জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাঙালীর হিন্দু ও মুসলমান(১)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ জুলাই,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:১১ এএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
একজন ইংরেজ ভদ্রলোক তার পুর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া ভারত বর্ষের নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি জাতীয়তার উপর কিছু জানার আকাঙ্ক্ষায় এখন ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতে চষে বেড়াচ্ছেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি বাঙালীর স্বাধীন ভূখন্ড বাংলাদেশেও ঘুরে এসেছেন। এর আগে সারা ভারত ঘুরে তিনি ভারতের স্বরাজ আন্দোলনে বাঙালীদের স্বাধীন চেতা ও নেতৃত্ব গুনের কথা সবখানেই শুনেছেন। মহামতি গোখলের what Bengal thinks today India thinks tomorrow এর উদ্ধৃতিও তিনি কিছু বর্ষীয়ান ভারত আন্দোলনের আইকনের কাছে শুনেছেন। নেতাজী সুভাস বোস শেরে বাংলা সোহরাওয়ার্দীর নামও তার কানে এসেছে। যদিও মূল স্রোতধারার নেতৃত্বে সেই সময়টাই বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি তখনও চাউর হয়নি তথাপিও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামটিও বেশ জোরে শোরেই শুনেছেন। তিনি জেনেছেন শেখ মুজিবের নেতৃত্ত্বে বাংলার মুক্তিযুদ্ধের কথা।
বাঙালীর সমগ্রতা পরাধীন ভারতে একটি স্বকীয়তা নিয়ে তাদের নিজস্ব ঔজ্বল্যে দীপ্রমান ছিল, তা তিনি জেনেছেন। তৎসময়ের ভারতের রাজধানী কলিকাতা অখন্ড বাংলার রাজধানী ছিল সেটাও তিনি জেনেছেন। বৃটিশ রাজের অধীনে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশে অখন্ড বাংলার রাজনৈতিক সচেতনেতা এবং নেতৃত্ব গুনের সবকিছুই তার কাছে উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়েছে। যে ইংরেজ জাতি কলিকাতায় নোঙর করে বাঙলাকে বশীভূত করার পর সারা ভারতের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়েছেন সেই বাংলা ও বাঙালীকে নিয়ে তার আগ্রহের সীমা ছিলনা। বাঙালীর অখন্ড চরিত্র, খন্ডিত বাঙালীর স্বাধীন স্বত্ত্বা ও ভারত অঙ্গীভূত বাঙালীদের বেড়ে উঠার কাহিনী চিত্রও তাকে বিস্মিত করেছে। তবে বাঙালীর খন্ডিত হওয়ার ঘটনায় তিনি মর্মাহত হয়েছেন। পলাশীর প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়ে তিনি তার পুর্ব পুরুষদের ভারত জয়ের ভীতকে স্মরন করেছেন। একজন মানুষ হিসাবে বাংলার শেষ নবাবের বীরত্ব গাঁথা তাকে স্পর্শ করেছে। পাশাপাশি তার চারিপাশে থাকা বিশ্বাস ঘাতকদের তিনি ঘৃনার চোখে দেখেছেন। দুই বাংলা ঘুরে তার মনে বাঙালীর এই ধর্ম ভিত্তিক জাতিগত বিভক্তি ভাল ঠেকেনি। তাই তার অবচেতন মনে ঘুরপাক খাওয়া কথাগুলি তিনি একটু আক্ষেপ ও ক্লেশাত্ব মনেই বলে গেছেন। হুবহু না হলেও তার সারবত্ত্বা প্রবন্ধকারের ভাষায় ব্যক্ত করা হলো।
বাংলার অখন্ডতার ভষ্মে ঘি ঢেলেছে বাঙালী নিজেই। বাংলার খন্ডিত হওয়ার মূলে বাঙালীরাই কাজ করেছে। বাংলাকে ভাগ করে বাঙালীকে দুর্বল করেছে বাঙালী নামক কতিপয় উচ্চশিক্ষিত ধর্মান্ধ মানুষ। নিজেদের কোঠারী চিন্তার ফসলকে বাস্তবায়িত করার মানসে ধর্ম চিন্তায় মশগুল করে সাধারন বাঙালীকে ধর্মান্ধ বানিয়েছেন ওইসব অতি আঁতেল ব্যক্তিত্ত্ব যাদের উত্তর পুরুষেরা এখন বাঙালীর অস্মিতা নিয়ে কোলকাতার বিভিন্ন সভা সমাবেশে হা-পিতেশ করছেন। বাঙালী কারা, বাংলা কাদের, বাংলার মঙ্গল, বাংলার অস্তিত্ত্ব, বাঙালীর শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে সেসব আঁতেলীয় মাথাদের আজকাল খুব ঘাম ঝরাতে দেখি। অথচ সেই তারাই একদিন তাদের পরিপাশ ও সামাজিক বলয়ের বুনিয়াদি কাঠামোকে আপন অস্তিত্ত্বের নির্যাস বানিয়ে বিদ্যাসাগরের 'উর্ধপানে চাহিয়া হাঁটিও না, থপ থপ করিয়া ভেক চলে' কিংবা বঙ্কিমের লেখনী পরম্পরার যবন ও ম্লেচ্ছদের কাহিনী কারবার সাজিয়ে বাঙালীকে এখনো লেংটি ও ফতুয়া পরিয়ে রেখেছে। মানি, বাঙালীর অস্তিত্ত্বের আঁতুড় ঘর হচ্ছে লেংটি(ধুতি) ও ফতুয়া। কিন্তু আর কতকাল নিজেদের আঁতেলীয় গরিমা ধরে রেখে সমগ্র বাঙালী সমাজটাকে এভাবে হীনমন্যতার নিকৃষ্টতম স্থানে ফেলে রাখবেন! একজন চন্দ্রিল বা ডাঃ কুনাল বাবুর হাঁসফাসে বুঝতে পারি কতটা অস্তিত্ত্ব সংকটে তাদের বাঙালীয়ানার স্বরবর্ণ। সেই যে আশু বাবু শ্যামা বাবু কিংবা অরবিন্দদের হাত ধরে বাঙালীর হিন্দু ও মুছলমান সংজ্ঞা (definition) বাংলার অখন্ডতায় হাতুড়ি চালালো তার বিষাক্ত গরলে বাঙালীর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠী নিজেদেরকে এখনো জাতে উঠিয়ে রেখেছে। বাংলার শিক্ষা সংস্কৃতির একছত্র আধিপত্যের সেইসব দিনে বাংলা ভাষা ও শিক্ষা প্রচলনের মাহেন্দ্রক্ষনে বিজাতীয় উদ্যোগে যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে বাঙালী পন্ডিতদের আমন্ত্রন জানানো হয় তখন উক্ত কলেজের কর্মরত বাঙালী ব্রাহ্মন পন্ডিতদের সংস্কৃতি ভাষায় অধ্যাপনা করাটাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছে। সুতরাং বাঙালীয়ানার কোন্ পরিকাঠামোয় সেইসব দিনের ব্রাহ্মন নেতৃত্বের কর্তারা অবস্থান করেছেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। ব্রাহ্মন্য ভোগবাদী সমাজের 'নমস্কার কত্তাবাবু'দের অন্ন যোগানে এখনও তাদের আম বাঙালীর নাভিশ্বাস চলছে। আর এরই ফাঁক গ'লে সর্বভারতীয়ের বিজাতীয় আগ্রাসনে বাংলার কৃষ্টি কালচারে এক উলোট করা গন্ধ দাদাদের দাদাগিরির টুঁটি চেপে ধরেছে।
সাতচল্লিশ বিভাজনের বহুকাল আগে থেকেই সমগ্র বাংলাসহ ভারতবর্ষের একটি বিশেষ ধর্মের সম্প্রদায় বিশেষ করে আর্য অপভ্রংশের ব্রাহ্মন ও তাদের সাহচর্যের দ্রাবিড়ীয় ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীনরা বিগত পাঁচ সাত'শ বছর দিল্লির বিদেশী ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে গ্রাহ্যে আনতে চায়নি। ক্ষমতা হারানোর জ্বালা এবং বিজাতীয় শাসনের বিশেষ করে মুসলিম শাসনের উৎকর্ষতায় তারা উঁচু-নিচু জাতপাতের ডামাডোলের মধ্যেই ধর্মীয় উন্মাদনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে অধঃস্তন সম্প্রদায়কে নিজেদের রাজনীতির বড়ি বানিয়ে রেখেছে। এরই ফল পরম্পরায় নিজেদের ক্ষমতার অপরিহার্যতার দৈনদশায় শংকিত হয়ে তারা ধর্মের উন্মাদনা ছড়িয়ে বাংলার অখন্ডতার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। তারা বাংলা ও বাঙালীর অখন্ডতার শাশ্বত অহংকারকে ধুলিস্যাৎ করেছেন। ভারতীয় সাজার অহংবোধে তারা পুর্ব বাংলার মুসলমান অধ্যুষিত বাঙালীদের ম্লেচ্ছ যবন কিংবা বাঙাল বলে উপহাস করেছেন। তারই প্রবাহে এবং কলেজ স্ট্রীটের ধুতি পৈতার বাঙালী বাবুদের কলমের নিরবিচ্ছিন্ন খোঁচার কল্যানে এখনো অর্থাৎ বাঙালীর স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পরও তদাঞ্চলের ভারতীয় বাঙালীরা পুর্ব বাংলার বাঙালীকে বাঙালী ভাবতে পারেন না। তারা স্বাধীন বাংলার বাঙালীদের মুসলমান বলে ডাকে। তাদের মাথায় এমন বিষ ঢোকানো হয়েছে, তারা ভাবতেই পারেনা যে বাঙালীদের একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে। বাঙালী এখন স্বাধীন একটি জাতিস্বত্ত্বা। কতটা 'নীলে' আকন্ঠ হলে একটি পরাধীন জাতিস্বত্ত্বা তাদের সেই সৃষ্টি করা 'হিন্দুয়ানী বাঙালীয়ানা'র ঠুনকো অহংবোধে এখনো সেই আশু বাবু শ্যামা বাবুদের ঢোলের বাদ্যে উলঙ্গ নেত্য করে!
ভারতীয় ডমিনিয়নের একটি ক্ষুদ্র প্রদেশ এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি। একদিকে ভারতীয় হওয়ার রেশ অন্যদিকে বাঙালী হয়ে টিকে থাকার দোটানায় আজ হিন্দু গরিষ্ঠের বাঙালী অধ্যুষিত ঐ রাজ্যটি এখন কবিগুরুর ভাষায় 'শক হুন দল মোঘল পাঠান এক দেহে হোল লীন' এর দ্বিতীয় সংস্করনের 'বিহারী, অসমিয়া, গুজরাঠী, মারাঠী, ওড়িয়া ইত্যাদি জাতির অনুপ্রবেশে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শংকরায়নের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। এখনকার দিনে তদাঞ্চলে বাঙালীয়ানার শাশ্বত আবাহন খুঁজে পাওয়া বড়ই কষ্টকর। সেখানে বাঙালীর দোল উৎসব হয় না। দিওয়ালী উৎসব হয়। পহেলা বৈশাখের হালখাতা না হয়ে সেখানে রাম নবমী অনুষ্ঠিত হয়। মাড়োয়ারী গড্ডলিকায় দুর্গা পুজার চেয়ে গনেশ পুজায় জোশ দেখা যায় বেশী করে। বেদ পুরানের আদেশ নির্দেশকে শিকেই তুলে বাঙালী আজ অস্থি চর্মের মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্রকে পুজার আসনে বসিয়ে "জয় শ্রীরাম" এর শ্লোকে ধন্য হতে চাচ্ছে। আজকে হিন্দু মুসলমান উহ্যে রেখেই বলছি, বাঙালী অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতে কত পার্সেন্ট বাঙালী ব্যবসা বাণিজ্য করেন, চাকরী পান বলতে পারেন? ইদানীংতো দেখি রাজনীতিতেও বাহারিদের পদচারনা শুরু হয়ে গেছে। আগে তো দেখতাম কোলকাতার পর পাটনা ছিল বাঙালীদের দ্বিতীয় আবাস। কত কবি সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ সেই পাটনা কটক গৌহাটি করিমগঞ্জ রেঙ্গুন থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কোথায় আজ সেই হিন্দু বাঙালীর রমরমা, যে বাঙালীর ব্রেনে দিল্লি চাঙ্গা থাকতো। ইদানীকার দিল্লির সাউথ ব্লকে কয়জন বাঙালী সচিব আছেন,কেউ কি বলবেন? এমনকি নিজ রাজ্যের নবান্নেই বা মূল প্রশাসনের কর্তাটি কে? সুতরাং খাল যখন কেটেছেন, কুমিরের তাড়া তো খেতেই হবে। হিন্দু মুসলমান একাত্ম থেকে অখন্ড চেতনার বাঙালী ভুল করে নি। ভুল করেছেন আপনাদের পিতা প্রোপিতামহের একটি ধর্মান্ধ এবং ক্ষমতা লিপ্সু গোষ্ঠী যাদের সেই অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত এখন আপনারা করছেন এবং রায় দুর্লভ, উঁমি চাঁদ, জগত শেঠ এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তর পুরুষরা এখনো তা সযত্নে লালন করে চলেছে।….. (চলমান)