জালাল উদ্দিন আহমেদ
হচ্ছেটা কি!
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২৫ | আপডেট: ০৭:৪৯ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৫
প্রশ্নটা তো নিছক নয়। আসলেই হচ্ছেটা কি? চারিদিকে গুজব আর এলোমেলো অতিকথনের ফুলঝুরি। কেউ থেমে নেই। সবাই যে যার মত গলাবাজি করে যাচ্ছে। ইউটিউব ফেবুর কথা বাদই দিলাম। কারণ সেখানে ভোজবাজির AI আছে। কিন্তু বাস্তবের এরা! এরাই বা কি করছেন। সব বড়সড় চেনা মুখ। গত পনের বছর সবাই তো দৌড়ের মধ্যেই ছিলেন। থানা পুলিশ কোর্ট কাছারির নিষ্পেষনে তথৈবচ অবস্থা। আর সিংহভাগ ঘরছাড়া-গ্রেফতারি আতঙ্কে। পুণ্যির জোরে সৌভাগ্যবান দু'চারজন ইলেক্ট্রনিক নতুবা প্রিন্ট মিডিয়ায় দু-চারটা কথা বলা বা লেখার সুযোগ পেয়েছেন। সুযোগের আরও কিছু থাকলেও থাকতে পারে। কারন ডানপন্থী ধনবাদী রাজনীতির চরিত্র সব সময় ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যে বিচরণ করে। সেখানে নেই কোন সামষ্টিকতার অনুশীলন। ফলে আমাদের দেশে রাজনীতি গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রচিন্তা যাই বলি না কেন, সাধারণ জনগনের জন্য যতই অতিকথন হোক, ultimately এই প্রজাতির রাজনীতিকরা শুধুমাত্র ক্ষমতার চেয়ারটি পাওয়ার জন্যই দৃশ্যমান ঘটনার খেলোয়াড় হন। ক্ষমতায় পৌঁছালে তথাকথিত এইসব জনদরদী অমুক ভাই তমুক ভাইয়েরা হয়ে উঠেন গণতন্ত্রের দৌর্দান্ড প্রতাপশালী শাসক। বিশেষ করে আমাদের এই বাংলার জন্য এই কথাগুলোই যুতসই বলে মনে করার যথেষ্ঠ উপাদান রয়েছে।
গত পনের বছরে বাংলার জনগনকে রাজনীতি নামের যতসব ধোকাবাজির গোলক ধাঁধায় ফেলে রাখা হয়েছে। চলমান রাজনীতি তাদের কোন দিশা দিতে পারেন নি। তাছাড়া জনগনও যে তাদের পাশে থেকে নিজেদের আশা আকাঙ্খায় এসব রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে প্রকাশ্য হবেন সে ভরসার স্থলও তারা হতে পারেননি। তবে প্রবল বিক্রমে অবস্থান নিয়ে একই প্রজাতির রাজনৈতিক আচরনের ক্ষমতা ভোগের পক্ষটি যখন একের পর এক অন্যায় ও দূরাচারী আচরনে জন জীবনে দুর্বিসহ নাভিশ্বাস তুলে বছরের পর বছর ধরে দেশে রাম রাজত্ব কায়েমে সফল হচ্ছিল তখন আমজনতা ‘অগত্যা নাতি ভাতার’এর সেই প্রবাদ সূত্রের বাধ্যবাধকতায় মাঠে নামতে বাধ্য হয়। কিন্তু কিসের কি! এত বড় বড় জনসভা, প্রতিটি বিভাগের জনসভায় লাখো মানুষের ঢল এবং স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন দিয়েও তারা দুঃশসনের অচলায়তন ভাঙ্গতে ব্যর্থ হন। আর সফলতা আসবেই বা কেমন করে! হিমালয়সম সততার সর্বোচ্চ শিখরে থেকে যে পোষাকী মানুষটি তাদেরকে নিয়ে দেশ গড়ার স্বপ্নে নিজের স্বত্ত্ব ত্যাগ করে জনতার কাতারে নেমেছিলেন তার এক দশমাংশও তারা হতে পেরেছেন কি? অকাল প্রয়াত সেই জনপ্রিয় রাষ্ট্র প্রধানের বিধবা জায়াকে নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে তারা কি দেশে তাদের রাজনীতির কাঠামোটিকে পুনঃনির্মানে মনোযোগী হয়েছিলেন? নাকি একজন মহান ব্যক্তির সততা ও দেশপ্রেমের ন্যায়নিষ্ঠাকে পুঁজি করে দেশে রাজনীতির তঞ্চকতায় বাণিজ্যের হাটুরে সেজেছিলেন তারা! এই প্রশ্ন জনগনের মুখে এখনও ঘুরে ফিরে। শুধুমাত্র একজন মহান নেতার সততা ও নেতৃত্বের অহংকারকে পুঁজি করে আর কতদিন এইসব রুটি রুজির ভোজবাজি চলবে - কেউ কি বলবেন! এত এত স্বতঃস্ফুর্ত জনসভা ও মানুষের ঢল নামিয়েও জনসমর্থনপুষ্ট দলটি যখন “দড়ি ধরে মার টান রাজা হবে খান খান” এর সঠিক সময়টা নির্ধারনে ব্যর্থ হয় তখন জনপদের সাধারন মানুষের হতাশা ছাড়া আর কিইবা করার থাকে!
আজকের দিনে ঐসব কচি কাঁচাদের বৈষম্য বিরোধী সফল আন্দোলনকে পুঁজি করে এখন যারা গণ অভ্যুত্থানের সারথি হতে চান - তাতে কি তাদের ওই তথাকথিত ধনবাদী গণতান্ত্রিক আচরনের চরিত্রটা ফুটে উঠে না? ন্যুনতম শোভন আচরনটুকুও তো করা হোল না ওইসব তরুন কিশোরদের সঙ্গে। বাচ্চাদের পাশে না থেকে সোজা লেফট-রাইটের উঠানে গিয়ে নিজেদেরকে বিকশিত করতে চাইলেন তারা। তাদের এই আচরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কিন্তু ইদানীং বেশ দৃশ্যমান হচ্ছে। হোক না অন্যরা খুচরো আনা পাই, কিন্তু দেশে নীতি নৈতিকতার মশালটি ধরে রাখতে গিয়ে তারাও যেন আজ হাঁপিয়ে উঠেছেন। সারাজীবন লাল নীল ঝান্ডা নিয়ে রাজপথের মশাল না হলেও টিমটিমে প্রদীপ হয়ে হলেও তারা রাজনীতির আদর্শের ধারক হিসেবে পথেঘাটে ছিলেন। গত দেড় দশকে এ থেকে কিছু দুর্বল চিত্ত নিজেদেরকে বিকিয়ে স্বৈরাচারের দোসর হতে গিয়ে সেসব উদীয়মান প্ল্যাটফরম সমূহকে নষ্ট করে দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে এদেশে নেতা ও আদর্শ সেখানেই উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে বা বিকশিত হয় যেখানে অর্থ ও শক্তির যোগান যুগলবন্দি হয়। ফলে নীতি নৈতিকতার পথে হেঁটে চলা রাজনীতির কানা-কড়ি বিহীন এসব খুচরো আনা পাইয়ের রাজনীতির ধারকরাও যেন আজ দিশেহারা নিশানাহীন। তাদের মধ্যেও আজ হতাশার পারদ ভর করে বসেছে। তারাও আজকাল এই বৃহৎ জনসমর্থনপুষ্ট পক্ষটির কথাগুলো তোতাপাখির আচরনে উগরে দিয়ে বাতাস ভারি করছেন।
এহেন দিশাহীন বর্তমানকে সামনে রেখে আজ দেশে এক ভয়ানক অস্থিতিশীলতার বাতাবরন ধুমায়িত হচ্ছে। একদিকে পতিত স্বৈরাচার, তার পোষ্য ও দোসররা বিদেশে (কিংবা প্রতিবেশী বন্ধু দেশে) বসে দেশটাকে ছিন্নভিন্ন করার মরন খেলায় দেশের অখন্ডতার বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই প্রচার করে বাতাস ভারি করছে। অন্যদিকে ক্ষমতার বুভুক্ষু গত পনের বছরের ক্ষতবিক্ষত পক্ষটি কত তাড়াতাড়ি ক্ষমতার চেয়ারে বসা যায় তার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যে যার মত বয়ান বাজি করে চলেছেন। আর সারাজীবন চেতনার ফেরিওয়ালাদের খাদিমদারী করে সেখানে কূল না পেয়ে আজ ওই আনা পাইয়ের ঝান্ডা ওয়ালারাও একই সুরের কোরাসে নির্লজ্জ হতে দ্বিধা করছেন না। ছাত্র জনতার আকাঙ্খায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অগাধ সমুদ্র অভাব অভিযোগের চাপে হিমশিম খাচ্ছে। পাশাপাশি গত অর্ধ শতাব্দী জুড়ে রাষ্ট্র নামক যে উইপোকার ঢিপি তৈরী করা হয়েছে তার সংস্কারের অপরিহার্যতাও আজকে জনগনের পরম আকাঙ্খার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান রাজনীতির পক্ষ সমূহের ক্ষমতা নামক সোনার হরিণটার জন্য আর তর সইছেনা। ফলে তাদের পক্ষ থেকে এই মূহূর্তে নির্বাচন নামক পরম আকাংখিত বিষয়টিই যেন প্রধান এবং প্রথম কাজ বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচন নির্বাচন করে ঝালাপালা অবস্থা। পারলে কালকেই যেন ক্ষমতা প্রাপ্তির ওই মহড়া সপন্ন করা হয়। ভাবখানা এমন যে, এই সরকার রাজনীতির এসব বণিকদের চেয়ারে বসানোর ভোট অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্যেই চেয়ারে বসেছেন। বাংলার মানুষ কি চায়! শুধুমাত্র ভোটই কি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সাম্য সৌহার্দ্য ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করে তাদের জীবন চাহিদার সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলি নিশ্চিত করে দেবে? যদি তাইই হোত তবে এই চুয়ান্ন বছরের স্বাধীনতা ভোগের বাঙালীকে এখনও কেন বুকের রক্ত দিয়ে তাদের তৃতীয় স্বাধীনতার কথা উচ্চারন করতে হয়! ডগমগ চিত্তে মিছিল সহকারে কেন আজো ছাত্র-জনতাকে গুলি বন্ধুক উপেক্ষা করে বাঙালীর সর্বোচ্চ প্রিয় আবাসভূমিটিতে (গণভবন) ঠাঁই নেয়া স্বৈর শাসককে বিতাড়িত করার জন্য রণ হুংকারে ধাবিত হতে হয়! বাঙালীর প্রবাদ প্রতীম নেতাকে কেনইবা জনগনের ভোটের আস্থা হারিয়ে এক দেশ এক নেতার চাতুর্য্যে দেশ শাসনের চিন্তা করতে হয়। কেনইবা তাকে পরিবার পরিজনসহ অঘোরে প্রাণ দিতে হয়? কোন কুলুক্ষনের ইশারায় বীর মুক্তিযোদ্ধা একজন সৎ ও সফল রাষ্ট্র নায়ককে তার সহকর্মীদের হাতে প্রান দিতে হয়! কেনই বা একজন জনপ্রিয় প্রধামন্ত্রীকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অবৈধভাবে জেলে অন্তরীন রাখা হয়। কোন দুঃখে একজন প্রধানমন্ত্রীকে অবৈধ পন্থায় ভোটের কারসাজি করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার অভিলাষে স্বৈরাচারী হতে হয়। এসবের উত্তর কি আজকের দিনে রাজনীতি করা কুশীলবরা দিতে পারবেন!!
সুতরাং মহাশয়েরা, চুয়ান্ন বছর পরে হলেও বাংলার মানুষকে তাদের আকাঙ্খার শেকড়ে নোঙর করানোর সুযোগ এসেছে। এতদিন এদেশের রাজনীতির গণতন্ত্রায়নে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার ছটায় আলো ছড়াতে গিয়ে দেশে শাসক শোষিতের স্তর বানানো হয়েছে। এমনকি ব্যক্তি জৌলুশের অবাধ লাইসেন্সের দূরাচারী আচরনে তাকে স্বৈর শাসক বানিয়েছে। আর আপনারা নিজেরা রাজনীতির প্রতিষ্ঠান না হতে পেরে পরজীবি হয়ে নিজেদের রুটি রুজির স্ফীতিতে ব্যস্ত থেকেছেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভুয়া অনুশীলনে ব্যক্তি কারিশমার ছটায় নিজেরা স্নাত হয়েছেন। আর তার ছিটেফোঁটা বিচ্ছুরনের ছটা বাংলার সাধারনে বিকিকিনি করে নিজেরা মোড়ল মাত্ববর সেজেছেন। আসুন না, গণতন্ত্রের শক্তিমান আচরনকে তার শেকড়ে পৌঁছানোর মিশনে আমরা সবাই এক কাতারে কাতারবদ্ধ হই। নিজেদের কোটা আন্দোলনকে সামনে এনে শিক্ষায়তনের কচিকাঁচা ছেলে মেয়েরা যে বৈষম্যহীন পথের দিশা আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে তার মর্মবাণী অনুধাবন ও অনুশীলনে আমরা একতাবদ্ধ হই। শতবর্ষ পূর্বে বিশ্বকবির সেই ডাক -”আইরে আমার কাঁচা, আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা'র সেই কাজটি তারা করে দিয়েছে। বাকী কাজতো আপনাদেরই করতে হবে। যারা এসেছেন, তারা রাষ্ট্রের গুণীজন, মুরুব্বী। তাদেরকে আস্থায় রেখে আসুন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এতদিনের তৈরী করা উইপোকার ঢিপিগুলোর মেরামতে স্বতঃস্ফুর্ত হই। দেশের গণতন্ত্রায়নের পথকে সুগম ও শক্তিশালী করি।