জালাল উদ্দিন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধঃ খন্ডিত চেতনা(৮)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ আগস্ট,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:১০ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
পুর্ব প্রকাশের পর……
(৮)
ইতিহাসের সরল পথে ঘোষনা পাঠের মহান মুক্তিযোদ্ধার নির্মম প্রয়ানে দেশে ক্ষনকালের গনতান্ত্রিক চর্চা বজায় থাকলেও ব্যারাক থেকে আর এক জেনারেলের আবির্ভাব হয়। তবে শ্রুতি আছে, তিনি আবির্ভূত হন নি। তিনি তার আসার পথ তৈরী করেই সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অবশ্য ঘোষনা পাঠের মেজরের বেলাতেও অনেকে এধরনের উক্তি উচ্চারন করেন। এবার যিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন তিনি আবার আগের জনের থেকে এক কাঠি উপরে। তিনি ধর্মকে সংবিধানে জুড়ে দিলেন। তিনি "নতুন বাংলাদেশ" গড়ার চমক দিয়ে মাঠে নামলেন। দেশের সাধারন মানুষ এক সময় বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল চেতনাকে ভুলে যেতে বসলো। ঘোষনা পাঠের জেনারেলের ছয় বছরে মানুষ একটা স্বস্তি ও স্থিতির মধ্যে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়ে এগোতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান ফেরত (রিপার্টেড) জেনারেলের নয় বছরের শাসনকালে বাংলার মানুষ ধর্মীয় সুড়সুড়ি আর পাকিস্তানী ঘরানার চাকচিক্যে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। তবে চলার পথে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সোনার বাংলা গড়ার প্ল্যাটফরমটির দায়িত্ব নিয়ে সাধারন মানুষের মনে আশার সঞ্চার ঘটান। ওদিকে স্বাধীনতা ঘোষনায় সম্পৃক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার বিধবা জায়া বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশী ওয়ালাদের তাঁবুর দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামেন। তাদের যুগপৎ আন্দোলনে সাধারন মানুষের সম্পৃক্ততা আশার সঞ্চার করে।
অখন্ড ও খন্ডিত চেতনার (৬) এই দুই শিবিরে আবর্তিত হতে শুরু করে বাঙালীর রাজনীতির মেরুকরন। এই সুযোগে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সুযোগ পাওয়া রাজনীতির দুষ্ট প্ল্যাটফরমগুলো (যারা মূলতঃ পাকিস্তানী প্রেতাত্মার ঘাড়ে চড়ে ধর্মকে তাদের মূল হাতিয়ার করে মাঠে নেমেছিল) রাজনীতির মাঠে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়। তাদের এই সরবতার জীয়ন কাঠি ছিল মূলতঃ পাকিস্তানী রাজনীতির দৈউলিয়াপানা ও আরব বিশ্বের কতিপয় মুসলিম দেশের ইন্ধন। অর্থাৎ দেশে সেসময়
রাজনীতির তিনটি ধারা প্রকাশ্য রাজপথে থেকে শৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুগপৎ কাজ করে যাচ্ছিল। তবে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং বাংলার বুকে নিজেদের রাজ কায়েম করার মানসে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী কিছু ডাকসাইটে নেতা খন্ডিত চেতনার শিবিরে এবং লেজেহোমোর নতুন বাংলাদেশ গড়ার তাঁবুতে ভিড়ে যায়। এমনকি অখন্ড চেতনার বড় বড় মামুরাও পোষ্টিং ও পদবী নিয়ে ততদিনে খন্ডিত চেতনা ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার শিবিরে নিজেদেরকে থিতু করে ফেলেছেন। দেশের বাম ঘরানার দলগুলি রাজপথ ও মাঠ ঘাট করতে করতে ততদিনে হাঁপিয়ে উঠেছে। তারাও যার যার সুবিধামত দল ভেঙ্গে দল গড়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাদের আদর্শিক জায়গায় না থেকে ক্ষমতার পিছু নিয়ে ব্যক্তি ইমেজ নষ্টের পাশাপাশি নিজ দলেরও সর্বনাশ করেছেন। তাদের এই মেরুদন্ডহীন চলনে দেশীয় রাজনীতির স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তা অনেকাংশেই ক্ষুন্ন হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা বলাবলি করেন।
দেশের রাজনীতির এই বারোয়ারী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কন্যা নিজ বিচক্ষনতায় পিতা সৃষ্ঠ দেশের প্রাচীন সংগঠনটির কাঠামো বিন্যাসে মনোযোগী হন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ দলটি আবার তার স্বমহিমায় ফিরে আসতে শুরু করে। ওদিকে খন্ডিত চেতনার ফ্রন্টলাইনার মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি বেগম খালদা জিয়ার নেতৃত্বে সাধারন মানুষের সহানুভূতি নিয়ে দুর্বার গতিতে এগোতে থাকে। আন্দোলনে মূলতঃ দুটি পক্ষ থাকলেও ধর্মীয় আমেজের পাকিস্তানী প্রেতাত্মার দলটি ততদিনে নিজেদের শিরদাঁড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখেছে। লেজেহোমোর গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ছিয়াশির নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের সাথে সংসদ নির্বাচনের সুযোগ নিয়েছে। জাতীয় সংসদে দেশ বিরোধীদের সদম্ভ অনুপ্রবেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সৃষ্ট বাংলাদেশে ততদিনে পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের গরল নিঃশ্বাসে ক্ষত বিক্ষত হওয়া শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা ক্ষমতার দন্ডে দর কষাকষির পর্যায়ে অবস্থান তৈরী করে ফেলেছে। দেশের রাজনীতির উঠানে তারা একটি সমীহ করা পক্ষ হিসাবে নিজেদের অবস্থান তৈরী করে তাদের পায়ের মাটি শক্ত করে নিয়েছে। রাজনীতির মঞ্চে তারা অখন্ড ও খন্ডিত চেতনার দুই মহা পরাক্রমশালী রাজনীতির সমান্তরালে থেকে মাঠে নিজেদের অস্তিত্ত্বের জানান দিয়েছে। তাদের অস্তিত্ত্বের মূল আঁতুড় ঘরই হোল ধর্মভীরু সাধারন মুসলমান বাঙালী। তৃণমূলকে শক্তিশালী করার সেই কাজটি তারা বেশ ভালভাবে গোছাতে পেরেছিল বলেই আমজনতার মদদপুষ্ট দৃশ্যমান দুটি রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ এ ও বি তাদের সমীহ করেই চলেছে। এহেন রাজনৈতিক সমীকরনে তিনটি ক্ষমতাধর রাজনীতির প্ল্যাটফরমে তিনটি জোট সমন্বয়ে মিলিটারি অটোক্র্যাট শৈর শাসক এরশাদের পতন আন্দোলন অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যুগপৎ ভাবে রাজনীতির পাশে তাদের যুব শক্তির মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। সময়ের দাবিতে একসময় শৈরশাসনের পতন ঘটে।
(৬) চেতনা বলতে এখানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার কথা বলা হয়ে থাকে। বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার এই চার মূল নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে এক সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পক্ষ বিপক্ষ শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অখন্ড চেতনার মূল দাবিদার আওয়ামী লীগ তাদের ঐতিহ্যের পরম্পরায় রাষ্ট্রীয় এই চার নীরির মূল ধারক হিসাবে নিজেদেরকে উপস্থাপনে উচ্চকন্ঠ রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত অন্য দল বিএনপি তাদের উদারনৈতিক চিন্তাধারায় বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সবাইকে নিয়ে চলার নীতিতে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। ফলে খন্ডিত চেতনার ধারক হিসাবে তারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুটি পক্ষ নিয়ে আবর্তিত। প্রথম পক্ষ হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন অখন্ড চেতনার পক্ষ। অপর পক্ষ হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন খন্ডিত চেতনার পক্ষ। বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এই পক্ষ-বিপক্ষ মেরুকরনেই আবর্তিত। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন রাজনীতি সৃষ্ট অখন্ড ও খন্ডিত চেতনার ধুম্রজালে ঘুরপাক খাচ্ছে।
( চলমান...................)