জালাল উদ্দিন আহমেদ
কোন গলিপথে আমরা – শেষ পর্ব
প্রকাশ: ১১:৪০ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২০ | আপডেট: ০১:৪৯ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
( রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের গলিপথগুলো আস্তেধীরে সরু হয়ে যাচ্ছে। ফলে যোগানের অপ্রতুলতায় রাষ্ট্র কাঠামোর প্রশস্ত রাজপথ আজ খানা-খন্দরে ভরে যাচ্ছে। আজ ৩য় ও শেষ পর্ব প্রকাশ করা হলো। ১ম ও ২য় পর্ব প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২/৯/২০২০ এবং ৫/৯/২০২০)
সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় মানুষ হচ্ছে প্রথম ও প্রধান উপাদান। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে জনপদ সৃষ্টি করে। জনপদের সমন্বিত আয়োজনেই সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে। সর্বোপরি চাহিদার নিরিখে সৃষ্ট ভিন্নধর্মী গলিপথের সমন্বিত প্রয়াস ও সমাজ কাঠামোর শৃংখলেই সৃষ্টি হয় একটি মজবুত রাষ্ট্র কাঠামো।
সদ্য বা নবীন রাষ্ট্র বলতে বলতে আমাদের বয়স কিন্তু অর্ধ শতাব্দী ছুঁই ছুঁই করছে। আর কত বছর পেরোলে আমাদের এই নবীন রাষ্ট্রের তকমাটা কাঁধ থেকে নেমে যাবে তা আমার জানা নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষরনের পর সেই তারুন্যে যখন সদ্য স্বাধীন দেশে আমাদের পদচারনা শুরু হোল তখন থেকেই কোন এক অশুভ ছায়ার অনুপ্রবেশে এই জনপদের চলার গলিপথগুলো কলুষিত হওয়া শুরু করলো। সমাজবদ্ধতার আবহমান অনুশীলনে সরল প্রকৃতির বাঙালী শান্তিপ্রিয় জাতি হিসাবেই পরিচিত। ফলে হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন জাতি স্বত্ত্বার অনুপ্রবেশে বাঙালী শোষিত ও শাসিত হয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাঙালী তার আপন উঠান তৈরী করেছে। স্বাধীন স্বত্ত্বা নিয়ে বাঙালী আজ নিজেই নিজেকে শাসন করে। নিজের শাসন কাঠামো নিজেরাই তৈরী করে। আপন স্বত্ত্বায় বাঙালী আজ তার সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতি, প্রশাসন, আইন ও অন্যান্য চলার গলিপথগুলো নিজের মত করে সাজিয়ে নিচ্ছে।
লক্ষ্য করা যায় ভৌগলিক রাষ্ট্র কাঠামোর আপন অস্তিত্বে বাঙালী তার চলার গলিপথে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। রাজনীতির দৈউলিয়াপনা রাষ্ট্র কাঠামোর মজবুত অবস্থানকে মাঝে মধ্যে সংশয়ে ফেলে দিচ্ছে। ফলে এই পঞ্চাশ বছরের অল্প সময়ে আমরা দেখেছি রাজনীতির উঠানে বিরাজনীতি করনের অনুশীলন ও অন্যান্য অশুভ শক্তির পদচারনা। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির অপরিণত রাজনীতির হাঁটা চলায় অক্ষ শক্তির স্বাধীনতা বিরোধীরা স্বাধীন বাংলার রাজনীতির গলিপথে নিজেদের চলার পথ তৈরী করে নিয়েছে। ফলে চেতনার রাজপথে বাঙালীর বাঙালীয়ানা বার বার হোঁচট খেয়েছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে যেভাবে বাণিজ্যিকিকরনের হিড়িক পড়েছে তাতে করে রাজনীতির নৈতিকতা ও সহমর্মিতার আদর্শিক স্থানটুকু আস্তেধীরে উবে যাচ্ছে। এর ফলে রাজনীতির গলিপথে তৈরী হচ্ছে যত সব অস্বাভাবিক আচার আচরণ যার চুড়ান্ত রূপ নিয়ে আজকের দিনে রাজনীতির রাজপথে সৃষ্টি হয়েছে ফ্যামিলি ডাইনেস্টির এক শক্ত ভিত।
শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতির আঙ্গিনায় আমাদের বর্তমান সময়ের চলার পথ মোটেই মসৃন বলে মনে হয় না। শিক্ষা ব্যবস্থায় বার বার কাটাছেঁড়া ও গোল্ডেন এ প্লাসের মূলা ঝুলানো মুখস্ত বিদ্যায় আমাদের তরুন প্রজন্ম তাদের বুনিয়াদ বিনির্মানে সামনের সারিতে আসতে পারছে বলে মনে হয় না। শিল্প সংস্কৃতির আপন আঙ্গিনায় বাঙালী সবল হলেও ইদানীংকার ‘দাদাময়’ চলনে আমাদের শিল্প সংস্কৃতি কিছুটা হলেও যে ঝুলে পড়ছে তা কিন্তু চোখ বন্ধ করে বলাই যায়।
অর্থনীতির লুটেরা সংস্কৃতি ইদানীং বেশ প্রকটভাবেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। অর্থনীতির নয়ছয় চালচলন আজ দেশের অর্থনীতির প্রতিটি শাখা প্রশাখায় ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়েছে। লুটেরাদের খপ্পরে পড়ে দেশের ব্যাংক বীমা শেয়ার বাজার সর্বক্ষেত্রে ক্রন্দনের আহাজারি। রাজনীতির বাণিজ্যিকিকরনের ফসল এটি। বাণিজ্যের গনেশীয় রূপ আজ রাজনীতির হাটুরে সেজে বাংলার আইন প্রনেতার উঠানে সপ্রভ।
ইদানীংকার করোনা মহামারী তো আমাদের স্বাস্থ্ব্য খাতের সাতকাহন জানিয়েই দিল। এই খাতের গলিপথ যে এত কন্টকময় তা আমরা করোনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। হাজার হাজার কোটি টাকার নয়ছয়ে গড়ে উঠা গ্রাম ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো দেশের সাধারন মানুষজনের জন্য কতটা অসহায় তা করোনা প্যান্ডেমিক না হলে আমরা জানতেই পারতান না। আবার জানতে পারলাম ডাক্তাররা কেন ডাক্তার না হয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চান তার খতিয়ান। কিংবা এই বিভাগের অলিগলির ঘুনে ধরার সাতকাহন।
বিদেশ নীতির পরনির্ভরশীলতা আমাদেরকে কতটা অসহায় করে রাখে তার প্রমান পাই যখন দেখি বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে প্রতিদিনই দু একটি বাঙালীর জীবন সীমান্তে ঝরে পড়ে। একসময় দেখেছি শত্রু রাষ্ট্রের প্ররোচনা ও মধ্যপ্রাচ্যীয় ধনকুবের রাষ্ট্রগুলোর অর্থ যোগানে দেশে ইসলামীকরনের তোড়জোড়। ফলে বাঙালী নিজস্ব স্বত্ত্বা ভুলে সেই পুরনো পাকিস্থানী জোশে আবার নিজেদেরকে ঘষে মেজে নেয়ার প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে। আবার এখনকার সময়গুলিতে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রটির সমমনা হয়ে চলার পথে সাধারন মানুষজনের নেগেটিভ এপ্রোচ ও চলন বলনের শ্লেষাত্মক উদ্গীরন। সুতরাং কাঠামোগত অবস্থানে যখন আপন অস্তিত্বের বাঙালীয়ানাই উপেক্ষিত হয় তখন চলার গলিপথে রক্তক্ষরন যে হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
রাষ্ট্র কাঠামোর চলার গলিপথে প্রশাসন ও আইন শৃংখলার প্রয়োগ ও তার ব্যবহার একটি মুখ্য ও বিবেচ্য বিষয় বলে গন্য করা হয়। সেক্ষেত্রে আমার দেশের প্রশাসনিক বিন্যাসের স্বচ্ছ্বতা ও তার প্রায়োগিক ব্যবহারের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। প্রশাসনিক বিন্যাসে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার দৈনতা চোখে পড়ার মত। যেখানে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় গ্রাম্য আবহে স্বস্তি আসার কথা সেখানে কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও শাসনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে স্থানীয় প্রশাসকেরা ভোটহীন গনতন্ত্রের মোড়ল সেজে গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের কাছে মুর্তমান আতংক হয়ে আবির্ভূত হন। অপরদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও আইন শৃংখলার কতিপয় অতিভোগী মানুষ রাজনীতির বরকন্দাজ সেজে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গলিপথে আহাজারির বীজ ছড়িয়ে দেন। ফলে অনেক সময় তা সমাজের অস্তিত্বের কাঠামোয় ঘুন ধরিয়ে রাষ্ট্র কাঠামোর মূলেও আঘাত হানে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারকরাও এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় বিচলিত ও বিব্রত হন। ক্ষেত্র বিশেষে চলার গলিপথে এসব অনিয়ম ও অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপে লাগাম দিতে রাষ্ট্রকে কঠোর অবস্থানেও হাঁটতে হয়।
গলিপথের অনিয়ম ও অনিয়ন্ত্রিত চলনে আজ রাষ্ট্র কাঠামোর চলার রাজপথ গুলি খানা খন্দরে ভরে যাচ্ছে। গোঁড়ায় হাত লাগাতে হবে। চলার পথে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার গলিপথ গুলোকে মেরামতে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। সামাজিক মূল্যবোধ মেরামতে রাজনীতির স্বচ্ছ্বতায় মানুষের নৈতিকতা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার আদর্শিক স্থানে শিক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিল্প সংস্কৃতির চর্চায় স্বাধীন বাংলার আপন ভূখন্ডের চারিত্রিক বৈশিষ্টে নজর দিয়ে মানুষের ঐতিহ্যগত ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে উচ্চকিত করতে হবে। রাজনীতির শুদ্ধপাঠে জনপদকে জাগ্রত করতে হবে। রাজনীতির উঠান থেকে হিংসা বিদ্বেষ ও অবহেলাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সহমর্মিতা ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরীতে মনোযোগী হতে হবে। অর্থনীতি,স্বাস্থ্য,শিল্প, জাতি-ধর্ম সর্বক্ষেত্রে আজ অনিয়মের চোরাবালিতে ভরে যাচ্ছে যা মোটেই স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
আমরা বীরের জাতি। সমস্ত বাধার বিন্ধ্যাচলকে ডিঙ্গিয়ে আমরা আমাদের স্বকীয়তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং আসুন - জাতিগত বাঙালী স্বত্ত্বায় একাত্ম হয়ে আমরা সমস্বরে গেয়ে উঠি নিজেদের ঐতিহ্যের শেকড়ে জন্ম নেয়া সেইসব মন্ত্রগাঁথা, যার স্ফুরনে বাঙালী জেগেছে – যুদ্ধ করে আপন অস্তিত্বের বুনিয়াদ বিনির্মান করেছে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।