জালাল উদ্দিন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধঃ খন্ডিত চেতনা-শেষ পর্ব
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ আগস্ট,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১২:১৮ এএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
এহেন পরিস্থিতিতে রাজনীতির কলুষিত বার্তাগুলি জনমনে দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে পড়ছে। হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ নিজের অস্তিত্ত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠাবে। রাজনীতির কুটচাল এবং নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার হীনমন্যতায় গুটিকয় রাজনীতর স্বার্থান্বেষী মানুষ এভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করতে পারে না। এক সময় রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য যে সব মানুষ ঐসব স্বাধীনতা বিরোধী ও খন্ডিত চেতনার ক্ষমতাবানদের মুখাপেক্ষী ছিল তারাই আজ বেশী বেশী করে এই বিভাজনের রাজনীতি তৈরীতে সচেষ্ট রয়েছেন বলে মনে না করার কোন কারন নেই। তাছাড়া পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের কতিপয় আমলা সমন্বয়ে গঠিত একটি বলয় যেভাবে গনতন্ত্রের মানস কন্যা ও তার পরিপাশকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছেন, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারন রয়েছে যে, গনতন্ত্রের মূল চেতনাকে উপড়ে ফেলে তারা আবার সেই পঁচাত্তরের পঁচিশে জানুয়ারীর ফরমানের পুনঃ তপশিলী করনের জন্য তৈরী হচ্ছেন।
হতে পারে রাজনীতির ঘুঁটির চালে তাদের অর্থাৎ খন্ডিত চেতনার পক্ষটির ভুল হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু তারা কখনোই স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি নয়। তারা মহান নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে সম্মুখ সমরে মুক্তিযুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছেন। অধিক উদারতায় তাদের মূল চেতনায় খন্ডিত ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এজন্যই তো তারা খন্ডিত চেতনার দল। বাংলার মানুষ সে হিসেবটা ভাল করেই জেনেছে। আমাদের সকলের উচিত মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় স্থির থেকে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা। যারা ভুল করেছে বা করছে তাদেরকে চেতনার সরল রেখায় সামিল করার কাজে হাত লাগাতে হবে। শক্তি দিয়ে নয়, রক্ত ঝরিয়েও নয়। ভালবাসা দিয়ে নিজেদের অখন্ড চেতনাকে সর্বজন গ্রাহ্য করে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই একাত্মতা তৈরী করতে হবে। যে চেতনার যাদু স্পর্শে সমগ্র বাঙালী জাতি একটা শ্লোগানে উদবুদ্ধ হয়ে গগন বিদীর্ন করে একদিন বাংলার মাটিকে ধন্য করেছিল আজ সেই শ্লোগানে একাত্ম হয়ে বাঙালীর কাঁধে কাঁধ মিলাতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর, মুক্তিযুদ্ধ বাংলার। এখানে স্বপক্ষ বিপক্ষের কথা থাকাটাই অপ্রাসঙ্গিক। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা লাভের অস্ত্র হিসাবে স্বপক্ষ বিপক্ষের বেড়াজালে বাঙালীকে বিভাজন করলে আখেরে ওদেরই জয় হবে; যারা একাত্তরে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধে পরাজিত হয়েছিল।
বাঙালী আজন্ম স্বাধীনচেতা জাতি। এটা ইতিহাসের কথা। কিন্তু সেই বাঙালীর ঘরে উঁমিচাঁদ, রাজবল্লভ বা মীর জাফররাও ছিল। যেমন আমাদের মহান একাত্তরে গোলাম আজম নিজামী সাকারাও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক দল যদি মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্ত্বের অহংবোধের স্বেচ্ছাচারিরায় দেশ শাসনের ছড়ি হাতে নেয় এবং রাজনীতির প্রতিপক্ষকে অবহেলা ও তাচ্ছিল্যে জেরবার করে তাহলে পরিনতি অনুকুলে থাকে না এবং সুযোগ বুঝে ইতিহাসের খল নায়ক ওই মীর জাফররা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তার সাক্ষ্য তো ইতিহাসই বলে দেয়।
এক্ষেত্রে আমাদের সকলের উচিত মুক্তিযুদ্ধকে স্বপক্ষ বিপক্ষে না নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের জন্য একযোগে কাজ করা। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদশ সৃষ্টিতে যার যেখানে অবস্থান তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করে তার অবস্থান সেখানেই স্থির করে দিয়ে রাষ্ট্রীভাবে তা লালন করা। তাছাড়া একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের কৃতকর্মের যথাযত শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এই উদ্যোগ হতে হবে সমগ্র বাঙালী জাতির একাত্মতার নিরিখে। মনে রাখা প্রয়োজন জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে একাত্তরে সৃষ্ট ওই বিষ ফোঁড়কে বাংলার মাটি থেকে সমূলে উৎপাটন করা একান্ত জরুরী। কেননা একাত্তরের মানবতা বিরোধীদের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে লুকিয়ে আছে তিরিশ লক্ষ শহীদ ও দু'লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানির প্রকৃত মর্যাদা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইতিহাসকে আমরা যতই ক্ষমা করি, ইতিহাস কিন্তু আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। তার ফল আমরা মহান নেতা ও কতিপয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকাল প্রয়ানের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ভোগ করছি। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী হয়ে গেল অথচ আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এখনো সংশয়ের দোলাচালে দিন কাটাচ্ছি। তাদেরকে কষ্টি পাথরে ঘষে একটি সম্মানিত স্থানে এখনো দাঁড় করাতে পারি নি। পাশাপাশি মাত্র গুটিকয় স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করে হাতে গোনা কয়েকজনকে শাস্তি দিতে পেরেছি। এটা বাঙালী জাতি হিসাবে আমাদের দৈনতা বৈ আর কি হতে পারে!
সুতরাং চেতনাকে পক্ষ-বিপক্ষের কিংবা অখন্ড-খন্ডিতের বিবেচনায় না নিয়ে বাঙালীয়ানার মূল চেতনার ভিতকে মেরামত ও মজবুত করার ব্রতে একযোগে কাজ করার শপথ গ্রহন করতে হবে। বাঙালীয়ানার শাশ্বত ঐতিহ্যকে সমুন্নত করতে হলে নিজেকে বাঙালী হতে হবে সর্বাগ্রে। বাংলাকে ভালবাসতে হবে। বাংলার বাঙালীকে ভালবাসতে জানতে হবে। বাংলার ভীতকে মজবুত করার লক্ষ্যে এর সমগ্রতায় বাঙালীয়ানার ছোঁয়া লাগাতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ একটি অখন্ড চেতনা। এই চেতনার ফসল হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে মেহনতি বাঙালীর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সোনার বাংলা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্র সেনানী জিয়াউর রহমানের প্রথম বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সম্মানিত সেনাপতি এমএজি ওসমানী এবং মুক্তিযুদ্ধ কালীন সরকারের ফিল্ড মার্শাল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে ভুলি কেমন করে?