জালাল উদ্দিন আহমেদ
ট্র্যাজিডি
প্রকাশ: ০৯:০৫ পিএম, ১২ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ১১:১৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ঘটে যাওয়া কোন বিয়োগান্তক ঘটনায় জীবন বা সম্পদ ধ্বংস হওয়ার অপর নাম ট্র্যাজিডি। বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে ট্র্যাজিডির ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন রূপে আসে। কখনো সেটা বিশাল ধংসাত্মক ঘটনার রূপ নিয়ে সমাজ কাঠামোয় নাড়া দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারকদেরকেও বিচলিত করে ফেলে। কখনও কখনও তা আবার নিয়মিত গদবাঁধা নিয়মেই বছরের নির্দিষ্ট সময়েই ঘটে থাকে। এই যেমন পাহাড় ধ্বসে জনপদের জীবন হানি কিংবা নদী ভাঙ্গনে জনপদ ও সম্পদের বিরান হওয়ার ঘটনা। অথবা ধরুন ফি বছর ঘটে যাওয়া ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডব যেমন আইলা, নার্গিস, সুনামীদের প্রাকৃতিক হানা। মনুষ্য সৃষ্ট ট্র্যাজিডির ঘটনাগুলোই সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় দাগ কাটে বেশী। যেমন ধরুন নিমতলি ট্র্যাজিডি, তাজরিন ট্র্যাজিডি কিংবা রানা প্লাজা ট্র্যাজিডি। রাষ্ট্র ও সমাজে এই ট্র্যাজিডিগুলো সামাজিক শৃংখলায় ক্ষত সৃষ্টি করে। ফলে সমাজ শৃংখলায় আহাজারির একটা লম্বা রেশ টেনে নিয়ে যায় এই ট্র্যাজিডিগুলো। আচ্ছা! ফি বছর ঘটে যাওয়া বন্যা তান্ডবকে আপনারা কোন ট্র্যাজিডিতে ফেলবেন? সেটাও বাংলার জনপদে এক অমানবিক তান্ডব ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয়। মানুষ গৃহহারা হয়। ঘরবাড়ি ও সম্পদের বিনাশ হয়। এই বন্যার কারনে ফি বছর এদেশের কয়েকটা চিহ্নিত এলাকার মানুষ গৃহহীন ও সর্বহারা হন। আবার ধরুন ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের যে ট্র্যাজিডি পালা করে ঘটে তার বেলায় কি বলা যায়! সেক্ষেত্রেও তো জীবন হানি ও সম্পদ হানির ঘটনা ঘটে.। এবং তা একটা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়েই সংঘটিত হয়।
আসুন এখন মনুষ্য সৃষ্ট ট্র্যাজিডির কথায়। কোথায় হাত লাগাবো। মুনির –তারেক দুর্ঘটনার সেই মর্মান্তিক মৃত্যুটা কি ছিল? সারা বাংলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রত্যহ ডজন খানেক প্রাণ ঝরে যাওয়া কোন ট্র্যাজিডিতে পড়ে? এইতো কদিন আগে সদর ঘাটে একটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় ছোট লঞ্চটি ডুবিয়ে চল্লিশ জনের যে সলিল সমাধি ঘটানো হোল – সেটাই বা কোন পর্যায়ের ট্র্যাজিডি। কাটমন্ডুতে ঠিকমত ল্যান্ডিং করতে না পারা ইউ এস বাংলা বিমানের দুর্ঘটনায় পড়ে কয়েক ডজন মানুষের প্রানহানি হওয়াটাও তো একটি ট্র্যাজিডি। মনে পড়ে! গত শতাব্দীর আশির দশকে জাপান এয়ার লাইন্সের ঢাকার কুর্মিটলায় ঘটে যাওয়া হাইজ্যাকিং ও কতগুলো তাজা প্রাণের ঝরে যাওয়ার ঘটনা। সেদিনের সেই ট্র্যাজিডি বাংলাদেশের গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কয়েকদিন ধরে তটস্থ রেখেছিল। ইদানীংকার গার্মেন্টস শিল্প সমৃদ্ধ রানা প্লাজা ধ্বসে হাজারের উপর নিহত হওয়া কিংবা তাজরিন গার্মেন্টসের আগুন বিভিষিকায় যে কয়েক’শ প্রাণহানি ঘটালো তা মানব ইতিহাসের জঘন্যতম ট্র্যাজিডি নয় কি? অবশ্য ওই ঘটনা দুটি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আর এম জি সেক্টরের শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছে এই দুটি ট্যাজিডি। ফলে শৃংখলার উত্তরনে গার্মেন্টস শিল্প আজ মাথা উঁচু করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরো সুবিধাজনক স্থানে তার অবস্থানকে পোক্ত করেছে। বাংলার এই অল্প বয়সী নির্ঘন্টে আমরা সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক ও আরো অনেক ট্র্যাজিডির জীবন্ত সাক্ষী।
ফারাক্কাও তো একটা ট্র্যাজিডি। ফারাক্কার কারনে উজান ও ভাটির দুদিকেই যে হাহাকার ও জনপদ বিনাশের খবর পাওয়া যায় তাকে কি বলা যায়? এটা রাষ্ট্রীয় না আন্তঃরাষ্ট্রীয় ট্র্যাজিডি! প্রতিদিন বন্ধু রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে দু-একজন করে বাঙালীর প্রাণ ঝরে পড়ছে। এটা কোন ট্র্যাজিডি? লক্ষ প্রানের বিনিময়ে প্রাপ্ত সদ্য স্বাধীন দেশে প্রথম গোলাগুলির (ভিয়েতনাম দিবসের ১লা জানুয়ারী) সেই ১৯৭৩ সালের কথা কি আমরা ভুলে গেছি? রক্তস্নাত স্বাধীনতার পর প্রশাসনের বন্দুক থেকে প্রথম বেরিয়ে আসা গুলিতে সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাজা কয়েকটি প্রাণের ঝরে পড়াটা কি একটি ট্র্যাজিক ঘটনা নয়! ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে দেশের প্রথম ক্রস ফায়ারে সর্বহারা নেতা সিরাজ শিকদারের হত্যাটা কি আমাদের রাজনৈতিক ট্র্যাজিডি নয়? আর বিংশ শতাব্দীর কলঙ্কময় হরফে লেখা পনেরোই আগষ্টের ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ডে যেভাবে আমার দেশের স্থপতিকে তার পরিবার পরিজন্সহ নৃশংশভাবে নিশ্চিহ্ন করা হোল তাকে কি বলা যায়। বাঙলা ও বাঙালীর জীবনে ওটাই হবে ঘৃণ্যতম ট্র্যাজিডির নাম। ১৫ আগষ্ট পিতৃ হত্যা ঘটলো। আরো যেসব ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটিয়ে বাঙালীকে নেতৃত্ব শুন্য করার মাস্টার প্লান ওই অল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা হোল সেসব ট্র্যাজিডির কথা বাঙালী কোনদিন ভুলবে না। নেতৃত্বের হাল ধরার লাইম লাইটে থাকা শেখ মনি ও শেখ কামালকেও মারা হোল। মেরে শেষ করা হোল নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে থাকা চার নেতাকে। সেইসব ট্র্যাজিডি বাঙালীকে কয়েক দশক পিছনে ফেলে দিল।
আজকের দিনে মক্তিযোদ্ধাদের নামে যেভাবে অনুপ্রবেশ ঘটছে – সেটাও এক ধরনের ট্র্যাজিডি। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সুর্য সন্তান। তাদের নামের পাশে নাম লিখিয়ে কিছু উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতার লেজুড়েরা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সবটুকু শুষে খাচ্ছে – সেটাও তো বাঙালীর চেতনার ট্রাজিডি। পাশাপাশি ক্ষমতার দম্ভে নিজেদের রাজনীতির শিকড়কে পোক্ত করার মানসে ভিন্ন মতবালম্বী দেশের সেরা মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার আলবদরের খাতায় ফেলে দেয়া – সেটাও তো ট্র্যাজিডি। মুসলিম প্রধান স্বাধীন বাংলার বাঙালীর দেশে কাউকে খুশী করা বা সীমান্ত পারের সুবাতাস পাওয়ার জন্য নিজেকে অতিরিক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ প্রমানের নিরন্তর চেষ্টাকেও তো আমরা ট্র্যাজিডি বলতে পারি।
আর কত ট্র্যাজিডির কথা বলবো। বাঙালী তার জন্ম লগ্নের পর হতে একটার পর একটা ট্র্যাজিডির কবলে পড়েছে। মনে পড়ে কি পহেলা বৈশাখের সেই উদিচি ট্র্যাজিডির কথা! বাঙালীর সাংস্কৃতির ঐতিহ্যের উপর সেই বীভৎস বোমা হামলা বাঙালী কি কোনদিন ভুলতে পারবে! কিংবা ২১ আগষ্টের রমনা ভবনের জনসভায় গ্রেনেড হামলার রাজনৈতিক বীভৎসতা বাঙালী ভুলে কেমন করে। আবার শাপলা চত্তরে হেফাজত অন্দোলনের মৌলভীদের উপর ৫ জানুয়ারীর পুলিশি হামলার সেই বর্বরতা কোন ট্র্যাজিডির সংজ্ঞায় ফেলা যায়! যে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষ বাঙালী প্রান বিসর্জন করলো সেই স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন বাংলায় আবারো বুকের তাজা রক্ত ঝরাতে হোল। ডাঃ মিলন, নুর হোসেন বা জেহাদরা যেভাবে বুকের রক্ত দিয়ে বাংলায় গণতন্ত্র পুনঃরতিষ্ঠা করলো সেটা কি ট্র্যাজিডি নয়? বাংলার এই পুন্য ভূমিতে এধরনের ট্র্যাজিডি পালা করে ঘটে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীহলে ঢুকে ছাত্র নেতা কর্তৃক সাতজন ছাত্রীকে ব্রাস ফায়ার করে হত্যা করা কিংবা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকা ছাত্র সগঠনের নেতার বিশ্ববিদ্যালয় হলে শত ধর্ষনের সেলিব্রেশন – এসবগুলোও তো ট্র্যাজিডি।
সত্য কথা বলতে কি, সম্প্রতি নারায়নগঞ্জে ঘটে যাওয়া মসজিদের এসি ব্লাষ্ট বা গ্যাস ট্র্যাজিডির চিন্তা নিয়েই আমার এই কলম ধরা। কিন্তু নারায়নগঞ্জের মসজিদে নামাজরত মুসুল্লীওদের উপর যে ট্র্যাজিক গজবটা পড়লো তা ছিল মনুষ্য সৃষ্ট ট্র্যাজিডি। নারায়নগঞ্জ ট্র্যাজিডির কথা লিখতে গিয়ে বাংলায় ঘটে যাওয়া অন্যান্য ট্র্যাজিডিগুলি কিলবিল করা শুরু করলো। ফলে যতটুকু পারলাম উদ্গীরণ করলাম। তবে নারায়নগঞ্জের মসজিদে নামাজরত মুসুল্লীদের উপর যা ঘটলো তা ছিল ইদানীংকার ঘটে যাওয়া ট্র্যাজিডির অন্যতম ভয়াবহতম এক বিয়োগান্তক ঘটনা। এপর্যন্ত তিরিশ জনের মৃত্যুর খবর আমরা জেনেছি। সেদিনের ঘটনার লাইভ টেলিকাষ্টে যা দেখলাম তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে মসজিদের নীচে থাকা গ্যাসের পাইপলাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস মসজিদের ফ্লোরে এমিশন বা উদ্গীরন হচ্ছে। সম্ভবতঃ সেই গ্যাস মাটি ভেদ করে মসজিদের ভিতরেও প্রবেশ করে। এবং এয়ার টাইট মসজিদ ঘরে সেই গ্যাস তার ঘনত্ব বাড়িয়ে এক সময় তা গোটা মসজিদটাকে গ্যাস গহ্বরে পরিণত করে। ধারনা করা যায়,মসজিদের এসিগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগের ছোটখাট গাফিলতির সুযোগে তা গ্যাসীয় সংস্পর্শে এসে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার সুত্রপাত ঘটাতে পারে। একটি কথা এখানে সচেতন সকল মহলকে নাড়া দিয়েছে। টিভি সাংবাদিক যখন স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন তখন এক যুবক তার সাক্ষাৎকারে বললেন “গ্যাস লিকেজের কথা তিতাসকে কয়েকবার বলা হলেও তারা কোন কর্ণপাত করেনি। বরং পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দিলে তারা ব্যবস্থা নিবে বলে জানিয়েছে”। সত্যই দুর্ভাগ্যজনক। এ কোন দুর্ভাগা দেশে আমাদের বসবাস! করোনা মহামারী দিয়েও মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের বোধদয়কে নাড়া দিতে পারেন নি। আর কতবড় মহামারী হলে আমাদের বোধদয় নৈতিকতার আলো ছড়াবে - বলতে পারেন? দুনিয়া কাঁপানো দুর্যোগ মহামারীতেও মানুষ যখন মনুষ্য আচরনে থাকে না তখন মহা প্রলয়ের শিঙ্গা বাজতে আর বেশী দেরী নেই,বললে ভুল হবে কি?