্থক্য বুঝানোর জন্য ভারতীয় আদি অধিবাসীদের অনার্য বলে সম্বোধন করতো। জাত্যাভিমানী অনেক ভারতীয়ের মতে এই আর্য-অনার্য সম্বোধনটি বৃটিশ শাসকদের সৃষ্ট একটি কুটচাল। ভারতীয়দের হেয় করার জন্যই ঊনিশ শতকের শেষের দিকে বৃটিশরা প্রকাশ্যে এই শব্দ যুগলের প্রচারনা চালায়। তবে আর্য হওয়ার ধারনাটি জাতিগত নয়। বরং ধর্মীয়, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত করার একটি লক্ষ্য স্থির করেই তারা এটি করেছিল। তারা যখন ভারতবর্ষে আসে তখন তারা তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ 'বেদ'কে সাথে নিয়ে আসে। এই বেদের চারটি খন্ড। ঋকবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদ। এই চারটি খন্ডে মহাগ্রন্থ বেদ চারজন ঋষির মাধ্যমে ঈশ্বর প্রদত্ত বাণী বলে প্রচার চালানো হয়। বেদ অর্থ জ্ঞান। সনাতন বেদকে তারা অপৌরষীয় বলে ঘোষনা করে। অপৌরষীয় কথাটির অর্থ যা মনুষ্য সৃষ্ট নয় অর্থাৎ অলৌকিক। এভাবেই ভারত রাষ্ট্রে সনাতন ধর্মের প্রকাশ ও প্রচার কার্যকরী হয়।
৪। তবে আর্য অনার্যের সাংঘর্ষিক কিছু বিষয়ের মতদ্বৈধতায় অর্য অনার্যের লড়াই বেশ দীর্ঘ সময় ধরে ভারতে অশান্তির বাতাবরন জিইয়ে রাখে। ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল দ্রাবিড় এবং তারা ধর্মীয় বিশ্বস্ততায় শৈবিক ছিল। শিব যেহেতু ভারত বংশোদ্ভূত বিধায় শিবকে আর্যরা দেবতা হিসাবে মান্য করে না। কারন বেদে শিবের কথা বলা নেয়। পরবর্তীতে অবশ্য বাস্তব চাহিদায় দ্রাবিড়ীয় শক্তিমত্তার চাপে পড়ে এবং তাদেরকে বর্নপ্রথার ক্ষত্রিয় পর্যায়ে রেখে তারা শিবকে তাদের দেবতা বলে মান্য করে। তবে আর্যরা এখানকার সমাজে মিশে না গেলেও এই মাটির মানুষের নাড়ি নক্ষত্র ঠিকই মেপে নিয়েছিল। তারা বিদ্যা বুদ্ধি ও চতুরতায় আদি ভারতীয় অর্থাৎ অনার্যদের চেয়ে উপরের ধাপে অবস্থান ক'রে বর্ণ প্রথার ব্রাহ্মন হিসাবে নিজেদেরকে ঘোষনা করে। সনাতন ধর্মেকে হিন্দু নামে সব্যস্ত করে শক্তিশালী দ্রাবিড়দের কাছের মানুষ প্রমানে তারা তাদেরকে দ্বিতীয় স্তরের ক্ষত্রিয় বর্নে সংজ্ঞায়িত করেন। এভাবেই বর্ন প্রথার স্তর ঘোষনা দিয়ে তারা ধর্মীয় বর্ণ প্রথার প্রচলন করে। আর এভাবেই হিন্দুকুশের বরপুত্র হয়ে হিন্দু নদ (সিন্ধু নদকে তারা হিন্দু নদ বলে উচ্চারন করতো) বিধৌত ভারত ভূমিকে তারা হিন্দুস্তান নাম দেয়। এবং তাদের প্রচলিত সনাতন ধর্মকে হিন্দু ধর্মের মোড়কে একাট্টা করে । ফলে জাতপাতের আর্য-অনার্যের ভারতে হিন্দু একটি সামাজিক প্রথা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পাশাপাশি বিত্ত, শক্তি ও জনবলকে কাজে লাগিয়ে ধর্ম প্রথার নব্য মোড়ল অর্থাৎ ব্রাহ্মন সেজে ওই আর্যরা ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ নির্মুলের যে মাস্টার প্লান করেছিল তাতেও তারা কামিয়াব হয়েছিল। ফলস্বরূপ আট শতক থেকে ধর্ম যাজক হিসাবে আগত আরব্য মুসলমান পীর ফকিরদের প্রচারিত ইসলামী সাম্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দের ছায়াতলে বৌদ্ধরা আশ্রয় নেয়। কথিত আছে ন্যাড়া মাথার বৌদ্ধরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়ার ফলেই আর্য ব্রাহ্মন্য সৃষ্ট 'ন্যেড়ে' কথাটি মুসলমানদের গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এখনো মুসলমানদের জন্য প্রচলিত গালি হিসাবেই এই ন্যেড়ে কথাটি হিন্দু ভারতে চিহ্নিত হয়ে আছে।
৫। বহু ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত এই ভারতবর্ষ বর্তমানে হিন্দু ইজমের দোলায় দোল খাচ্ছে। তারা তাদের ধর্ম বর্নের আদি ঐতিহ্যে কখনোই ঢুঁ মেরেছে বলে মনে হয়না। নইলে সেই ককেশীয় পর্বত মালার দক্ষিনের দেশগুলির এবং ইরানীয় ও এশিয়া মাইনরের বাঞ্জারান বা যাযাবর জাতিগোষ্ঠীর ব্রাহ্মন্য সনাতনী ধর্মকে সামনে এনে তারা কোন শক্তিবলে বলীয়ান হতে চায় তা বুঝে আসেনা।
কি মেধা থাকলে একজন বাঙালী কবি (যিনি বিশ্বকবিও বটে), তার ক্ষুরধার লেখনীতে গেয়ে উঠেন -
"হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/
শক-হুন-দল পাঠান-মোঘল এক দেহে হল লীন"।
আবার মিলনের অবগাহনে তাঁর কালির আঁচড়ে বেরিয়ে আসে -
"এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান /
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ এসো এসো খ্রীষ্টান/
এসো ব্রাহ্মন শুচি করে মন, হাত ধরো সবাকার/
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার"।
পাদটীকাঃ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় মূল ভূখন্ডে আর্য-অনার্যের আদি আহ্ববান ফিরে আসতে চাচ্ছে বলেই মনে হয়। এটার প্রয়োজন হয়তো পড়তো না। কিন্তু কেন্দ্র শাসনের সাম্প্রতিক মৌলবাদী আচরনে সাধারন ভারতবাসী আজ অতীষ্ঠ হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। নইলে জাত-পাত ও শক্তিমত্তায় সর্ব বলীয়ান হিন্দু প্রথার ভারতীয়রা আজ কেন ফের অশোকীয় ঐশর্য ও বুদ্ধদেবের অহিংসার বানীর দিকে সদলবলে ফিরতে চাচ্ছেন - সেটা নিয়ে ভাবতে হবে বৈকি!