জালাল উদ্দিন আহমেদ
উন্নয়নের সাতকাহন
প্রকাশ: ১০:০৪ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০৬:৩৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আজকাল যা কিছু ভাবি, যা কিছু নিয়ে লিখতে চাই সবখানেই জট পাকিয়ে যায় । ভাল কিছু আসতে চায় না। পজেটিভ বেরোতেই চায় না। আসলে নেগেটিভের অসামঞ্জস্যতায় জনপদের গলিপথগুলো যখন পোঁকা-মাকড়ে কিলবিল করে তখন ভালো জিনিসের ঝলকানি ছানি পড়া চোখের দৃষ্টিতে ধরা দেয়। ভালোকে পিছনে ফেলে ইদানীং মন্দটাই সামনের সারিতে চলে এসে তার ঔজ্জ্বলতা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর উপাদান গুলোর কোন্ গলিপথে উজ্জ্বলতা আছে তা কি কেউ বলতে পারবেন! মূল চাহিদার অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের পর অন্যান্য যেসব উপাদান নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো তার চলার পথে মসৃণভাবে হাঁটাচলা করবে তার কোনটিকে কি আমরা অক্ষত রেখেছি? মুক্ত বাংলার সমাজবদ্ধ জীবনের কোন্ গলিপথে বাঙালী মুক্ত নিঃশ্বাসে তার জীবন জিগ্যাসায় স্বাচ্ছন্দ বিচরনে আছেন – কেউ কি বলতে পারেন!
রাষ্ট্র কাঠামোর সার্বভৌমত্ব, রাজনীতির স্বচ্ছ ও শুদ্ধ আচরণ, রাষ্ট্র নীতির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা, আইনের প্রয়োগ, শিক্ষার বাস্তবতা, স্বাস্থ্য খাতের দৈনদশা, কৃষিপন্য বিপনন, সড়ক পথ, জলপথ, নদী ভাঙ্গন থেকে শুরু করে বাংলার জনপদের কোনো উঠানে স্বস্তি ও স্বচ্ছতা আছে কি? তারপরেও বিবেক বলে তো একটা কথা আছে! সেই বিবেক খোঁচা দিয়ে বলছে – কেন দেখতে পাও না! কাঁড়ি কাঁড়ি উন্নয়নের ঝলক। কি নেই তোমার চলার গলিপথে? পেট ভরে না! চারিদিকে আলোর ঝলক। চব্বিশ ঘন্টা ঘরে বাতি জ্বলছে। পদ্মা হচ্ছে। এলিভেটর হচ্ছে। পায়রা হচ্ছে। রামপাল হচ্ছে। কর্ণফুলি টানেল হচ্ছে। রূপপুর হচ্ছে। মাথার উপর আঁকাবাঁকা ফ্লাই ওভারে ঢাকার চলাচলের গলিপথে কতই না চমক। বড় বড় ইমারত ইউরোপ আমেরিকা স্টাইলে। এই তো বছর দশেক আগেও তোমরা ইউরোপ আমেরিকা বা সিঙ্গাপুরে গিয়ে বড় বড় ইমারতের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে এনে আমাদেরকে দেখিয়ে তাদের উন্নয়নের ঝলক দেখাতে। এখন যাও না গুলশান বনানী কিংবা ধানমন্ডিতে। সেখানকার সুউচ্চ অট্টালিকার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোল। দেখাও সবাইকে কত উন্নয়ন করেছি আমরা। যাও না হাতির ঝিলে। দেখাও সবাইকে তোমাদের হাতির ঝিলের সিঙ্গাপুরীয় ঝলক। দোড়াও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে। হাতে হাতে স্মার্টফোন। বোতাম টিপলেই হাতের মুঠোই সবকিছু। ঘরে বসে বাচ্চারা ক্লাস করছে। অনলাইনে ঘরে বসে যা ইচ্ছা তাই কিনতে পারছো। এমনকি ঘরে বসে অফিস আদালতও তোমরা করতে পারছো। আর কি চাও বাঙালী! ঘরে বসে বোতাম টিপেই বিল দিচ্ছ। গ্রামের বাড়িতে বোতাম টিপে টাকা পাঠাতে পারছো। বোতাম টিপে বাবা-মায়ের সাথে ভিডিও করে কথা বলছো। তোমাদের জীবনটাইতো ডিজিট্যালাইজড অনলাইন করে দেয়া হয়েছে। জীবনে চলার গলিপথে আর কি চাই?
হাঁ, চাওয়ার কি আর শেষ আছে! বাড়ি চাই, গাড়ি চাই, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাই। ভাল চাকুরী চাই। নিরাপদে ব্যবসা করতে চাই। ছেলে মেয়েদের শিক্ষা চাই। সামাজিক নিরাপত্তা চাই। স্বাস্থ্য সেবার গ্যারান্টি চাই। মূল্য বৃদ্ধির লাগাম চাই। ভেজাল মুক্ত খাদ্য চাই। নিরাপদ সড়ক চাই। দুর্নীতি মুক্ত সমাজ চাই। ঘুষ মুক্ত প্রশাসন চাই। এই চাহিদার ফর্দ কিন্তু অনেক লম্বা। আবার না চাওয়ার ফর্দটা খুলে দেখা দরকার। সেখানেও লম্বা লাইন। সমাজ সংসারে স্বেচ্ছ্বাচারিতা চাই না। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর পরিসরে যেভাবে রাজনীতির দাদাগিরি চলছে তার অবসান চাই। পাড়া মহল্লা ও গ্রাম্য বলয়ে তরুন টিন এজারদের কলুষিত রাজনীতির পাঠ বন্ধ করে তাদেরকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে সমাজবদ্ধতার আবহ তৈরীর পরিবেশ চাই। রাজনীতির দৈনতা ও অসহিষ্ণুতার দোলাচালে সেদিনের সলু, সবজি বাজারের টোল তোলা সল্যা আজ সলিম সাহেব। চারতলা বাড়ি, গ্যারেজে গাড়ি। ঢাকা রংপুর রূটে ডজন খানেক বাস। আরো আছে। এই আছের মধ্যে ছেয়ে আছে ওরা আমাদের মাঝে। চেয়ারম্যান, কমিশনার মেয়র সবইতো ওরা। ওরাই আবার রাজনীতি ও সমাজ কাঠামোয় বড় বড় পদাধিকারী। দেশের কলুষিত রাজনীতির আঁচলে ওদের স্বাচ্ছন্দ বিচরণে আজ জনপদে চলছে নীরব আহাজারি ও হতাশা। এক সময় ওরাই এমপি মন্ত্রী হয়ে আমাদের মাথার উপর ছড়ি ঘোরান। ওদের সার্টিফিকেট নিয়ে আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। রাজনীতির কলুষিত অনুশীলনে ওরাই আজ সমাজপতি, সমাজের নিয়ন্তা। এদের দাপটে আজ বাংলার আবহমান সমাজের নৈতিক স্খলন চরম পর্যায়ে নেমে এসেছে। গ্রাম বাংলার নৈতিক আবহে পুষ্ট বংশ পরম্পরা ও গন্যমান্য মুরুব্বীদের সম্মানীয় স্থান আজ মরিচিকায় পরিণত হয়েছে। নৈতিকতার আবরনে মুড়ানো মোড়ল মাত্ববরদের স্থানীয় প্রশাসন এখন রাজনীতির প্রশ্রয়ে উঠতি বয়সীদের মাসলম্যান দাদাগিরিতে রূপ নিয়েছে। শহর নগর বন্দর গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র একই আহাজারি। উঠতি মাসলম্যান দাদাগিরিতে রাজনীতি সয়লাব হয়ে গেছে। সেখানে নীতি ও নৈতিকতা বলে কিছু নেই। সর্বক্ষেত্রে শুধু ক্ষমতার দাপট, দখলদারি আর সরকারী সম্পদের নয় ছয়।
রাজনীতির মোড়কে চাপিয়ে দেয়া এসব সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলার আবাহমান শুদ্ধতার চিরায়িত কৃষ্টি কালচারে বাংলাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। উন্নয়নের চকমকে জৌলুষে না থেকে গ্রাম বাংলার বুনিয়াদি উৎকর্ষতা বাড়ানোর মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ সংসারের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ মেরামতে কাজ করতে হবে। মানুষের মুখের অন্ন যোগানে কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন এবং তার উৎপাদনশীলতা পরবর্তী সরবরাহ ও মূল্য সংযোজনে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ফ্রেমকে মজবুত করে সাজাতে হবে। শিক্ষার সামঞ্জস্যতা আনয়নে দেশে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বাস্তবতা ও প্রায়োগিক বিচরনে জোর দিতে হবে। ঢালাও উচ্চশিক্ষার গড্ডলিকায় লাগাম দিতে হবে। যে উচ্চশিক্ষা নিয়ে উন্নত বিশ্বে গিয়ে স্নাতক পর্যায়ের অনুমোদনও মিলে না সে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর নতুন করে ভাবতে হবে। বাচ্চাদের মানবিক ও দৈহিক শ্রী বর্ধনে খেলাধুলাকে অগ্রাধিকারে নিয়ে স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলা বাধ্যতামুলক করতে হবে। মাদকাসক্তির ছোবল থেকে কিশোর ও যুব সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হলে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে খেলাধুলা বাধ্যতা মুলক করা প্রয়োজন। ছাত্র রাজনীতিতে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া রাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। সরকারী অফিস আদালতে রাজনীতির প্রকাশ্য মেরুকরন বন্ধ করতে হবে। রাজনীতির দুর্বল ও অস্বচ্ছ আচরনে আজ সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের প্রতিটি আঙ্গিনায় রাজনীতির উলঙ্গ বিচরন। ফলে বহুমত ও পথের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চর্চায় দেশ তার চলার পথে প্রতিটি পদে হোঁচট খাচ্ছে।
নব্বইয়ে সামরিক শৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে এদেশে জোট ভিত্তিক গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু রাজনীতির নেতা কর্মীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও ভোগ বিলাসের পরজীবি কর্মধারায় এদেশে তৈরী হয় বংশ পরম্পরার পারিবারিক রাজনীতির প্রচলন। আজকের দিনে বাংলার রাজনীতির চরিত্র পারিবারিক বলয়ে আবদ্ধ। চেতনার মঞ্চে বিচরন করা রাজনীতির নেতা ও কর্মীরা কিংবা শ্রেষ্ট মুক্তিযোদ্ধার সৃষ্ট তাঁবুর নীচে আশ্রয় নেয়া নেতা কর্মীরা আজ মূলতঃ পারিবারিক বলয়ের ছাতার নীচে বিচরন করা হৃষ্টপুষ্ট কতিপয় পরজীবি আদম সন্তান। পাঁচ বছর পর পর বদল হওয়া ফ্যামিলি ডাইনেস্টির এই উচ্চাকাঙ্খী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ডামাডোল কতকাল দীর্ঘস্থায়ী হবে তা জানা নেই। তবে ব্যক্তি মাহাত্ত্বের স্ফুরনে সৃষ্ট ফ্যামিলি ডাইনেস্টির শাসনের মোহে যখন ফাটল ধরে তখন সেই সুযোগটা নেয় ধর্মীয় রাজনীতির বাহকেরা (যাদের চলাফেরার সহজ পথটা তৈরী করে দিয়েছেন আমাদেরই বর্তমান ফ্যামিলি ডাইনেস্টির দুটি পক্ষ)। আজকের দিনে দেখি ফ্যামিলি ডাইনেস্টির ক্ষয়ে যাওয়া শাসন ব্যবস্থায় বিরক্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের জনগন ধর্মান্ধ রাজনীতির কোলে আশ্রয় নিয়ে যে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন সে আশংকার অশনি তো আমাদের উঠানেও কড়া নাড়ছে। এধরনের পরিবর্তন সোস্যালিষ্ট ও কমিউনিষ্ট দেশ সমূহে কিংবা শক্তপোক্ত রাজতন্ত্রের দেশেও হয়েছে বা হচ্ছে সেতো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়েই দেখিয়ে দেয়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সেসব দেশের ধর্মীয় কাঠামোয় আরোপিত শাসন ব্যবস্থার উলঙ্গ আচরন সাধারন মানুষের ভোগান্তির চিত্র কোন্ পর্যায়ে নামিয়ে আনে তা আমরা দিব্যচক্ষু দিয়েই দেখতে পাচ্ছি।
মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। মেহনতি মানুষের ভাত কাপড়ের সংগ্রাম–একটি চলমান প্রক্রিয়া । বাইশ পরিবারের সমন্বয়ে গড়ে তোলা পাকিস্থানের চকমকে উন্নয়ন একসময় গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই উন্নয়নের ভরন-পোষন করতে গিয়ে আজ পাকিস্থানের বুনিয়াদ ফোকলা হয়ে পড়েছে। আমরা সে পথে হাঁটছি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। তাছাড়া আজকের দিনের বাংলার এই উন্নয়নের ঝলক ভোগবিলাসী চাকচিক্যে আবর্তিত কিনা তার SWOT analysis করতে হবে। মোটকথা বাঙালীর বুনিয়াদ বিনির্মানের শেকড়ে হাত লাগাতে হবে। সেক্ষেত্রে উন্নয়ন নামক সাতকাহনের কবিতায় মাজন লাগাতে হবে। সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। মোটা ফ্রেমের চশমায় জন সমুদ্রে গেয়ে যাওয়া সেই মহান কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গাইতে হবে – “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম.....................” ।