জালাল উদ্দিন আহমেদ
একটি সংবেদনশীল আবেদন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩১ আগস্ট, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ১২:২০ এএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
বিষয়টি স্পর্শকাতরই বটে! তবুও এটা নিয়ে কিছু লেখা বা বলা দরকার বলে মনে করছি। আমি কোন ওয়াজ নসিহত বা ফতোয়ার কথা বলছি না। তবে ধর্মীয় বিষয়ই বটে। আবার লিখতেও ভয় পাচ্ছি। এটা নিয়ে যদি হুজুরী হুংকার শুরু হয়ে যায়! জানিনা কোন্ মধ্যযুগীয় আজিব বসবাস আমাদের। আর আশংকাটা কিন্তু এখান থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে। আমি কোন শামসুর রহমানও নই বা নই কোন তসলিমার মত বাতিকগ্রস্থ মানুষ। ইদানীংকার এক শ্রেনীর হুজুর ঘোষিত মুরতাদ কাফের বা নাস্তিক এর পর্যায়েও আমার অবস্থান নেই। তবে বলা যায় না তো! কোন্ দিক দিয়ে এক ফরমান জারি হয়ে গেল। আর মক্তব মাদরাসার হাজারো এতিম অসহায়দের নিয়ে লিল্লাহে তাকবির ধ্বনি দিয়ে আমার মস্তকের দাম ধার্য করে রাস্তাঘাটে তুল কালাম শুরু হয়ে গেল। আমি ধর্মভীরু অতি সাধারন একজন মানুষ। ধর্ম নিয়ে কথা বলার স্পর্ধাও আমার নেই। আমি ইসলাম ধর্মের অনুসারি একজন নাদান মুসলমান। কোন অভিযোগ নয়, মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছি মাত্র। এবং শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার আলোকেই আমার এই অভিব্যক্তি।
মনুষ্য জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ের আবর্তেই সীমাবদ্ধ। সেই হিসাবে জীবন চক্রের চতুর্থ বা শেষ ধাপেই আমার বর্তমান অবস্থান। গ্রামের ছেলে। ছোটবেলায় সকালের ঘুম ভাঙ্গতো বাবা মায়ের হাঁক ডাকে। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা থেকে উঠার সময় মোয়াজ্জিনের খালি গলার মিষ্টি আমেজের "আসসালা-তু খাইরুম মিনান্ নাউ-ম" শুনে মনটা পুলকিত হয়ে উঠতো। সে ষাটের দশকের কথা। তখন মাইকের ব্যবহার এত সহজলভ্য ছিল না। তারপর দিন বদলেছে। মসজিদে মাইক লেগেছে। ভোরের আযান এবং মাগরিবের আযানটাই সামষ্টিক মুসলিমের কাছে পরমাত্মার মত মধুর হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। কারন কোলাহল পুর্ন আজকের দিনগুলিতে অবসরের সেই ফজর ও মাগরিবের সময়টুকু মানুষজন কিছুটা হলেও একটু নিজের করে নিতে পারে। এই আযান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মধুর এক সুললিত আহ্বানের আওয়াজ। এর প্রতিটি বাক্য মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে আহ্বানের এক মোহনীয় বার্তা। মোটা দাগে আযান কথাটার অর্থ হচ্ছে ডাক বা আহ্বান। প্রতিটি মুসলমান মসজিদ থেকে ধ্বনিত এই আযানের অর্থাৎ আল্লাহর ডাকের উত্তর দেন গুনে গুনে। এবং পরবর্তীতে নামাজ বা সালাত আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়। এটা আল্লাহর বিধান। এই নিয়মানুবর্তিতার ডাক প্রত্যহ পাঁচ বার করে মসজিদ থেকে পালন করা হয়। সুতরাং আযানের সুমিষ্ট আহ্বান স্পষ্ট উচ্চারনে শোনা এবং তার উত্তর দেয়ার সুনির্দিষ্ট বিধান ইসলামে বিধিবদ্ধ বলেই আমরা আমজনতা মনে প্রানে বিশ্বাস এবং তা ধারন করি।
আসি ঢাকার কথায়। ঢাকা একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। শুধু দেশীয় আঙ্গিকে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ঢাকার একটা অবস্থানগত দিক রয়েছে। সুতরাং ঢাকাকে সুন্দর সুষ্ঠ এবং পরিমার্জিত আঙ্গিকে উপস্থাপন করার দায়িত্ব যেমন সরকারী পর্যায়ে পড়ে, পাশাপাশি এই ঢাকার বাসযোগ্য আবেদনময়তা ফুটিয়ে তোলার মহান দায়িত্ব এখানে বসবাসকারী নাগরিক সমাজের মধ্যেও বর্তায়। নাগরিক সভ্যতার বিচার্যে আনলে অনেক স্বল্পতা বা অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশে হয়তো এখনো আমরা যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছি। তথাপি আমরা বর্তমানের ঢাকার নাগরিক সমাজের(civil society)অতল চাহিদায় নিজেদের অবচেতন মনে অনেক অযাচিত অনুসঙ্গের মিশেলে মানবেতর জীবনের করালে নিজেরাই আবদ্ধ হচ্ছি। ফলে ন্যুনতম নাগরিক জীবনের(civic life)অস্তিত্ব সংকটে আজ আমরা হর হামেশা খাবি খাচ্ছি। অপরিকল্পিত নগরায়নের কথা নাইবা বলি। নাইবা বলি সরকারী যন্ত্রে পরিচালিত বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সমূহের অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কথা। কিংবা সরকারী বিভিন্ন পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নয় ছয়ের হতাশাজনক অথচ মুখরোচক গল্প কাহিনী। আর অসাধু দুর্নীতি গ্রস্থ সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন যন্ত্রের দাপটের রোজনামচা তো আমাদের নিত্য দিনের ঘটনা। আইন ও শৃংখলার কথা যদি বলেন তাহলে সেখানেও একগুচ্ছ হতাশা ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে করার কোন কারন নেই। আর রাজনীতি? সেতো এক ফনা তোলা ভয়ঙ্কর গোক্ষুর। সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, জন সেবার অতুঙ্গ বাসনা যেন আজ রাজনীতির উঠান থেকে নির্বাসিত। প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত ডাকসাইটে আমলা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সম্মানিত শিক্ষক, পেশাজীবি মাথাওয়ালা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা লেফট রাইটের উচ্চাভিলাষী বড়বাবুরা আজ কর্মজীবন শেষ করে তাদের হাই প্রফাইলের ভারিক্কি নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে এমপি, মন্ত্রী। ফলে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলার আদর্শে বাল্যকাল হতে অনুশীলন করে আসা এবং কাদা মাটি মানুষের সঙ্গে মিশে দেশের হতদরিদ্র জনপদকে স্বপ্ন দেখানো রাজনীতিকরা আজ সাইড বেঞ্চের কুশীলবের ভূমিকায় অমুক ভাই তমুক ভাই হয়েই অপাংতেয় হচ্ছেন। ফলস্বরূপ দেশের রাজনীতির আবেদন আজ ধংসস্তুপের ফসিল হয়ে সমাজ সংসার ও রাষ্ট্রে নিজের ফোকলা দাঁতের হাসি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছেনা আমাদের এই বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায়।
যে শুদ্ধতা ও সংবেদনশীলতার স্বচ্ছতায় আবহমান কালের দীপ্র ঘোষনায় মুসলমান নামের ইসলামিক শিক্ষা ও শপথের অহংকারে আমরা আজ উদ্ভাসিত উচ্ছ্বসিত, সেই ইসলামিক আচার আচরনে আমাদের সতর্ক থাকা বাঞ্চনীয়। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই দাপটের যুগে আজ নেট দুনিয়ায় ইসলামী মৌলভী মাওলানাদের বারোয়ারী দাপট। আর তাদের একই বিষয়ের উপর ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের বয়ানে সহজ সরল আম জনতা আজ দিকভ্রান্ত। বারোয়ারী কথাটি শ্রুতিকটু শোনালেও এর চেয়ে ভাল উচ্চারন কি হতে পারে তা আমার বোধে আসছে না। প্রসঙ্গটি আযানের। তাই ওটাকে নিয়েই না হয় বলার চেষ্টা করি। আগেই বলেছি আযান অর্থ ডাক। এবং মহান স্রষ্টার তরফ থেকে নামাজ বা ইবাদতের ডাক। সুতরাং এই ডাক বা আহ্বানের প্রতিটি শব্দ যেমন শোনা জরুরী তেমনি তার প্রতিটি আহ্বানের জবাব দেয়াটাও জরুরী। বিধির বিধান তাই বলে। যে কথাটি বলার জন্য এত আয়োজন এন্তেজাম নিয়ে আমি কলম চালাচ্ছি তা কিন্তু খুব সামান্য একটি নাগরিক চাহিদার কথা। আজকাল লক্ষ্য করা যায় মসজিদে হাই ভলিয়্যুমের লম্বা চোঙ্গাওয়ালা মাইকগুলো লাগানো হয়। শুধু কি তাই, মসজিদের উঁচু মিনারে চতুর্মুখী করে চারটি মাইক লাগানো হয়। ভাল কথা। কিন্তু তার আওয়াজের শব্দভেদ কতটুকু প্রসারিত তা কি আমরা জানি? সম্ভবতঃ এটা নিয়ে আমরা কোন চিন্তা ভাবনা করিনি। তাছাড়া ঢাকা শহরে মসজিদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সেটা যে জনসংখ্যা গুরুত্বে মানানসই তা মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা নেই। তবে ২০১৬ তে যখন ঢাকা সিটির পরিধি বাড়ানো হয়, তার চালচিত্রে দেখা যায় ১২৯ বর্গ কিমির ঢাকা ২৭০ বর্গ কিমিতে রূপান্তরিত হোল। এর ফলে দেড় কোটি লোক সংখ্যার তৎসময়ের ঢাকায় মাত্র দশ লক্ষ লোক যুক্ত হোল। ফলে ঘোষিত সিটির জন ঘনত্ব একলাফে অর্ধেকের নীচে চলে এল। তবে ২০১৬ এর তৎসময়ের ১২৯ বর্গ কিমির ঢাকায় সে সময়ের হিসাবে দেখা যায় ঢাকায় মসজিদ ছিল প্রায় ছয় হাজারের মত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভাষ্যমতে যদি ঢাকায় ১০,০০০ মসজিদ হয় তবে নতুন আয়তনের ঢাকা সিটির অর্থাৎ ২৭০ বর্গ কিমির ঢাকায় মসজিদের অনুপাত হয় প্রতি বর্গ কিমিতে প্রায় ২৭ টি। তা হোক। তাতেও আপত্তি নেই। ইসলামের প্রসার ও প্রচারে দরকার হলে আরো মসজিদ নির্মান হোক। মানুষজন স্বাচ্ছন্দে তাদের এবাদত বন্দেগী করুক। আমার কথা বলার উদ্দেশ্য তা নয়। যেটা নিয়ে আমার এবং ঘরের বৌ বেটি ও বয়ঃবৃদ্ধ মুরুব্বীদের প্রশ্ন তা হোল আযানের ধ্বনি এবং তার শ্রবন গ্রাহ্যতা নিয়ে। অর্থাৎ ধরুন মাগরিবের আযান শুরু হোল। সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় যদি স্টান্ডার্ড সময় হয়, তো দেখা গেল তার দশ মিনিট আগেই কয়েকটি মসজিদ থেকে আযান দেয়া শুরু হোল। এটা নাকি আহলে হাদিসী মসজিদের আযান! তাও সেটা এক থেকে তিন মিনিটের ব্যবধানে চারিদিক হতে ধ্বনিত হওয়া শুরু হচ্ছে। আবার যথা সময়ের আযান অর্থাৎ সাড়ে ছয়টার আযান এক মসজিদ শুরু করলো তো তিরিশ সেকেন্ড পরে আরেকটি। এভাবেই সেই আযান গুলির বহুমুখী শব্দ দূষনেই আমরা আচ্ছন্ন থাকলাম। কোন শব্দ বা বাক্য স্পষ্টভাবে শুনতেও পারলাম না আবার জবাব দেয়ার যে রেওয়াজ সেটাতেও বঞ্চিত হলাম। তাছাড়া জনবহুল ঢাকায় এখন সাততলা ও তদুর্ধ উচ্চ ইট পাথরের বাড়ি ঘরের মাইকের আওয়াজে যে ইকো বা ভাইব্রেশন হয় তাতে আযান কেন, কোন ঘোষনাই স্পষ্ট উচ্চারনে কানে আসে না। ফলে এক'শ মিটার দূরের প্রতিবেশীর মৃত্য সংবাদ সম্বলিত ঘোষনা যখন মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় তখন একজন সৎ প্রতিবেশী হিসাবে আমি বা আমরা প্রায়শঃ ক্ষেত্রেই তা জানতে পারি না।
তো, সমস্যাটা এখানেই। কোন বিদ্বেষ বা বিরুদ্ধবাদের কথা নয় এটি। একজন সচেতন নাগরিকের, কিংবা বলা যায় একজন ধর্মভীরু মুসলমানের না বলতে পারা আবেদন। তাছাড়া আধুনিক এই বিশ্বময়তার যুগে বায়ু দূষন, শব্দ দূষন ও জলবায়ু ও পরিবেশ দূষনের যে কথাবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে সেখানে আমরা মুসলমানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মের ধারক হয়ে কেন এসব শব্দ দূষনের চক্রে পড়বো! সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে আযানের সুললিত ডাক বা আহ্বানকে আমরা অনায়াসেই একমুখী করে নাগরিক জীবনে একটি সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে পারি। সেক্ষেত্রে ঢাকায় কেন্দ্রীয় ভিত্তিক না হলেও ওয়ার্ড ভিত্তিক কেন্দ্রীয় সঞ্চালন ব্যবস্থা চালু করে এর সুষ্ঠতা আনার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। ফলে শব্দ দূষনের বিড়ম্বনা থেকে রেহাইয়ের পাশাপাশি ইসলামের স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠতা জন জীবনে স্বস্তি এনে দেবে। আমি আশাবাদী, ঢাকার প্রশাসন এবং আলেম সমাজ তথা বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন বিষয়টি পজেটিভ হিসাবে গ্রহন করবেন। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইসলামী সৌষ্ঠব ও তার আধুনিক মনস্কতা প্রচারের পাশাপাশি এই কর্মধারা একটি ঐতিহাসিক মাইল ফলক হিসাবে সমাদৃত হবে।