জালাল উদ্দিন আহমেদ
আশার আলো
প্রকাশ: ১২:২২ এএম, ২১ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০৪:৪৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
অনেকদিন পর ঢাকার রাজপথে বের হলাম। কাজ ছিল ছোট্ট একটা। সিটি করপোরেশনের (ঢাকা উত্তর) হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হবে। কক্সবাজার থেকে ফিরে দেখি বাসায় একটা তাগিদ পত্র এসেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে। চমকে গেলাম একটু। ২০১২-১৩ থেকে এপর্যন্ত অর্থাৎ ২০-২১ পর্যন্ত বকেয়া বাবদ আমার বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা বাকী। উপ কর কমিশনার স্বাক্ষরিত এই নোটিশে একটু অবাকই হলাম। যাহোক ছেলেকে আগের রাতে বলে রেখেছিলাম – সে যেন পরের দিন অফিস যাওয়ার সময় আমাকে লিফট দেয়। কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অফিসে যেতে হবে। যথারীতি ঘর থেকে বের হলাম। রাস্তায় করোনা সংক্রান্ত কোন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার লক্ষন চোখে পড়লো না। এবং স্বাভাবিক নিয়মেই ট্র্যাফিক জ্যাম ও ইত্যাদি পেরিয়ে ছেলে আমাকে উত্তরের সিটি অফিসে নামিয়ে তার গন্তব্যে চলে গেল। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খুব ভাল না। উন্নয়নের কাজ চলছে। সুতরাং একটু আধটু অসুবিধা তো হবেই। তবে কাজ যে এগোচ্ছে তা চোখে পড়লো। ঢাকার রাজপথের মাথার উপর দিয়ে মেট্রোরেল চলবে। সুতরাং প্রাপ্তির সুবিধাভোগে একটু আধটু কষ্ট তো পোহাতেই হবে।
যাহোক, করপোরেশন অফিসে পৌঁছে প্রথমে অন্দর মহলে ঢুকার প্লান করলাম। অন্দর মহল বলতে আবার পাঠক অন্য কিছু ভাববেন না। এটা একটু রসিকতার ঢঙয়ে রঙ লাগানোর চেষ্টা আর কি। যে বড় বড় ভলিয়্যুমের খাতায় (লেজার খাতা) হিসাব নিকাশগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় সেটার কথাই বলতে চাচ্ছি। সেখানে নিজের পরিচয় এবং শ্বেত-শুভ্র অবয়বের বদৌলতে সমীহ পেলাম বলেই মনে হোল। ভদ্র মহিলা সম্ভবতঃ উচ্চমান সহকারী। উনি বেশ সমীহ করেই খাতা খুলে আমার বুক থেকে জমে থাকা ভারি পাথরটা নামিয়ে দিয়ে বললেন, “ নতুন কিছু নিয়োগ হয়েছে তো। এসব ওদেরই কাজ। খোঁজ খবর না নিয়েই এসব করা হয়েছে। সমস্যা নেই। আপনি এবছরের ট্যাক্সটা দিয়েই চলে যান। আমি আরএসকে(রেভিনিউ সুপার ভাইজার) বলে দিচ্ছি। সব ঠিক আছে”। যাহোক ভদ্র মহিলার ব্যব্যহারে মনটা ভাল হয়ে গেল। বাৎসরিক ট্যাক্সের টাকাটা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু যে ভিড় এবং মানুষের হৈচৈ তাতে আর লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দিতে মন চাইলো না। একবার ভাবলাম স্বাক্ষর দিয়ে চিঠি পাঠানো সেই উপ কর কমিশনারের কাছে গিয়ে তার অদূরদর্শিতার কথাটা তাকে একবার জানিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু সেপথে না হেঁটে বাড়ি ফেরার মনস্থির করলাম। কিন্তু মনটা খচ খচ করতে থাকলো। কি যেন অপুর্ণ থাকলো বলে মনে হচ্ছে। যাহোক দোতলা অফিস থেকে নামার পথে দেখলাম অফিসের বড় কর্তার নাম সম্বলিত পিতলের প্লেটে লেখা রয়েছে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি সম্ভবতঃ উপসচিব পদমর্যাদার অফিসার। কোন কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম তার রূমে। খুব ব্যস্ত। বসতে বললেন। ফাইলের কাজ সেরে আমাদের দিকে মনোযোগ দিলেন। আমাদের বলছি এই কারনে যে সেখানে আরো দু তিনজন দর্শনার্থী ছিলেন। আমি নিজের পরিচয় দেয়াতে তিনি আমাকে বেশ সমীহ করেই কথা বললেন এবং কোন কাজ বা সাহায্যের প্রয়োজন কিনা তা জানতে চাইলেন। আমি বললাম না, স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাৎ। দশ বছর হোল অবসরে আছি। মনে হোল একটু দেখা করা দরকার। তাছাড়া যে কাজে এসেছি তা সমাধান করেই এসেছি। লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোক বেশ বিনীত ও ভদ্রভাবেই তার সময়টুকু আমাকে দিলেন। আপ্যায়নও করাতে চাইলেন। কিন্তু করোনার অজুহাতে আমি তা সবিনয়ে এড়িয়ে গেলাম। এসব কথাগুলো উচ্চারণ করার জন্য আমি কলম ধরি নি। কথাগুলো বললাম এই কারনে যে, পাবলিক সার্ভেন্টরা পাবলিক সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে এধরনের পজিটিভ মন ও মানসিকতায় যে কাজ করছেন তার ছবি উপস্থাপনের জন্যই আমার এই অবতারনা। ভাবলাম হয়তো সরকারী কর্মকান্ডের পুর্বসুরী হিসাবে তিনি আমাকে সমীহ করছেন। কিন্তু না, অন্যসব সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সাথেও তিনি ডেক্সের সম্মান রক্ষার্থে যা করার দরকার সেভাবেই কথা বলছেন। সুতরাং প্রফুল্ল চিত্ত নিয়েই আমি করপোরেশনের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম এবং কারওয়ান বাজারের ভিড়ে মিশে গেলাম।
কারওয়ান বাজারের বিশালতায় মনটা ভরে গেল। তাজা সবজি ও ফলমুলে কারওয়ান বাজারের রাস্তাটিই যেন বাজারে পরিণত হয়েছে। মনে হোল সবকিছু কিনে নিয়ে বাসায় ফিরি। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের বিষয়টির সামঞ্জস্যতায় এক কেজি আপেল ,এক কেজি কমলা এবং এক’শ টাকায় তিনটি বাতাবীলেবু কিনে দুহাত বন্দি করে সোনারগাঁ হোটেলমুখী হাঁটা শুরু করলাম। ডানপাশে বিআরডিবির অফিস। বিআরডিবি অফিসে বহুবার এসেছি। আমার মেজ ভাই নাজিম উদ্দিন আহমেদ সেখানে চাকুরী করার সুবাদে আসা হোত। মেজ ভাই সেই প্রতিষ্ঠানে প্রজেক্ট অফিসার হিসাবে তার চাকুরী জীবন শুরু করে পরিচালক হিসাবে তার চাকুরী জীবন শেষ করেন ২০০৯ সালে। কত স্মৃতি মনে পড়ে। বায়ে রাস্তার উল্টো পথে ইপিবির অফিস। সরকারী মিটিং করতে বহুবার আসা হয়েছে সেই অফিসে। আবার সরকারী প্রতিনিধি হয়ে সামনের এই সোনার গাঁ হোটেলেও তো কম আসা হয়নি। এখনও আসি। তবে কর্মকর্তা হিসাবে নয়। চুল দাড়ি পাকা বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বিদেশী সাহায্য সংস্থার কনসালটেটিভ মিটিং বা সিমিনারে সেখানে আসতে হয়। এবং তা অবশ্যই নিজের বিদ্যের শিল্প বিশেষজ্ঞ হিসাবে। যাহোক হাঁটতে হাঁটতে সার্ক পয়েন্টের উত্তর পশ্চিম কোনে এসে দাঁড়ালাম। বাস ট্যাক্সি বেবি যা পাই তাতেই উঠে মোহাম্মদপুর বাসার দিকে রওয়ানা দেয়ার আশায়।
ভীড়ের জট কাটিয়ে কোন রকম বাস স্টান্ড পয়েন্টে দাঁড়ানো গেল। কিন্তু গোল বাঁধলো অন্য কিছু। সত্যি কথা বলতে কি, ঢাকার রাস্তায় না বেরোলে অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ অজ্ঞ থেকে যায়। হাতের বোঝা দুটি নামিয়ে ফুটপাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। বাসের যা অবস্থা তাতে হাতের ফলমুলগোলো সামলাবো না পকেটের ম্যানিব্যাগ সামলাবো কিংবা স্টেপ আপ করে বাসে উঠবো এসব চিন্তা করে বাসের আশা ছেড়ে বেবি ট্যাক্সির আশায় চোখ ঘুরালাম। কিন্তু বেবিট্যাক্সির স্বল্পতায় নিরাশ হলাম। বেবি পাওয়া যাচ্ছে মাঝেমধ্যে কিন্তু ভাড়া শুনে চোখ কপালে উঠার অবস্থা। বড়জোর চার কিলো মিটারের রাস্তা। ভাড়া চাওয়া হচ্ছে দু’শ টাকা। আজকাল মোটর বাইকের প্রচলনও বেশ ব্যপক। এবং আমার ওই দাঁড়ানোর চারিদিকে প্রায় গোটা বিশেক মটর বাইক ঘুর ঘুর করছে। আমাকে জিগ্যেস করার সাহস দু-চারজন ইতিমধ্যে করেই ফেলেছে। লক্ষ্য করলাম সব স্মার্ট শিক্ষিত ছেলেপিলে। আঙ্কেল কোথায় যাবেন? যা দিবেন চলেন ইত্যাদি সব কথাবার্তা। তাদের বিনয় ও ব্যকুলতা দেখে মনটা বিচলিত হয়ে পড়লো। সব শিক্ষিত, স্মার্ট এবং ওয়েল ড্রেসড। শুনেছি এরকম সাত থেকে দশ লক্ষ মোটর বাইক ইদানীং ঢাকার রাস্তায় চালু আছে। সবচেয়ে খারাপ লাগলো এই কারনে যে তাদের অনুরোধে আমি সাড়া দিতে পারলাম না। কারন আমার দুহাতের বোঝা নিয়ে অতদূর বাইকে চড়ে যাওয়া আমার এই বয়সে পারমিট করে না। দু’একজন যখন অত্যধিক অনুনয় বিনয় করলো তখন হাতের বোঝা দেখিয়ে তাদেরকে নিবৃত করার চেষ্টাও করলাম। অবশেষে একটি বেবি ট্যাক্সি ঠিক করে তাতে উঠার চেষ্টা করছি। লক্ষ্য করলাম সে সময়টাতেও একটা ছেলে বাইক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল এবং অনুরোধের সুরে বললো আসেন আংকেল ,ভাড়া যা মন চায় দিবেন। আমার অপ্রাগতা প্রকাশ করে বেবি ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম এবং ফেরার পথে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। ভাবতে ইচ্ছে না করলেও মনে মনে ভাবতে থাকলাম। এই যে এত হাজার হাজার ছেলে আজকে রাস্তাঘাটে জীবন ও জীবিকার তাড়নায় তাদের শ্রম খাটাচ্ছে তা শ্রম বাজারের ব্যাপকতায় নগন্য হলেও একটা প্রচ্ছন্ন জিগ্যাসা চিহ্ন নিয়েই তা কিন্তু চালু রয়েছে। কেননা শিক্ষা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকিকরনের ফলে যেদেশে ফি বছর কয়েক লক্ষ যুবক গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরোচ্ছে তাতে সামনে আরো অনেক বিকল্প হয়তো আমরা শ্রম বাজারে দেখতে পাব । তবে এটা কোন নেগেটিভ খবর নয়। এটাকে পজিটিভ ভেবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কারণ হিসাবে বলতে ইচ্ছে করে আমাদের যুবকরা যখন ডিগ্রী বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গ্রাজুয়েট হয়ে পাশ্চাত্যে গিয়ে সেসব দেশের হোটেল রেস্তোরা কিংবা ক্ষেতে খামারে কাজ করে তখন কিন্তু আমাদের ওই শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত কর্মীর ভ্যালু এডিশ্যান থেকে দেশ বঞ্চিত হয়। সুতরাং শিক্ষিত কর্মী আমাদের শ্রম বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এটা ভাল খবর।