জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাঙালীর হিন্দু মুসলমান(২)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ জুলাই,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৫১ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
পুর্ব প্রকাশের পর……..
হিন্দুস্তানের হিন্দু হওয়ার যে সুপ্ত বাসনায় নিজের জাতিগত ঐতিহ্যকে জ্বলাঞ্জলি দিয়ে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর পুর্ব পুরুষেরা বাংলা ভাগে ধর্ম ভিত্তিক প্রশ্নটা সামনে এনেছিলেন, তার ছিটেফোঁটা নমুনা কি ওই পশ্চিম বঙ্গীয় ভূখন্ডে এখন পাওয়া যাবে! সামাজিক আচার আচরনে বাঙালীয়ানার আদি আবাহন কি এখনকার হিন্দু অধ্যুষিত বাংলায় আছে! আর অধিকার এবং নিজস্ব স্বকীয়তার কথা যদি বলেন, তাহলে কোন্ প্যারামিটারে ফেলে আজকের হিন্দুপ্রধান ঐ বাংলা বিরাজ করছে তা কি বলা যাবে! ধর্ম চেতনার যে ডংকা বাজিয়ে হিন্দু নেতৃত্বের পুর্বসুরীরা একটি জাতিকে দ্বিখন্ডিত করলেন বা করালেন কিংবা হতে দিলেন, তারা কেন এখনো মুসলমান বাঙালীদেরকে নিয়ে মাঠেঘাটে দৌঁড়ঝাপ করছেন। হয়তো বলা হবে, বাঙালী মুসলমানেরাও তো পাকিস্তান আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্নে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন হয়। পক্ষান্তরে হিন্দু মুসলিম ইস্যু না তুলে বৃহত্তর বাঙালী অখন্ডতায় সেদিন যদি বাংলাকে সামনে আনা হোত, তাহলে হয়তোবা সেই সাতচল্লিশেই স্বাধীন বাংলার পতাকা আমরা উড়াতে পারতাম। সুতরাং ভাবতে অসুবিধা কোথায়, বাংলাকে ভাগ করে হিন্দুস্তানী বাঙালী হয়ে বেঁচে থাকার যাত্রাটাই ভুল হেমিলিয়নের বাঁশির সুরে হয়েছিল। হয়তো স্বামীজি, বঙ্কিম, জগদীশ আশুতোষ রমেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের উৎকর্ষতায় তখনকার ভারতময়তার আবেগে গা ভাসিয়ে সর্ব ভারতীয় হয়ে ছড়ি ঘোরানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তখনকার নেতৃস্থানীয় বাঙালী হিন্দু নেতারা। তারা নিজেদেরকে মারাঠী আর্য ব্রাহ্মন লক্ষ্মন বল্লাল শশাঙ্কদের উত্তরপুরুষ ভেবে তাদেরকে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু রমেশ বাবুদের কখনো কি জিগ্যেস করেছিলেন ওরা ওই মোঘল পাঠানদের মতই বহিরাগত ছিলেন কিনা? জাতপাতের সুত্রপাত করে তারাই তো হিন্দু ধর্মকে এভাবে ব্রাহ্মন্যবাদী বানিয়ে বাংলা শাসন করেছিলেন। তারা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন। রাজকার্য সংস্কৃত ভাষায় হোত। ব্রাহ্মন ছাড়া রাজ দরবারে অন্য কোন মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সাধারন বাঙালীর হিতকার্যে তারা কয়েকটি মঠ মন্দির আর পুকুর দিঘি করে গেছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা কি কখনোই আম জনতার কাজে ব্যবহার হোত। তারা কি এমন কোন কীর্তি এই বাংলার বুকে বিদ্যমান রেখে গেছেন, যেটা নিয়ে মুসলমান স্থাপত্যের ন্যায় গর্ব করে গলা ফাটাবেন।
ধর্ম নিরপেক্ষতার ট্যাগ লাগিয়ে নেহেরু প্যাটেলরা বা সোজা বাংলায় বললে আর্য ব্রাহ্মনদের অপভ্রংশ ও তদীয় গুডবুকে থাকা কাকের ময়ুর পুচ্ছ লাগানো দ্রাবিড়রা যে ভারত নির্মানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন তার মূল কথাই তো ছিল আজকের প্রকাশিত ভারত শাসন। ঠিক যে মিশনে প্রকাশ্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল। তবে ভারতীয় নেতারা ধীরে চলো নীতির সুললিত তাল ও লয়ে ভারতবাসীর চোখে পট্টি বেঁধে নিজেদের পায়ের মাটি শক্ত করেছে। হাঁ, শ্যামা বাবু প্রনব বাবু প্রিয়'দারা সম্মানিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারপর! এখনকার দিনে ভারত রাষ্ট্রের কোন্ প্রফাইলে একজন বাঙালী নীতি নির্ধারক আছেন বলতে পারবেন। কয়জন আইসিএস আইএএস পেয়েছেন, কয়জন আম্বানী আদানী পেয়েছেন! সর্বভারতীয় দাদা হিসাবে যাকে পেয়েছেন, বাংলার বা বাঙালীর কোন্ উন্নয়নে তাকে ব্যবহার করছেন! সর্বভারতীয় হয়ে টিকে থাকার মিশনে তাকেও তো দেখি বাপ বেটাকে সন্তুষ্ট রাখতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে।
বাংলায় শিল্পোন্নয়ন হয়নি। সর্বভারতীয় ও মাড়োয়ারী তোড়ে বাংলার ব্যবসা বানিজ্য আজ বেহাত অবস্থায় আছে। যে বাংলা ও বাঙালীর শুদ্ধতা নিয়ে কলেজ স্ট্রীটের বাঙালী বাবুরা বিশুদ্ধ হিন্দু বাঙলী সেজে কত্তাবাবু হয়ে হুকোয় টান দিতে চেয়েছিলেন, পান খৈয়নির বাহারি তোড়ে আজ তাদের নাভিশ্বাস কোন্ মাত্রায় পৌঁছেছে বলা যাবে কি?
হিন্দু মুসলমান করতে করতে বাঙালীর পৌঁনে এক'শ বছর পেরিয়ে গেল অথচ যাদের তাচ্ছিল্য করে বা অবহেলা করে জাতে উঠার হিন্দু বাঙালী হতে চেয়েছিলেন তাদের ধারে কাছেও কি তাদের সেই বাঙালী অস্মিতা বেঁচে আছে! যাদেরকে বাঙাল ম্লেচ্ছ বলে নাক সিটকানো হোত তাদের মধ্যে জাত পাতের হিসেব নিকেশ নেই। সর্ব ধর্মের রাষ্ট্র হিসাবে তারা বাঙালীয়ানার আবাহনে নিজেদেরকে বিকশিত করছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে হয়তো এমনও দেখা যাবে শিক্ষা স্বাস্থ্য আইন শৃংখলা প্রশাসনে এই পঞ্চাশ বছরের যবন ম্লেচ্ছ বাংলায় ১০% হিন্দু অধ্যুষিত বাঙালীদের যেভাবে বিকাশ ঘটেছে বা ঘটে চলেছে তা ওই পঁচাত্তর বছরের খাঁটি বাঙালীময় ভারতের রাজ্যটিতে হয়েছে কিনা সন্দেহ হয়। আর সাহিত্য সংস্কৃতির কথা যদি বলতে হয়, তবে সেই কলেজ স্ট্রীটের পসার বা জীয়ন কাঠি তো এখন ঢাকা কেন্দ্রিক বলেই মনে হয়। তাদের প্রকাশনার পঞ্চাশ ভাগই এই অশিক্ষিত বাঙালিদের বদান্যতায় টিকে আছে। আর যেসব উচ্চারন এই প্রবন্ধে উচ্চারিত হলো তার হাপিতেশ বা আক্ষেপ তো বাঙালী প্রতিনিয়তই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছে এবং শুনছে তাদের সেই আঁতেলীয় আড্ডার বিভিন্ন আয়োজনে যার সম্পুর্নটাই অসম্পুর্ন বা অস্বচ্ছ্ব বলে ধরা দেয়। তাদের সেই আঁতেলীয় আড্ডায় কখনোই তারা সেই সত্য উচ্চারন করেন না বা করতে ইতস্ততঃ করেন।
বাঙালীর সমগ্রতায় আলোর ঝলকানি যদি কেউ দিয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই বিদেশীয় মুসলিম শাসকদের বদান্যতা। তাদের বাংলায় কথা বলা, শাসন ব্যবস্থায় বাংলার প্রচলন, আম বাঙালীর রাজকর্মচারীর মর্যাদা লাভ, এমনকি সাধারন বাঙালীর বোধগম্যহীন সংস্কৃত ও আরবী-ফারসীর পরিবর্তে বাংলায় বাঙালীকে ব্যবহারিক জীবনে অভ্যস্ত করে তুলার কাজটিও ওই বিজাতীয় মুসলিম শাসকেরাই করে দিয়েছিলেন। এমনকি, ধর্মকর্মের নিক্তিতে উঠে বাঙালী যখন তাদের ধর্মালোচনা এবং পবিত্র মহাগ্রন্থ সমূহের সংস্কৃত ও আরবী ভাষা থেকে যোজন দূরে অবস্থান করছিল, ঠিক তখনই বাংলার স্বাধীন সুলতানীয়াতের মুসলিম শাসক সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ এর পৃষ্টপোষকতায় বাল্মিকীর রামায়নের বঙ্গানুবাদ করার উদোগ নেয়া হয়। মধ্যযুগের মহাকবি কৃত্তিবাস এই মহৎ কর্মটি করে বাঙালীকে বাংলায় উৎসর্গ করেন। ১৪১৮ থেকে ১৪৩৩ খ্রীষব্দের মধ্যে এই অসাধ্য সাধন হয়েছিল। অর্থাৎ এই বাংলা অঞ্চলে বাংলার প্রচলন মুসলিম শাসকেরাই চালু করেছিলেন। বাঙালীর বাংলায় কথা বলা, বাংলায় তাদের দৈনন্দিন উচ্চারনে সাবলীল হয়েছিলেন মধ্যযুগীয় সেই ইসলামী শাসনের সময়কালে। এটাই ইতিহাস। এটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় আছে কি? আজকের হিন্দু মাথাওয়ালা বুদ্ধিজীবিরা কি ঘুনাক্ষরেও উচ্চারন করেন, তাদের ইদানীংকার "জয় শ্রীরাম" উচ্চারনের মহাকাব্য রামায়নের বাংলা অনুবাদ হয়েছিল মুসলিম শাসক জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের পৃষ্টপোষকতায়। সাধারন বাঙালীর বোধগম্যতায় বাল্মিকীর সেই মহাগ্রন্থ রামায়ন বাংলায় অনুবাদ হয়েছিল মুসলিম শাসকের বদান্যতায়। ইতিহাসই কথা বলে। যে উদারতা ও সহমর্মিতা এবং মনুষ্য আচরনে মুসলিম সম্প্রদায় ও শাসক কুল তাদের রাজকার্য ও দৈনন্দিন জীবনাচারে বাঙালী জাতিকে একসুতোয় বেঁধে বাঙালীর সমগ্রতার জৌলুষ বা জোয়ার এনেছিলেন, সেই উচ্ছাস বা উদ্দীপনায় সংস্কৃত বলয়ের হিন্দু রাজা ও ব্রাহ্মন্য সম্প্রদায় তা কি করতে পেরেছিলেন? বরং তারা নিজেদের জাতিগোষ্ঠির মধ্যে জাতপাতের বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি করে গোষ্টি ফায়দা তুলে নিয়ে বাঙালীকে বিদ্ধস্ত করে ছেড়েছেন।
সুতরাং ধর্ম নয়। কর্ম হোক আমাদের সর্বোচ্চ উচ্চারন। বাঙালীর হিন্দু মুসলমান নয়, বাংলা ও বাঙালী হোক তাদের জীবনের জয়গান। অতীশ দীপঙ্কর হয়ে কৃত্তিবাস চন্ডিদাস মীর মশারফ রবীন্দ্র নজরুল শরৎ সত্যজিত ডঃ মোঃ শহীদুল্লাহ তারা সবাই বাঙালী। স্যার জগদীশ বসু ডঃ কুদরত ই খোদা, তারাও বাঙালী। আবার ইউনুস অমর্ত্য তারাও বাঙালী। সেক্ষেত্রে সুভাস বসু দেশবন্ধু ভাসানী মুজাফফর আহমেদ এমন কি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শেরে বাংলা আবুল হাসেম হয়ে আজকের বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবও একজন বাঙালী। সেক্ষেত্রে অনুকুল ঠাকুর যেমন একজন বাঙালী তেমনি মওলানা আকরাম খাঁ, হাজি শরিয়ত উল্লাহও একজন গর্বিত বাঙালী। কিন্তু বাংলার সর্বনাশের মুলে যাদের নামটি উচ্চারনে আসতে নেই তারা বাঙালী হলেও বাঙালীয়ানার সর্বময়তায় তারা কখনোই নমস্য নয়। তারা বাঙালীকে ধর্মীয় বিভেদে ফেলে নিজেদের জাতপাতের ডামাডোলে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন। যেমন করে মুসলিম গোষ্টীর কিছু বাঙালী নেতাও তাই করেছিলেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ধর্মের ডুগডুগি বাজিয়ে বাঙালীর জাতিগত ঐতিহ্যকে চুরমার করে ধর্মীয় উন্মাদনায় বাঙালীকে বুঁদ করে রেখে নিজেদের রাজ কায়েম করা। তারা আরএসএস সৃষ্টি করে সাধারন হিন্দু সমাজকে জঙ্গী ধর্মান্ধ বানিয়েছে, তেমনি মুসলিম সমাজের অতি উৎসাহী ধর্মীয় নেতারা জামাতে ইসলামী সৃষ্টি করে সাধারন মুসলমানদের ধর্মান্ধ জঙ্গী ক্যাডার বানিয়েছে। সুতরান বাঙালীর সমগ্রতায় তাদের নাম ঘৃণিত আকারেই উচ্চারিত হবে। লক্ষ্য করুন, সময় ও স্রোত কাউরি জন্য অপেক্ষা করেনা। বাঙালী তার নিজস্ব অস্মিতায় জয় বাংলা শ্লোগানেই এগিয়ে গেছে এবং নিজস্ব ভূখন্ড সৃষ্টি করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে হিন্দু মুসলমান এর মুখ্যতায় না থেকে তারা বাঙালীয়ানার সমগ্রতাকে পুঁজি করে এগিয়েছে। বাঙালী এগিয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ! তার নমুনা ও অনুশীলন ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এটাই শাশ্বত। জয় বাংলা!
-সমাপ্ত-