জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাক্সবন্দী জয়রথে খেলাধুলা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:১২ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
অলোচনা ও সমালোচনা সমান তালে হওয়া উচিত। আমাদের এত এত বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন যে তাদের আলোচনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষনে আমরা ধন্য হয়ে যায়। তাছাড়া মিডিয়ার অসুস্থ্য বাহুল্যে বুদ্ধিজীবি ও পন্ডিতদেরও বাহুল্য চোখে পড়ার মত। শুনি দেখি। ভাল না লাগলেও ভাল লাগাই। বুড়ো বয়সে রাজনীতি সমাজনীতি বা শাসন ব্যবস্থার উচ্চাশার কচকচানি আর ভাল লাগে না। সংবাদ ইত্যাদির গ্লানিকর এবং একপক্ষীয় সালতামামী শুনতে শুনতে কানে পাক ধরেছে। কোন বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানাদি দেখতে গিয়ে চুলের শ্যাম্পু, টুথপেষ্ট আর ডাটা প্যাকের অফার দেখতে দেখতেই ঘুম চলে আসে।
ভেবেছিলাম পরিচ্ছন্ন পরিবেশে হয়তোবা খেলাধুলার লাইভ সম্প্রচার বা সেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনাগুলো দেখে মনটাকে একটু চাঙ্গা করবো। কিন্তু সে গুঁড়ে বালি। সেখানেও সলিম সাহেব এবং সল্ল্যাদের বিভাজন রেখার চিত্রগুলো স্পষ্ট। হয়ে যাওয়া খেলা বা অনুষ্ঠিতব্য খেলার বিচার বিশ্লেষনে বিশেষজ্ঞ বা সাংবাদিককুল যখন কথা বলেন তখন দেখা যায় তারা ক্ষমতাবান বা প্রতিষ্ঠিতের সমালোচনাগুলি স্বযত্নে এড়িয়ে যান। এবং উপস্থপকেরাও সে বিষয়ে হাই লাইট করেন না বা করতে সাহস পান না। এশিয়া কাপ ক্রিকেট নিয়েই হয়তো বলতে হবে। আমাদের এই আছে। ওই আছে। এই আছের মধ্যেই চৌকণা বাক্সের ভিতর আছড়ে পড়ে খাবি খাচ্ছে আমাদের খেলাধুলার শৌর্য বীর্যের কথকথা। মাঠে গেলেই বেলুনের মত ফুস হয়ে চুপসে যাচ্ছে আমাদের অহংকারের বিশ্বখ্যাত( ! )মাঠের রাজারা।
টাকার তো অভাব নেই। কোত্থেকে আসে এত টাকা! সেটা তারাই জানেন, যাদেরকে এই খেলাধুলার মাঠে যুগ পরম্পরায় দেখছি। 'দেখছি' কথাটি আপেক্ষিক হলেও একেবারে কি ফেলে দেয়া যায়? প্রানের খেলা ফুটবল আজ কোথায়? কোথায় ভলি, হকি, কাবাডি? তারা তো সরকারী বাৎসরিক অনুদানের কয়েক লক্ষ টাকার জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। সম্ভাবনার দুয়ার খুলেও জিমন্যাস্টিকের দরজাটা বার বার হোঁচট খাচ্ছে। শুনেছি ফুটবলের জন্য ফিফাও টাকা কড়ি দেয়। কিন্তু কি হয় সেসব টাকা দিয়ে শ্রদ্ধেয় সালাউদ্দিন ভাই বা সালাম মুর্শিদিরাই ভাল বলতে পারবেন। সবখানে চেয়ার দখলের লড়াই। প্রতিটি খেলার উঠানে চলছে রাজনীতির দাপুটে বিচরন। ফলে খেলা না হয়ে সেসব জায়গায় এখন চলে বিদেশ ভ্রমন আর বড় বড় পদবীর খোলসে অংশ গ্রহন করার হাস্যকর যতসব আয়োজন। কিন্তু আখেরে জাতিগত ভাবে আমাদের অর্জনের খেরোখাতা কোনপথে ধাবিত হচ্ছে তা কি আমরা ভেবেছি? কি দাপটই না ছিল আমাদের ফুটবলের সেসব দিনগুলিতে। ছোটবেলায় শুনেছি এশিয়া কাপ ফুটবলে ভারতীয় দাপটের কথা। বড় হয়ে সত্তর আশির দশকে দেখলাম আমাদের সালাউদ্দিন, নান্নু, হাফিজুদ্দিন, বাদল, কায়কোবাদ, মুন্নাদের বীরত্বগাঁথা। তারপর ওরা যখন একটু বড় হয়ে প্রশাসকের সারিতে এলেন বিপর্যয়টা তখনই মাথাচাড়া দিল। তারা ভাল প্রশাসক না হতে পারলেও রাজনীতির ঘোলাজলে ক্রীড়াঙ্গনে প্যারাসাইটিক অবজেক্ট হয়ে খুঁটি গেঁড়ে বসলো। আর সর্বনাশটা তখন থেকেই আমাদের খেলাধুলার মাঠে, খেলার উন্নয়নের উঠানে সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ বানিয়ে ক্যাসিনো, ওয়ান টেন, কাচ্চু হাইড্রো ইত্যাদির আদর্শ স্কুল বানিয়ে ফেললো।
গুটিকয় ক্রিকেটের পরিচিত ও ভালবাসার মুখ সমূহকে নিয়ে রাজনীতির উত্তরাধিকার হি-ম্যান সাহেব যা করছেন তা নিয়ে কথা বলতে গেলেও বিপত্তি। আর কিইবা বলা যায়। বললেই তো আবার "সংবিধিবদ্ধ" রোষানলে পড়ার আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। যাদেরকে পাশে রেখে তার বিশাল রোম্যান সাম্রাজ্য(সরি! ক্রিকেট সাম্রাজ্য), তাদের চলন বলন এবং মুখগুলো দেখলেই তো বুঝা যায় এদের কার্য দক্ষতার প্রকৃত রূপ। পদ ও পদবীধারী হয়েও মন ভরে না এদের। সার্বক্ষনিক পরিচালক হয়েও কখনও ম্যানেজার, কখনও দলনেতা, কখনও টিম ডিরেক্টর। আবার ক্রিকেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালক হয়েও লীগ খেলা বা টুর্ণামেন্ট খেলা দামী ক্লাবের কোচও বটে। কি আজব বসবাস আমাদের। বিশ্ব ক্রিকেটের প্রাথমিক পর্যায়ে যে বাঙালী স্পিনারের যাদুতে দুনিয়ার তাবড় ক্রিকেট শক্তি একটু হলেও মাথা ঘামাতো সেই জিঞ্জিরা পাড়ের প্রিয় মুখটি আজ অবহেলিত। টেল এন্ডার ব্যাটসম্যান হয়েও যার চার ছক্কায়, ট্যাগ লাগানো বোলাররাও দিশেহারা হোত - সেই ঢাকাইয়া বোলের রফিক আজ কোথায়? অথচ তার কাছে টিপস নেয়া একজন বিদেশীকে আজ আমাদের স্পিন কোচ হিসাবে দেখতে হয়। তাও আবার মাসিক কয়েক হাজার ডলারের বিদেশী মুদ্রার বিনিময়ে। জানিনা, মানুষটি জামাতের সদস্য কিনা! দলনেতা, টিম ডিরেক্টর, টিম ম্যানেজার, হেড কোচ, ব্যটিং বোলিং ফিল্ডিং সহ আরো কতসব বাহারী কোচের ছড়াছড়ি। হালে যোগ হয়েছে টেক কনসালটেন্ট। পয়সা উড়ানোর কি বাহারি আয়োজন!
একজন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার আমরা পেয়েছিলাম। চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। ডজন তিনেক ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, শ'দেড়েক প্রিন্ট মিডিয়া যেভাবে ঢোল করতাল নিয়ে তার স্তুতি বন্দনায় মেতে উঠলো তাতে করে আসমান ছোঁয়া সেই বাঙালী সন্তানটি অচিরেই মাটিতে পা ফেলার মরিচিকায় হোঁচট খাওয়া শুরু করে দিল। ফলে তার চলাফেরার কায়দাটাও একটু ব্রাহ্মনীয় আচরনের মত হয়ে গেল। এমনকি রাজনীতির ঢোক গিলা ক্রিকেট প্রশাসনও তাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দ্বিচারনীয় আচরনের আশ্রয়ে অবস্থান নেয়। আর হবেই বা না কেন? খেলার মাঠে অতুঙ্গ উচ্চতায় থাকা কোন খেলোয়াড় যখন মাঠ-ব্যাট-বল না ছেড়েও রাজনীতির মুকুট পরে পবিত্র সংসদে গিয়ে ক্লিন বোল্ড বা ছক্কা হাঁকানোর সুযোগ পান তখন কোন আক্কেলে একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এই ছকে বাঁধা ক্রিকেটের ব্যাকরনে থাকতে চাইবে? আগের কথা নাইবা বলি। আজকের চালচিত্রে কি দেখছি আমরা। মাসিক বেতনের কোটি ডলার ছাড়ানো সমস্ত কোচিং স্টাফ এমনকি সদ্য জন্ম নেয়া সর্বোচ্চ সম্মানিত টেক কনসালটেন্ট সাহেবরা যখন এই ভাদুই রোদের পিচগলা গরমে বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে বিশ্বকাপের স্বপ্নে মাথায় সুর্য নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন তখন সেই টিমেরই হাল ধরা অটো চয়েস ক্যাপ্টেন সাহেব টাকা কামানোর মিশনে কোন এক টুর্ণামেন্ট খেলতে টিম ছাড়া হয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। টিমকে গুছাবেন যিনি, যাদের দলনেতা হয়ে মাঠে হাল ধরবেন, তিনিই টিমের প্রশিক্ষন বা অনুশীলনে নেই। কি আজগুবি ও দৃষ্টিকটু ব্যাপার স্যাপার! মনে হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের এক পরিপুর্ন খ্যাতিমান জটায়ু। তার আবার ট্রেনিং কিসের! আর হীমন্যতা এবং অস্বস্তির উৎপত্তি তো এখানেই। তিনি খেলার মাঠের অনুশীলন ছেড়ে বিজ্ঞাপনের শুটিং করবেন, অনুমতি না নিয়ে দশ বিশ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা বৌ বাচ্চার কাছে চলে যাবেন, টিমের সাথে না থেকে সরাসরি খেলার মাঠে গিয়ে হাজির হবেন, বেটিং করবেন, আম্প্যায়ারকে গালিগালাজ করবেন, ক্রিকেট মাঠে স্টাম্প ভেঙ্গে ফেলে আম্প্যায়ারকে অসম্মান করবেন, দেশের খেলা থুয়ে টাকার জন্য বিদেশী লীগে খেলতে যাবেন - এহেন অযুত পরিমান দৃটিকটু অনিয়মে তিনি বিসিবি নিয়ন্ত্রিত কঠোর নিয়ম তান্ত্রিক এক দেশের অপরিহার্য কাপ্তান হয়ে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছেন। কি সৌভাগ্য আমাদের। একজন বিশ্বসেরা খ্যাতিমান খেলোয়াড় আছেন আমাদের। আর কি চাই। সেই খ্যাতির শিখরে থাকা খেলোয়াড় অলরাউন্ডারটি যখন এক ওভারে ২০-২২ রান দেন কিংবা একটি সদ্য দলে অভিষিক্ত হওয়া ছেলের প্রথম দুই ওভারে ৮-১০ রান দিয়ে প্রতিপক্ষের তিন উইকেট ফেলে দেয়ার জোশে গলিপথের ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় বাকী দুই ওভার করিয়ে টিমের বারোটা বাজিয়ে দেন তখন এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করার কেউ থাকে না। দেড় দশকের অভিজ্ঞ এক্স ক্যাপ্টেনের দিকে তার নজর পড়ে না বা নির্ভরতার প্রতীক ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের ছেলেটিকে তিনি দূরে সরিয়ে রেখে টিমের সর্বনাশের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন। অথচ এসব নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। কোন টিভি বিশ্লেষনে এসব কথা বলার বুকের পাটা কাউরি দেখি না। যদি টিভিতে আর না ডাকে। যদি ক্রিকেট প্রশাসনের বিরাগে পড়ি। এসব অনুমানের কথা। কিন্তু অসত্য কি?
জানিনা লিখতে গিয়ে একটু বেশীই বলছি কিনা। তবে সদ্য ময়ুর পুচ্ছ লাগানো কাকটি যখন ময়ুরারণ্যে প্রবেশ করবে তখন তার বাল্য-কৈশর-যৌবনকে তো সেভাবেই সাজাতে হবে! যার বাল্য নেই, কৈশরের কুঁড়ি ফোটার সৌরভ নেই তার যৌবনকাল তো এরকমই হবে। দেড় কুড়ি বছর আগেও আমাদের ক্রিকেটের ঝনঝনানি এতটা ছিল না। সাধারন মানুষ ক্রিকেট নিয়ে এত ভাবতোও না। খেলার জোশ বা রমরমা যাই বলি না কেন, সবটাতেই ফুটবলের দাপুটে বিচরন তখন। কিন্তু টাকা মিডিয়া এসে যেভাবে মানুষকে ক্রিকেট খাওয়ানো শুরু করলো তখন অবশিষ্টের জন সম্পৃক্ত খেলাগুলি পথেঘাটে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করলো। শুনতে লজ্জাই লাগে যখন আজকের বাস্তবতায় ক্রিকেট প্রশাসন অন্য পেরিফেরির খেলার উঠানে অনুদান দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। আর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নামক সরকারী প্রতিষ্ঠানটি আমলা নির্ভরতা নিয়ে হ্যারিকেনের বাতি জ্বালিয়ে প্রান্ত আগলে বসে আছে। না বলা কথাগুলি বলতে গিয়ে সেদিনের কৈশর পেরোনো সদ্য যৌবনে পা দেয়া ছেলেটির কথাগুলি বেশ মনে পড়ে। তিনি যখন অখন্ড পাকিস্তানের শেষ খেলাটির একমাত্র বাঙালী খেলোয়াড় হয়ে তার ব্যাটে "জয় বাংলা" স্টিকার লাগিয়ে মাঠে নামেন তখনকার সেই উদ্যম ও দেশপ্রেমের জোশ কি আমরা ভুলে গেছি! কোন্ দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে আজকের দিনে আমরা খেলাধুলার মাঠে এই আম বাঙালীর উঠানে সলিমুল্লাহদের সলিম সাহেব আর সল্ল্যার ব্যাকরনে উপস্থাপন করছি! কেন খেলার অঙ্গনে ক্যাসিনো সম্রাটদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গলদঘর্ম হতে হয়! কেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও জাতীয় পর্যায়ের সর্বক্ষেত্রে রাজনীতি ও পক্ষ বিপক্ষের লাইন টানা হয়! বাঙালীর অস্মিতার উচ্চাকাংখা নিয়ে এগুতে গেলে এসব নিয়ে ভাবতে হবে বৈকি!
পরিশেষে সদ্য প্রয়াত খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ চলচিত্রকার শ্রদ্ধেয় গাজী মাযহারুল আনোয়ারের একটি উপলব্ধি স্মরন করেতে চাই। খ্যাতিমান অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নুরের "বেলা অবেলা সারাবেলা" অনষ্ঠানটি দেশ টিভির একটি জনপ্রিয় সংযোজন। সেই অনুষ্ঠানের একটি এপিসোডে গাজী সাহেবকে নিয়ে আলোচনায় তাঁর মুখ দিয়ে এই কথাগুলি উচ্চারিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন "আমি কি, আমি কে এটা বড় কথা নয়। আমার দেশপ্রেম, আমার সৃষ্টি নিয়ে মানুষ কতটুকু সম্পৃক্ত হোল বা আনন্দিত হোল - সেটাই মুখ্য হওয়া জরুরী"। লক্ষ্য করেছিলাম, একজন শিল্পী হিসাবে সেই অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জামান নূর তাঁর সুরে সুর মিলিয়েছিলেন। উদাহারনটি প্রতিকী হলেও বাংলা ও বাঙালীর অর্জনের পুষ্টতায় পরিপুরক বটে।