জালাল উদ্দিন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধঃ খন্ডিত চেতনা(৬)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ জুলাই,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:২৭ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
পুর্ব প্রকাশের পর……..
৬
তিরিশ লক্ষ বাঙালীর প্রান বিসর্জন এবং দু'লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক অপরিপক্কতা দৃশ্যমান হতে থাকে। সে সময় রাজনীতি ও প্রশাসনের ভিন্নধর্মিতায় দেশে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ফলে তরুন-যুবা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ সদ্য স্বাধীন দেশে তাদের স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কোন মিল খুঁজে না পাওয়ায় চলমান শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। অখন্ড চেতনার ছাত্র ও যুব সংগঠনের একটি অংশ সে সময় নতুন এক সংগঠনের ব্যানারে নিজেদেরকে(সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে)উপস্থাপনে প্রকাশ্য হয়। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় বাংলার মানুষ কঠিন এক দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে। চারিদিকে আশান্ত পরিবেশ এবং রাজনৈতিক বিশৃংখলা (৪) সামাল দিতে তৎসময়ের সরকার হিমশিম খেতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় "একদেশ-একনেতা-একদল" সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশের সমস্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় একমাত্র রাজনৈতিক হল হিসাবে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন করা হয়। সাধারন মানুষ রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরচালনার এসব কর্ম ধারায় নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। দেশে এক্ষেত্রে থমথমে অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
যে রাজনীতির অগ্নিমন্ত্রে উদবুদ্ধ হয়ে বাংলার অপামর বাঙালী মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেছিল সেই রাজনীতির প্রতি সাধারন মানুষের মন উঠে যায়। এই সুযোগে সেদিনের সেই মেজরের ঘোষনা পাঠকে পুঁজি করে এক শ্রেনীর বুদ্ধিজীবি সমন্বয়ে বাঙালীর চেতনা বিরোধী পাকিস্তান পন্থীরা তাদের ভবিষ্যতের স্বরলিপি প্রনয়নে ফন্দি আঁটতে থাকেন। বাকশালীয় দামামায় দেশে তখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। হঠাৎ বাঙালীর মাথায় বাজ পড়ে। সেই বাজের আঘাতে বাঙালীর স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। যে স্বপ্ন যাত্রায় তারা হাজার বছর অপেক্ষা করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে নিজের আপন উঠান তৈরী ক'রে সবেমাত্র স্বপ্নসিঁড়ি গাঁথতে শুরু করেছে, সেই অলুক্ষনে আগষ্টেই তাদের প্রিয় নেতাকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করা হোল। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ১৯৪৭ এর আগষ্টের রক্তে লেখা ইতিহাসকে আরো রক্তাক্ত ক'রে বাঙালীকে এতিম করে দেয়া হোল। বঙ্গবন্ধুর বিস্বস্ত সহচর ও তৎসময়ের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য খন্দকার মুস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। ইসলামী ভাবধারা ও আমেরিকা পন্থি এই আওয়ামী লীগ নেতা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে সে সময় দেশের জনকের হত্যাকারী সেই সকল বিপথগামী সেনা সদস্যদের তার শাসন আমলেই বিদেশে নিরাপদে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। শুধু এতেই ক্ষান্ত হননি "মোস্তাক সরকার"। ঐসকল হত্যাকারীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে চাকরীর ব্যবস্থা করেন। এখানে "মোস্তাক সরকার" কথাটি স্পষ্টীকরন করা হোল এই কারনে যে ভারত বিদ্বেষী এবং আমেরিকা পন্থি আওয়ামী ঘরানার এই গ্রুপের মদতে ততদিনে ঘাপটি মারা পাকিস্তান ঘেঁষা আমলা ও বুদ্ধিজীবিরা তাদের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেতে শুরু করেছে।
(৪) এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশৃংখলা কথাটি যথাযত কিনা তা বলা মুস্কিল। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে দেখা গেছে এখানে রাজনীতি বলতে শুধু এবং শুধুই আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয় পক্ষ কেউ মুক্তমনে দেশের কল্যানে রাজনীতি করুক তা যেন আওয়ামী লীগারদের কাছে গাত্রদাহের সমতুল্য ছিল। তারা মনে করেছে এবং এখনো মনে করে যে তারাই তো আছে, এদেশের ভালমন্দ সবকিছু দেখার জন্য। তারাই তো দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে! সুতরাং বিপক্ষ কেন? আর্থাৎ রাজনীতির পরমত সহিষ্ণুতা নামক এই সুন্দর কথাটি আওয়ামী রাজনীতির প্রায়োগিক উঠানে কোনদিন ছিল না এবং এখনো আছে বলে মনে হয়না। সেক্ষেত্রে আওয়ামী উঠানের ছাত্র সংগঠনের একটি অংশ যখন জাসদ নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন ক'রে দেশের ও দশের কথা বলতে এগিয়ে এল, তখন স্বাধীনতার ঊষলগ্নের সরকার তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে বিনাশ করার কাজে মনোনিবেশ করে। এই বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য সরকার রক্ষীবাহিনী নামক এক দুর্ধষ্য বাহিনী গঠন করেন। শোনা যায় রক্ষী বাহিনী নামক এই বর্বর বাহিনী স্বল্পকালীন ওই সরকারের সময়ে বিরোধী দমনের অপ তৎপরতায় বিশ হাজারের মত তরুন যুবাকে হত্যা করেছিল। বাংলার এমন কোন গ্রাম ছিলনা যেখানে সন্তান হারানোর আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়নি। এটা ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। ইতিহাস তার আপন পথেই চলে।
( চলমান….………..)