জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভিডিও ভাইরাল
প্রকাশ: ১১:৫২ পিএম, ২১ অক্টোবর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:২৪ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আজকাল ভাইরাল কথাটির প্রচলন বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভাইরাল কথাটি এসেছে ভাইরাস থেকে। অবশ্য এ ভাইরাস সে ভাইরাস নয় যার সংক্রমনে আজ গোটা বিশ্ব থর থর করে কাঁপছে। তবে ইদানীংকার অবাধ মিডিয়া প্রবাহের যুগে যে ভাইরাসের ভাইরালে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংক্রমনের বীজ ছড়ানো হয় তা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। যে ভাইরাসের ভাইরালে বা সংক্রমনে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের কথা, কাজ, নাটক, খবর, ঘটনা, দুর্ঘটনার নেগেটিভ ও পজেটিভ প্রভাব বিস্তার ক’রে সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রতি নিয়ত সংক্রমিত করছে সেটা নিয়েই আমাদের আজকের কথকথা। রাষ্ট্র,রাজনীতি,সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে বিভিন্ন বক্তব্য, নাটক,সিনেমা ও ভিডিও ইত্যাদির বাছায় করা ক্লিপ অনেক সময় সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সুত্রপাত ঘটায়। অনেক ক্ষেত্রে তা ভাল ফলও বয়ে আনে। তবে নেগেটিভের পাল্লাই ভারী। আগে তো এতসব ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ইমো ভাইবার বা ইউ টিউব ইত্যাদি ছিল না। তাছাড়া তথ্য প্রবাহের ব্যাপকতাও এত বিস্তৃত ছিল না। কিন্তু এখনকার সময়ে সবকিছু আঙ্গুলের ইশারায় হচ্ছে বা পাওয়া যাচ্ছে। আগে বোতাম টিপে এসব করতে হোত। এখন তো টাচ্ করলেই কেল্লাফতে। শোনা যায় চোখের ইশারায়ও আজকাল মিডিয়ার কাজ সেরে ফেলছে উন্নত বিশ্ব। আমরাও হয়তোবা দু-এক বছরে ওই উঠানে পা ফেলবো।
মোটা দাগে রাজনীতি অর্থনীতি ধর্মনীতি ও রাষ্ট্রনীতির ভাল-মন্দের ছোট ছোট ইতিবৃত্ত বা নির্ঘন্টগুলি যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখরোচক আঙ্গিকে প্রকাশিত হয় তখন সেখান থেকে চুম্বক অংশটি সমাজের একটি অংশ গ্রহন বা বর্জন করে। এবং তখন জনগনের একটি বড় অংশ সেটাকে নিয়ে তাদের গ্রহন বা বর্জনের অভিব্যক্তি প্রকাশ ক’রে ভাইরাল করে ফেলে। ফলে সেই বিষয়টি নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশে সন্তোষ/অসন্তোষের তোলপাড় শুরু হয়। সত্য বিষয় বা ঘটনাকে যেমন ভাইরাল করা হয় তেমনি মিথ্যা অপপ্রচারের জন্য সাজানো বিষয়গোলোও ভাইরাল হয়। সোশ্যাল মিডিয়া একটি শক্তিশালী মাধ্যম। মানুষের হাতে হাতে তা ছড়িয়ে আছে। সুতরাং আপনি সত্য বলুন বা মিথ্যা বলুন – এর সংক্রমনের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাজে প্রভাব ফেলে। কেননা এর গতি ও দ্রূততা এত প্রবল যে কিছু বুঝে উঠার আগেই অনেক মিরাক্যাল কিছু ঘটে যায়। অনেক সময় অবাস্তব কিছু ঘটনা সাজিয়ে তা এমনভাবে ভাইরাল করানো হয় তাতে সমাজের উপকারের থেকে অপকারই হয় বেশী। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া অনেক কিছুই সমাজ ও রাষ্ট্রকে নাড়া দেয়। সামাজিক পুনর্গঠনে সেসব ভাইরালের পজেটিভ দিক ভাল ফল বয়ে আনে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার একাল-সেকাল নিয়ে অনেক খবর ও ভিডিও আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করানো হয়। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা তাদের রাজনৈতিক মস্তিষ্ক প্রসূত মেকানিজমে সবকিছুকে দুধে আলতায় রাঙ্গিয়ে ভিডিও ভাইরাল করেন। অনেক সময় দেশের উন্নয়নের হালখাতার ফালনামায় দুধের নহর বইয়ে দেন। দেশ পরিচালনায় তারাই শ্রেষ্ঠ এবং তাদের বিকল্প তারাই সেটা প্রমানে তারা প্রাণান্ত করেন। অপর পক্ষে যারা বিরোধী শিবিরে থাকেন তারা তাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন ছল চাতুরীর আশ্রয়ে এমন সব বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হন তাতে দেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির জন্য সহায়ক হয়। তবে অনেক সময় বিরোধী পক্ষের সোশ্যাল মিডিয়ার সদ্ব্যবহারে দেশের মঙ্গল বয়ে আনে।
রাজনীতির হালচালে পক্ষ বিপক্ষের বিনি সুতো গেঁথে আজকাল যেভাবে রাজনীতির মুখিয়া বা তাদের চলার উঠানকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কলুষিত করা হয় তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। ক্ষমতায় থেকে নিজেদেরকে মহান ও মহানুভবতার সর্বোচ্চ উঁচুতে বা শিখরে তুলে যেভাবে ভাইরাল করানো হয় তা কি বাস্তবতায় সিদ্ধ! আবার ক্ষমতায় থেকে ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া এবং সর্বশেষ সোশ্যাল মিডিয়ার সংস্করনে যেভাবে বিরোধী পক্ষের পিন্ডি চট্কানো হয় তাও কি গ্রহণযোগ্যতায় পড়ে? পাশাপাশি বিরোধী পক্ষের এই পথে হাঁটা লোকজন যেভাবে গেল গেল রব তুলে সোশ্যাল মিডিয়ার আশ্রয়ে ছয়কে নয় বানিয়ে ভিডিও ভাইরাল করেন তাতে জনপদের ক্ষতির অংকটাই বাড়ে। তারা দেশের চলমান বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে যেভাবে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বা অশ্রাব্য কথামালা ভিডিওতে ভাইরাল করেন তা গ্রহনযোগ্যের খাতায় পড়েনা। অনেক সময় সামাজিক ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে নিয়ে বিরোধী পক্ষ রাজনীতির রঙ চড়িয়ে তাতে নতুন মাত্রা দেয়ার অপচেষ্টাও করে। লক্ষ্য করা যায় অনেক বিষয় ও বক্তব্য নিয়ে শাসক গোষ্টী বা বিরোধী পক্ষ কিছু কিছু অনৈতিক ও অশ্রাব্য বক্তব্য ও বিবৃতি এই সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল করানোর চেষ্টায় ব্রতী হয়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে রাজনীতি সম্পর্কে একটা প্রচ্ছন্ন বীতশ্রদ্ধ ভাবের জন্ম হয় যা মোটেই কাম্য নয়।
দেশের অর্থ ব্যবস্থার অলিগলিতে হর হামেশাই নয়ছয় হচ্ছে। ইদানীংকার হালখাতায় দেখা যায় সেটা বেশ বড়সড়ই বটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা চুরি, লেনদেনের নয়ছয়, শেয়ার বাজার কেলেংকারী, বড় বড় প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে তা বিদেশে পাচার, খেলাপী ঋনের লম্বা লিষ্ট, কিংবা রাজনীতি ও প্রশাসনের চাঁইদের ভিন্নপথে দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করার সব মুখরোচক খবর আমাদের আতংকিত করে বৈকি! আর এর সবকিছুই আমরা জানতে পারি ফেসবুক নামক সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে যা ভাইরাল হয়ে জনগনের হাতে থাকা মোবাইল সেটে পৌঁছে যায়। এই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক না থাকলে আমরা কি করে জানতাম যে পাঁচ’শ টাকার বালিশ দুই লক্ষ টাকায় কেনা হয়। কিভাবে জানতাম ষাট টাকার দুধ মাপার পাত্র দুই লক্ষ টাকায় কেনার কেচ্ছা কাহিনী। কেমনেই বা জানতাম খিঁচুড়ি রান্না শেখার জন্য এক হাজার বাবুর্চির বিদেশ প্রশিক্ষনের এতবড় দেশপ্রেমের প্রকল্প প্রস্তাবের কথা। কিংবা পুকুর খনন করার প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য বাংলার সর্বোচ্চ শিক্ষিত আমলা ও ইঞ্জিনিয়ারদের আফ্রিকার উগান্ডা বা সোমালিয়ায় প্রশিক্ষণ নেয়ার খবর। সবই তো এই সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল নামক সংক্রমনের ফসল।
ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়টি মানুষের আত্মিক চাহিদার একটি অংশ। জীবন যুদ্ধের মৌলিক চাহিদায় এটা পড়ে না। তারপরেও তৃতীয় বিশ্বের এই ভূখন্ডে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধর্ম-কর্ম নিয়ে বেশ হৈচৈ হয় এবং এটাকে আমরা আমাদের জীবন নির্বাহের প্রথম পর্যায়ের অংশ বিবেচনায় গুরুত্ব দিই। ফলে এতদাঞ্চলে ধর্মের উপর ভিত্তি করে রাজনীতির উঠান তৈরী হয়। এই রাজনীতির উঠান বা দল সমূহ তখন নিজেদের শ্রেষ্ঠ বানানোর মহোৎসবে ধর্মীয় বিষদ্গার ছড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার আদলকে পরিবর্তন করতে চান। তাছাড়া ধর্মীয় গোঁড়ামী মানুষের গোষ্টিতন্ত্রকে এমনভাবে বিষাক্ত করে ফেলে যে তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে হানাহানি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুত্রপাত করে। ইউনিভার্সালের দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকিয়েই বলতে ইচ্ছে করছে- আজকাল আমাদের মওলানা ও হুজুরেরা যেভাবে কোরান সুন্নাহর বয়ান করে চলেছেন এবং তাদের নিজস্ব মন গড়া ফতোয়া দিচ্ছেন তাতে খুব বেশীদিন হয়তো প্রয়োজন পড়বে না যখন ভিন্ন ভিন্ন তরিকার মাজহাবে বিভক্ত হয়ে একদিন মুসলমানেরাও ভিন্ন ধর্মীয় স্টাইলে নিজস্ব স্বকীয়তা তৈরী করে ফেলবে। আজকাল শিয়া সুন্নির উপরেও ছাপিয়ে গেছে সেইসব আহলে হাদিস, আগাখানি, হানাফিয়া কাদেরিয়া, নকশেবন্দিয়া, চিশতিয়া, মোজাদ্দেদিয়া নামক বিভিন্ন আকিদা ও তরিকার নাম। আর এর মূলে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন ধরনের ভিডিও ভাইরাল অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি।
সামাজিক আরো বহুবিধ উপাদান সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও ভাইরালের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের ভিতকে নাড়িয়ে দেয়। ইদানীংকার গণজাগরন মঞ্চ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাধারন মানুষকে সম্পৃক্ত করেছিল তা কি ফেলে দেয়া যায়! সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার রাজপথে প্রতিবাদ করার মূলেও তো সেই সোশ্যাল মিডিয়া। কোটা আন্দোলনের বিষয়টিই বা বাদ দিই কেমন করে। আজকের দিনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া দেশব্যাপী ধর্ষন বা গণ ধর্ষনের প্রতিবাদে যে জন জাগরণ তার সিংহ ভাগ কৃতিত্ব এই ভিডিও ভাইরালের- সেটা কি অস্বীকার করার উপায় আছে!
আজকে সকাল বেলায় যখন এই লেখাটির মাঝপথে ছিলাম তখন আচমকা একটি ভিডিও আমার চোখে পড়লো। সম্ভবতঃ সেটা ভাইরালও হয়ে গেছে। কোন এক প্রথিতযশা সাংবাদিকের বাসার জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়েছে তার বাসার কাজের মেয়ে। ব্যাশ! আর যাই কোথা। আশে পাশের লোকজন এবং উচ্ছৃংখল জনতা (আজকাল ঢাকার অলিগলিতে রিক্সাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, ঝাড়ুওয়ালা, সিলপাটা ওয়ালা, নষ্ট ল্যাপটপ ব্যাটারী ইত্যাদির ক্রেতা, মাছ ওয়ালা, মুরগীওয়ালা এবং ভাসমান কাজের লোক যেভাবে আমাদের আবাসিক এলাকার অলিগলিতে চলাচল করে তাতে ক’রে জনতার ভিড় ও হৈচৈ শুরু করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়) বাড়িটি ঘেরাও করে ফেলেছে। কাজের মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে ইত্যাদি নিয়ে শ্লোগান। লাঠিসোটা- ইট পাটকেল- গেট ভাঙ্গা ইত্যাদির ঘটনা। রীতিমত দাঙ্গা হাঙ্গামা। পুলিশ -টিয়ার গ্যাস – লাঠিপেটা- ছত্রভঙ্গ যতসব কায় কারবার। এরপরে আর কিছু লিখতে চাই না। শুধু বলতে চাই মানুষ কাজ হারাচ্ছে। নতুন কাজের সৃষ্টি হচ্ছে না। সুতরাং অলস বেকারত্ব হাতের স্মার্ট ফোনটাকে সক্রিয় করছে। এবং যেনতেন ভাবে।