জালাল উদ্দিন আহমেদ
গণতন্ত্র! গন্তব্য কোনপথে?
প্রকাশ: ০১:৪০ এএম, ১১ অক্টোবর,রবিবার,২০২০ | আপডেট: ১১:০৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
হোক সেটা চাপাতি কিংবা লগি-বৈঠা! কিংবা পুলিশীয় পাহারায় সাদা পোষাক - হাতে লাঠি অথবা হকি স্টিক! তাও তো সেটা গণতন্ত্রেরই সংস্কৃতি। কিন্তু এর গন্তব্য বা দৌড় কতদূর! অর্ধ শতাব্দীর এই আপন আঙ্গিকের গণতন্ত্রে আমরা বেশ মোটাতাজাই বটে। কিন্তু তারপর! এই তারপরের উত্তর কিন্তু হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। যে শুদ্ধাচারের শিক্ষা নিয়ে আমরা বিশেষ করে আমাদের ছাত্র যুবারা ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়কালীন আন্দোলনে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিল আজকের দিনে সেই ছাত্র ও যুব সমাজের সঙ্গে তা কি মেলানো যায়! যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা হাতে ছাত্র ও যুব সমাজ যখন দেশ গড়ার মহান ব্রতে নিজেদেরকে শুদ্ধ স্বপ্নে বিভোর করবে তখন তারা দেখলো পূর্বসুরীদের অশুদ্ধ আচরনের বল্গাহীন ছুটে চলা। এক দল এক নেতার স্বপ্নে বিভোর শাসক গোষ্টীর (নেতার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে) লুটপাটের প্রথম ধাপের সিঁড়ি ছিল সেটা। সেই সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এখন আমরা উপর তলার শেষ সিঁড়িতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ফস্কে যাওয়ার আতংকে চম্কে চম্কে উঠছি আর ভাবছি আর কতদিন। উঠা-নামার সিঁড়িগুলোতো সব খিল লাগিয়ে দিয়েছি। এখন যাব কোথায়!
স্বপ্নের সিঁড়িতে পা দিয়ে নিজের স্বাধীন স্বত্ত্বায় যখন নিজেকে চিনতে শিখলাম তখন শুদ্ধ রাজনীতির কড়া হুংকারের পাদদেশে পেলাম গাদা গাদা পচা শামুকের খোলস। সেই খোলসগুলি মহান নেতার কারিশমায় নিজেদেরকে “ধরাকে সরা জ্ঞান”এর পাল্লায় ফেলে এক অস্বচ্ছ্ব গলিপথের সঙ্গী হলেন। ফলে তাদের সংখ্যাধিক্যের বলয়ে কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে রাজনীতি নামক যুদ্ধ জয়ের নেশা পেয়ে বসলো। ফলে জয় সুনিশ্চিত ভেবেও তিয়াত্তরের নির্বাচনে ছাত্র ও যুব সমাজের একটি বড় অংশ নির্বাচনী অপকর্মের দিক্ষায় অভিসিক্ত হোল। এবং সেই থেকে ছাত্র ও যুব সমাজের আপন অস্তিত্বের গ্রাফ নিম্নমুখী হওয়া শুরু করলো।
রাজনীতির অপরিপক্কতা ও ক্ষমতার লোভ রাজনীতিবিদদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। ফলে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার অপরিণাম দর্শিতায় মহান নেতাকে পরিবার পরিজনসহ অকালে হারাতে হোল। সদ্য স্বাধীন দেশের স্বল্পকালীন গণতন্ত্রের বিকাশ লগ্নে আমাদের গন্তব্য এক অনামিষার অন্ধকারের দিকে যাত্রা শুরু করলো। সামরিক শাসনের পাদপিষ্টে বাংলার মানুষকে পনেরটি বছর পিষ্ট হতে হোল। এই দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসন ও সামরিক আদলের গণতন্ত্রে বাংলার রাজনীতির বুনিয়াদ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। মোটকথা সামরিক পুষ্টতার এই মধ্যবর্তী সময়টুকুতে ছাত্র ও যুব সমাজের মানবিক মুল্যবোধের জায়গাটি নিঃশেষ হয়ে গেল। যে ছাত্র রাজনীতি একটি সুনির্দ্দিষ্ট আদর্শগত অবস্থানে থেকে নিজেদেরকে বাংলার রাজনীতির অপরিহার্য আবশ্যকতায় দাঁড় করিয়েছিল সেই ছাত্ররা সমকালীন সময়ে মূল রাজনীতির নেতৃত্বের পাশে বসার জায়গা করে নিয়ে ক্ষমতার স্বাদ নিতে শুরু করে দিল। ফলে ছাত্রদের ছাত্রত্ব এক অশুভ কলো ছায়ার ঘোরটোপে ঘুরপাক খাওয়া শুরু করলো। বাংলার রাজনীতিতে মাসলম্যান দাদাগিরির সুত্রপাত এখান থেকেই শুরু। সামরিক শাসনের অধিকর্তারা নিজেদের নিরংকুশতা নিটোল করার খায়েসে ছাত্র সমাজকে কলুষতার পঙ্কিলতায় জড়িয়ে ফেললো।
এতদিন রাজনীতির মূলধারা একমুখী প্রবাহে আবর্তিত ছিল। চেতনার উঠান খন্ডিত হয়ে রাজনীতির প্রবাহে দুটি শক্তিশালী ধারার সৃষ্টি হোল। মহান নেতার সৃষ্ট মূল ধারার রাজনীতি অখন্ড চেতনার ধারক হয়ে তাদের কর্মকান্ড সমুন্নত রাখলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসারির সামরিক নেতার সৃষ্ট রাজনীতির উঠানে ততদিনে জনসম্পৃক্ততার জোয়ার কিছুটা হলেও প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। ফলে বাংলার রাজনীতি দুটি প্রচ্ছন্ন ধারায় বিকশিত হওয়ার পথ খুঁজে পেল। এর আগে রাজনীতি বলতে একমুখী একটি দলেই আচ্ছন্ন ছিল বাংলার উঠান। নাম সর্বস্য বামপন্থি ঘরানার রাজনীতি এবং ব্যক্তি প্রাধান্যের দু একটি রাজনীতির পকেট যেমন আগেও ছিল এখনও তা আছে। তবে নামসর্বস্ব এসব রাজনীতির কোন ব্যাপকতা বাংলার জমিনে কোন সময় ছিল বা এখনো আছে বলে মনে হয়নি। এরা আদর্শ নিয়ে কথা বলে কিন্তু আদর্শগত কোন ম্যাসেজ এপর্যন্ত বাঙালীর কানে ঢুকাতে পেরেছে বলে এখনও দৃশ্যমান কোন উদাহারন আমাদের নেই। তবে তাদের ছাত্র রাজনীতির নীতি ও স্বচ্ছ্বতা সুধী মহলে প্রশংসিত হলেও তার ফসল তাদের মূল রাজনীতির ধারকেরা কখনই ঘরে তুলতে পারেনি।
একটি বিষয় বেশ লক্ষ্যনীয়, তা হোল পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতির ধরন এবং তার বিকাশ। সে সময় সামরিক শাসকরা নিজেদের গদির স্থায়িত্ব মজবুত করার খায়েসে তরুন ও যুব সমাজকে টার্গেট করেছিল। সামরিক শাসকেরা ছাত্রদেরকে অর্থ বিত্তের অবগাহনে সিক্ত করে ভোগবিলাসী ও দাদাগিরির সবক দিয়ে রাজনীতিকে দুর্বল করার প্রয়াস নিয়েছিল। কারন তারা জানতো আমাদের ডানপন্থার ঘুনে ধরা রাজনীতি ছাত্রদের তেজস্বীয়তার জৌলুষেই এতদূর এগিয়েছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত যতগুলি সক্রিয় রাজনৈতিক মুভমেন্ট হয়েছে তার প্রত্যেকটির অগ্রভাগে ছিল আমাদের ছাত্র সমাজ। তারপরেও বলতে দ্বিধা নেই যে, মূল রাজনীতির নেতৃত্বের যুথবদ্ধতা এবং বঙ্গবন্ধুর মত মহান নেতার আবির্ভাব না হলে হয়তো আমাদের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হোত হয়তোবা। যাহোক, ছাত্র ও যুব রাজনীতির মেরুকরন করেই স্বাধীন বাংলায় এভাবেই এক যুগের বেশী সময় পোষাকী শাসন বলবত রইলো। তবে যে সর্বনাশটা হোল তার সারমর্ম হচ্ছে ছাত্র ও যুব রাজনীতিকে ভোগ বিলাস ও ক্ষমতার হাতছানিতে মোহাচ্ছন্ন করে তাদের চেতনার মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হোল। ফলে তখন থেকে উঠতি বয়সের ছেলে যুবারা দাদাগিরির সংস্কৃতির নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। ওদিকে অখন্ড চেতনার মূল ধারার ডানপন্থী ঘরানারা নেতা-কর্মীরা ক্ষমতা পাওয়ার নেশায় মরিয়া হয়ে তারাও ছাত্র-যুবাদের শক্ত ও শক্তি বৃদ্ধির পথ অবলম্বন করলেন যা তারা কখনোই স্বীকার করবেন না। তারা তাদের ছাত্র ও যুব সংগঠনকে অর্থ-বিত্ত ও দাদাগিরির সবকে তৈরী করা শুরু করলেন এবং ক্ষমতা নেয়ার সেটাই যৌক্তিক পথ ভেবে তাদের রাজনীতির মোড়ে মাসলম্যান দাদাগিরির সুত্রপাত ঘটালেন। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে এটাই বলা যায় বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি পঁচাত্তর পরবর্তী এতদিন একপক্ষীয় মাসলম্যান দাদাগিরিতে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে রাজনীতির বনেদী পক্ষ যারা নিজেদেরকে চেতনার ধারক ও বাহক বলে বড়াই করেন তারাও আজকের দিনে ছাত্র ও যুবাদের অপশক্তির জোরেই তাদের রাজনীতির ঘাটে নোঙ্গর করে টিকে আছেন। যদি তা না হোত তাহলে আজকের দিনে তাদের ছাত্র ও যুব শাখার হাজারো অপকর্মে দেশ যেখানে জর্জরিত তারপরেও কেন আজ মুখে কুলুপ লাগিয়ে সেই বনেদি রাজনীতি আজ বোবা হয়ে আছেন?
আজকে এদেশে রাজনীতির মূল কাঠামো দুটি ধারায় বিভক্ত। যারা রাজনীতি করেন তারা এটাকে ধারা বলতে নারাজ। তাদের ভাষায় এটা পক্ষ বিপক্ষের ফ্যাসদ। একপক্ষ বাঙালী অন্য পক্ষ বাংলাদেশী। বাঙালী ওয়ালারা বলছেন মহান নেতার একছত্র আধিপত্যে এবং তার অঙ্গুলি নির্দেশ ও তাদের দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তারা দেশ স্বাধীন করেছে। সুতরাং সব কৃতিত্ত্ব তাদের। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যখন ঘোষনা পাঠের মুক্তিযোদ্ধা তার রাজনীতির খাতা খুললেন এবং নিজেকে বাংলাদেশী তক্মায় সেঁটে দিলেন তখন তাঁর তাবুতে দলমত নির্বিশেষে সবাই জায়গা করে নিল। ফলে অখন্ড চেতনার দলটি তাদেরকে খন্ডিত চেতনার ধারক হিসাবে মনে করলো। যদিও চেতনাটি শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে তারা মনে প্রানে বিশ্বাস করে। কিন্তু এটা তো সত্য যে জাতীয়তাবাদীদের জন্মের আগে ছিটেফোঁটা বামপন্থীয় ধারা ছাড়া এদেশের রাজনীতি একটি স্রোতেই বহমান ছিল। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা নিয়ে দ্বিতীয় স্রোতের জন্ম যখন হলো সেটা তো পঁচাত্তর পরবর্তীর ঘটনা। যাহোক এই দুটি দল যখন দেশের রাজনীতিতে দ্বিমুখী স্রোত তৈরী করে বিদ্যমান হলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মধ্যে অস্তিত্বের লড়াইয়ে মাঠে থাকতে হয়েছে। এবং যেহেতু ছাত্র ও যুবারাই মাঠ গরম ও দখলের প্রধান হাতিয়ার তাই আমাদের রাজনীতি তখন থেকে এই টিন এজার ও উঠতি যুবাদের মাসল পাওয়ারকে কাজে লাগানোর ব্যাপারেই মনোযোগী হয়েছে বেশী। ফলে ছাত্র ও যুব সমাজের হাতে লড়াইয়ের দন্ডটি ধরিয়ে নিশ্চিন্তে এবং নিরাপদে রাজনীতির ফায়দা নিতে মনোযোগী হয়েছে এই দুটি পক্ষ। সেক্ষেত্রে রাজনীতির স্থায়িত্ব বা দেশের বুনিয়াদ বিনষ্টের কথা তখন তাদের কাছে গৌন হয়ে পড়েছে।
একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর আলোকপাত না করলেই নয়। আমরা এখন পারিবারিক উত্তরাধিকারের বা ফেমিলি ডাইনেষ্টির রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছি। সে উত্তরাধিকারের আলোকরশ্মি দ্বিতীয় প্রজন্মের পর তৃতীয় প্রজন্ম ধরে রাখতে পারবে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া ফেমিলি ডাইনেষ্টির আবহে গা ভাসানো বর্তমান রাজনীতির মুখ্য নেতারা হাল ধরার পর্যায়ে আছে বলেও কেউ মনে করে না বা তাদের গ্রহনযোগ্যতার বিষয়টিও আলোচনায় এসে যায়। কেননা ফেমিলি ডাইনেষ্টিকে কোটেশনে রেখে রাজনীতির প্রথম সারির নেতা কর্মীরা তাদের আধিপত্য ও অন্যান্য খবরদারির বিষয়গুলি যেভাবে ছাত্র-যুবাদের দাদাগিরির মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রন করেন তাতে করে এক উঠানে বসে রাজনীতি করা তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবেনা বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। ফলে আধিপত্য বিস্তার, দখলদারি ও হানাহানির ফলে দেশব্যাপী রাজনীতিতে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হবে। সেক্ষেত্রে মার-দাঙ্গা, লগি-বৈঠা, পেট্রোল বোমা ইত্যাদির প্রতিকুলতা সত্বেও চলমান অসহনীয় গণতন্ত্রের অবসানে বাংলার ভাগ্যাকাশে কি আছে তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? তাহলে আমাদের দৌড়ের দম কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? মন্দের ভাল এই গণতন্ত্রের আয়ু আর কতদিন? এটা নেহাতই কি একটা আশংকা না দুঃস্বপ্ন!
মনে রাখা প্রয়োজনঃ রাজনীতির আঙ্গিনায় নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও শুদ্ধাচারের সংস্কৃতির অনুশীলন ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মাহেন্দ্রক্ষনে আমরা এখন অবস্থান করছি। চারিদিকে ঘটে যাওয়া অনৈতিক, অমানবিক, অসহনীয় ও দুর্বিনীত ঘটনাগুলিই সে সবের ইঙ্গিত দিচ্ছে।