জালাল উদ্দিন আহমেদ
কোন গলিপথে আমরা-১ম পর্ব
প্রকাশ: ০৩:১৯ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ০৪:৪৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
(সমাজবদ্ধ মানব জীবনে চলার পথে অনেক গলিপথ তৈরী হয়। এসব গলিপথের সমন্বিত ও সুচারু চলনেই তৈরী হয় মসৃন ও প্রশস্ত রাজপথ। এসব নিয়ে লেখার অভিলাষে আজকে প্রথম পর্ব উপস্থাপন করলাম। আশা করি প্রত্যাশায় থাকবো)
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে চলার পথে অনেক অলি-গলির সৃষ্টি হয়। এই গলিপথে চলতে চলতেই তৈরী হয় রাজপথ। আমাদের এই চলার গলি পথগুলি কখনও মসৃণ কখনোবা বন্ধুর হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেই এইসব গলিপথে আমাদের বিচরণ। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এই ত্রয়ীর সমন্বয়ে গড়ে উঠে সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো। সমাজ কাঠামোর আরো অনেক উপাদান আছে যার সম্মিলিত প্রয়াসে একটি রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত মজবুত হয়। গ্রাম ভিত্তিক বাংলাদেশ এখন অত্যাধিক জনসখ্যার চাপে শহরায়ন বা নগরায়নের দিকে ছুটে চলেছে। মাত্র এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের দেশে আজ আঠার কোটি মানুষের বাস। ফলে পৃথবীর সবচেয়ে বেশী ঘন বসতি পুর্ণ দেশে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের গলিপথগুলো কন্টকাপুর্ণও বটে। তারপরেও চলার পথে সামাজিক আবহের স্বচ্ছ্বতা ও সুষ্ঠতা যদি পুষ্ট থাকে তবে কোন বাধাই আসাধ্য নয় যা আমরা বার বার প্রমাণ করেছি।
সামাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম এবং ভৌগলিক অবকাঠামোর উপর ভর করেই একটি রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আমি কোন সমাজ বিজ্ঞানী নই কিংবা কোন তাত্বিকও নই। সাদা চোখে দেখা বিষয়গুলোকে সহজ ও সরল উপস্থাপনায় নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করাই আমার কাজ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এই সমাজের গলিপথেই মানুষের বেড়ে উঠা। আমাদের সমাজ কাঠামোয় বহু মত ও পথের আনাগোনা। জনসংখ্যা চাপের ভারে আমরা এই ছোট্ট ভুখন্ডের সামাজিক বিন্যাসে কিছুটা হলেও এলোমেলো ও অবিন্যস্ত। স্থানীয় সরকার কাঠামোয় আগের সেই শাশ্বত ও বংশ পরম্পরার কাঠামো কিংবা শিক্ষক ও গন্যিমান্যি মুরুব্বী আবহ খুঁজে পাওয়া যায় না। আগের দিনের ভিলেজ পলিটিক্সের চাপিয়ে দেয়া প্যান্ডেমিক না থাকলেও আজকের এই গ্রাম্য আবহে মাথা চাড়া দিয়েছে এক নব্য দাদাগিরির রাজনীতি। ফলে সামাজিক বিন্যাসের বৈচিত্রে ভরা সেই ঐতিহ্যপুর্ণ ও হৃদ্যতার পরিবেশ আজকাল গ্রাম্য গলিপথে মেলা ভার। এটা কেদ্রীয় রাজনীতির অস্বচ্ছ্বতা ও কর্তৃত্ত্ববাদী আচরনের ফসল। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া দাদাগিরির ভারে গ্রাম্য পর্যায়ে পাতি দাদাদের চালচলনের অযৌক্তিক ও অমার্জনীয় আস্ফালন আজ গ্রামের সাধারন মানুষকে তাদের স্বাভাবিক জীবন নির্বাহে অতিষ্ট করে রেখেছে। আগের দিনে কর্তৃত্ববাদী গ্রাম্য মোড়ল মাত্ববর ছিল ঠিকই কিন্তু তা সামাজিক বন্ধনে নৈতিকতার আলো ছড়াতো। আজকের দিনে চাহিদার অতলে অবস্থান নেয়া এইসব নব্য গ্রাম্য মাত্ববর বা মোড়লদের অন্ন যোগানে গ্রামের গলিপথে আহাজারি নিত্যদিনের রোজনামচায় পরিণত হয়েছে। সামজিক গলিপথের থানা বা উপজেলা লেভেলে যে মচ্ছ্বব চলছে তা মিডিয়ার কল্যানে হলেও কিছুটা দেখা যায়। আজকের ডিজিট্যাল বাংলাদেশে থানা বা উপজেলা পর্যায়ে সবকিছু মানুষের হাতের নাগালে। তবে সামাজিক গলিপথে যে অনিয়মের বীজ গ্রাম লেভেল রোপন করা হয়েছে তা এই লেভেলে এসে বিকট রূপ ধারন করেছে। সেক্ষেত্রে রাজনীতির মোড়কে এই পরিমন্ডলে যে কর্তৃত্ববাদী আচরন দেখা যায় তা অনেক সময় মধ্যযুগীয় আচরণকেও লজ্জা দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখলাম কোন এক উপজেলা বা গ্রাম লেভেলের জনপ্রতিনিধি(!)তার কাম চরিতার্থের বাসনায় ব্যর্থ হয়ে মা ও মেয়েকে গরু চুরির ফাঁদে ফেলে তার ক্ষমতা ও রাজনীতির বীভৎস আচরনের নোংরা বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। এরকম হর হামেশাই ঘটছে বাংলার জনপদে। আমরা দেখেছি সদ্য প্রশাসক হয়ে নিয়োগ পাওয়া কোন এক গ্রামের ছেলে উপজেলা ও থানা লেভেলে গিয়ে তার অস্তিত্বের শেকড়কে ভুলে গ্রাম্য কৃষকদের উপর রাজনীতির দাদাদের মতই দাদাগিরি ফলাচ্ছেন। ফলে সামাজিক শুদ্ধতা ও স্বচ্ছ্বতার শাশ্বত আবেদনগুলি আস্তে ধীরে আমাদের সমাজ ও সংসারের গলিপথ থেকে উবে যাচ্ছে। যেহেতু সবকিছু উপরতলার রাজনীতির অঙ্গুলি হেলনে চলে সেক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট এদের বেপরোয়া চলনে সামাজিক গলিপথগুলো কলুষিত হয় বৈকি। জেলা পর্যায়ের শহর কেন্দ্রিক সামাজিক চলার পথে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও একচক্ষু দৈত্যের নীরব চোখ রাঙানী কিছুটা সময় হলেও শহুরে জীবনের গলিপথকে এলোমেলো করে দেয়। এক্ষেত্রে রাজনীতির নব্য দাদাদের আনাগোনায় জেলা লেভেলের গলিপথগুলো কিছুটা হলেও তটস্থ থাকে। জেলা পর্যায়ে ডিসি এসপিরা যেভাবে সমাজের শাশ্বত বন্ধনের অন্দরে প্রবেশ করতে চাচ্ছেন এবং বিন্যাসে বিপর্যয় ঘটাচ্ছেন তা মিডিয়ার কল্যানে ইদানীং আমরা অবলোকন করছি বৈকি! গ্রাম্য হাট-বাজার, গঞ্জ, ঘাট, খাল-বিল সবখানে আজ সামাজিক আবাহনের ছত্রাখান অবস্থা। সামাজিক বিন্যাসের বিপর্যয় প্রতিটি ক্ষেত্রে।
আজকের দিনের নগর বিন্যাসের দিকে তাকালে কি দেখি আমরা। আজকে বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে নগর সভ্যতার সামাজিক অবস্থান এক তথৈবচ অবস্থায় বিরাজমান। বিজ্ঞান বা ডিজিট্যালের আশীর্বাদ কিনা জানিনা তবে এটা হওয়ার কথা ছিল না। বাঙালী তার আবহমান কালের সামাজিক পরম্পরায় চিরকালই আবেগপ্রবন। এই আবেগ প্রবনতাকে কাজে লাগিয়ে বাঙালী তার মানবতা ও নৈতিকতার আলো ছড়িয়েছে যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। কিন্তু একবিংশের নগর সভ্যতায় বাংলার সামাজিক বিন্যাসের গলিপথ আজ বিচিত্র এক শুষ্ক ও কাটখোট্টা পরিবেশে অবস্থান নিয়েছে। অবশ্য পুরোটা যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। ভাল আছে বলেই তো মন্দরা মাথা চাড়া দিতে পারে না। ফলে নগর সভ্যতার সামাজিক বিন্যাসে এখনো তার শাশ্বত ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবুও ডিজিট্যালের উটকো চাপে আজকের দিনে বাংলার নগর সভ্যতা ও সামাজিক বিন্যাস তার আবেগী ও নৈতিকতার আলো হারাতে বসেছে। ইট কাঠ পাথরে মোড়া নগর সভ্যতার গলিপথে মানবতা নেই, নৈতিকতা নেই-নেই কোন সামাজিক আবেদন। আছে আলোর ঝলকানি আর বেঁচে থাকার আকুল আবেদনে মানুষের ছুটে চলার কল কাকলি। কৃত্তিমতার মোড়কে নগর জীবনের সামাজিক গলিপথগুলো আজ বড়ই শুনশান ও শুষ্ক।
তাহলে সামাজিক গলিপথের যাত্রা কি শেষ হয়ে গেল? সমাজবদ্ধতার চিরন্তন পরম্পরা কি আমাদের তলানীতে? নাহ! কিছুই শেষ হয়নি। সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু ঘুন যে লেগেছে এবং তার বিস্তার যে বাড়ছে তা কিন্তু বলা যায়। বাঙালীর অভ্যেস সব কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা। সে কাজটি আমি করেছি কিনা জানিনা। তবে ইঙ্গিত দিতে অসুবিধা কোথায়? যা বলেছি তার নমুনা তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। সুতরাং রোগের লক্ষন দেখা দিয়েছে। তার চিকিৎসা বা ডাইগনোসিসে হাত দিতে হবে। টিন এজার দাদাগিরির রাশ টেনে ধরতে হবে। গ্রাম লেভেলে নব্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকদের ক্যাডার না বানিয়ে মাটি ও মানুষের দিক্ষায় আলোকিত করে মাঠে ছাড়তে হবে। আইন শৃংখলার দেশপ্রেমী ভাইদের বাংলার সামাজিক গলিপথে আলোকবর্তিকা হয়ে হাঁটার মন্ত্র শিখাতে হবে। শিল্প সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আঙিনায় বাঙালীর শাশ্বত বাঙালীয়ানাকে সুউচ্চ স্থানে বসানোর ব্রতে একাট্টা হতে হবে। সর্বোপরি রাজনীতির বাণিজ্যিক প্রয়োগে বিরত থাকতে হবে। রাজনীতিতে স্বচ্ছ্বতা, নৈতিকতা ও সহমর্মিতার উজ্জ্বলতা বাড়াতে হবে। বাংলার সমাজ জীবনের গলিপথ এখনো তার ঐতিহ্যের পরম্পরা নিয়ে টিকে আছে। পারিবারিক ও সামাজিক গলিপথে হেঁটেই তো রাষ্ট্র ও রাজনীতি তৈরী হয়। সুতরাং সমাজ জীবনে চলার গলিপথ গুলোকে স্বচ্ছ্বতায় হাঁটাতে হলে সামাজিক বিকাশের স্বতঃস্ফুর্ততা ও সামগ্রিক অংশগ্রহন একান্তভাবে অপরিহার্য।
চেতনার মঞ্চ না বানিয়ে আসুন আমরা একমন্ত্রে গেয়ে উঠি - এক নেতা এক দেশ এই আমার বাংলাদেশ।