জালাল উদ্দিন আহমেদ
রুচির দীনতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৫ | আপডেট: ০৪:১১ পিএম, ২৩ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৫
কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আজকের এই ছন্দপতন সত্যিকার অর্থেই আমাদেরকে পশ্চাদগামী করছে। আমাদের এগোনোর পথগুলো আস্তেধীরে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে বলে মনে হয়। শিশু তথা নতুন প্রজন্মের বুনিয়াদ বিনির্মানের পথটি বড় বেহাল অবস্থায় খাবি খাচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট উপাদান আমাদের সংসার ও সমাজ ব্যবস্থায় কিলবিল করছে। নিজের বাল্য কৈশরের বেড়ে উঠার দিনগুলি, কিংবা যৌবনের পদপীঠে নিজের জীবন গ'ড়ে তোলার সেইসব সময়গুলি মনে করলে সত্যিই শিহরিত বা আবেগে পুলকিত হওয়ার অনেক উপাদান খুঁজে পাই। স্বপ্ন আশা ও সংগ্রামের সেইসব গাঁথামালায় নিজেকে গড়ে তোলার পরিক্রমায় যখন নিজের দিকে তাকিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবতে বসি তখন সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মফস্বলের প্রত্যন্ত এক গ্রাম্য বালক, যে তার উচ্চ মাধ্যমিক অব্দি ট্রেনে চড়েনি, নদী কি জিনিস চোখে দেখেনি কিংবা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা কি জিনিস তার অনুভবে আসেনি, এমনকি দৈনিক সংবাদ পত্রের পাতা উল্টিয়েও প’ড়ে দেখেনি; সেই তিনি তার জীবন সায়াহ্নে এসে হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে যতশত নৈরাশ্যবাদী কথামালার আক্ষেপে গদ্য রচনা করবেন তাতে বলার কিছু থাকে কি! তবুও জীবন চলমান। কে যেন বলেছিলেন জীবন একটা চলন্তমান ছায়া, দু'দিনের রঙ্গমঞ্চ. …….. ইত্যাদি ইত্যাদি। সম্ভবতঃ সেক্সপিয়ারের কোন এক নাটকের বিখ্যাত উক্তি এটি।
হাঁ, দেখতে দেখতে সময় তো আর কম হোল না। গত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশকে এই ধরাধামে পা পড়েছিল আমার। আজ একবিংশের এই সিকি শতাব্দীতে পা ফেলে এখনও ডগমগ চালে ওয়েব সিরিজের সিনেমা নাটক দেখছি। নিয়মিত ই-পেপারে চোখ বুলাতে ভুল হয় না। নিজের ভালমন্দের কথা ফেবুতে অকপটে লিখে শেয়ার করি। ভাল কিছু দেখলে মনের কথগুলি মন্তব্যের ঘরে লিখে দিই। প্রযুক্তির কল্যানে নিয়মিত খেলার মাঠে হাজির হয়ে প্রিয় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা উপভোগ করা নিত্যদিনের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। তারপরেও দৃষ্টিভঙ্গি ও নিয়মাচারের মধ্যে গেঁথে থাকা পঞ্চাশ ষাটের কৈশর কালীন সেই আচার আচরনের গন্ধটা তরতাজাই রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু এতসব সাহায্য সহয়তা পেয়েও নতুন প্রজন্মের বেড়ে উঠার এই প্রযুক্তি মার্কা মিশেলটাকে কেন যেন সন্দেহের চোখে দেখতে মন চায়। মনে হয় যেন মানব সন্তানের বেড়ে উঠার বেসিক থেকে তাদেরকে দূরে ঠেলে ফেলে দেয়া হচ্ছে। বাচ্চারা নিজেদের জন্য প্রদত্ত কাজকে দূরে ঠেলে এটা ওটা হাবিজাবি নিয়েই তাদের জীবনের মূল্যবান সময়টাকে নষ্ট করছে। তারা আমাদের মত ছোটবেলার সুরেলা আওয়াজে গদ্য-পদ্য ও পাটিগণিতের নামতা কেন পড়ে না সেটা নিয়ে মনটা খচখচ করে। স্কুল থেকে ফিরে কিছু মুখে দিয়ে বল নিয়ে মাঠের দিকে দৌড়ানা কিংবা সাইকেল নিয়ে প্যাডেল মারার সেই প্রকৃতিগত কৈশরের উচ্ছ্বলতা ওদের মধ্যে খুঁজে পাই না। নিজেদের বুনিয়াদী পাঠক্রমে সময় না দিয়ে গেমস এপ্স ইত্যাদির ঘুর্ণিজালে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ওরা। বই খুলে পড়াশুনা কিংবা কলম ধরে খাতায় লেখালিখির বাস্তবতায় বাচ্চাদের আগ্রহ যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। টিভি কমপিউটর এবং স্মার্ট মোবাইলটা তাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে পড়েছে।
সামান্য এক স্মার্ট ফোনের আসক্তি আজ আবাল বৃদ্ধ বনিতার রুচির উঠানটাকে বাতিকে পরিণত করেছে বলে মনে হয়। টেকনোলজি সুবিধাভোগের এই ছয়-সাত ইঞ্চি মাপের ডিভাইসটি ইদানীংকার আবাল বৃদ্ধ বনিতার আপনজন হয়ে আজ হাতে হাতে ঘুরে ফিরছে। এই ডিভাইসে ভেসে আসা সমস্ত প্রডাকশনই ঐসব ভোক্তা সাধারনের দৃষ্টি ও শ্রুতিগ্রাহ্য আইটেম হয়ে দেদারসে বাজারজাত হচ্ছে। আজকাল দশ বছরের কিশোর যেমন তার নাম ও ছবি দিয়ে ফেবু একাউন্ট খুলে তার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। এমনকি অপ্রয়োজনীয় ও অরুচিকর রিল, টিক-টক এবং ইউটিউবের কন্টেন্টগুলি শেয়ার করছে, তেমনি নব্বই বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও সেই সুযোগ নিচ্ছেন। তাছাড়া অবাধ ও মুক্ত বাণিজ্যের যুগে খাদ্য-অখাদ্য সমস্ত কিছুই আজ হাতের মুঠোয় থাকা এই ডিভাইসটির মাধ্যমে আমাদের হাতের নাগালে সহজেই চলে আসছে। সেখানে নেই কোন ক্ল্যাসিফিকেশন বা রেস্ট্রিকশান। সুতরাং এই all classified এর ডামাডোলে আজকাল ওই দশ বছরের বাচ্চাটি যা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, সত্তোর্ধ বৃদ্ধটাও সেসব দেখে বা পড়ে নস্টালজিয়ায় হড়কম্প হচ্ছেন। আজ বাদে কালকের পর আগামী পরশু যারা আমি হবে তাদের আগামীকাল কোথায়-সেটাই আজ বড় প্রশ্ন হয়ে আমাদের ভাবাচ্ছে। ঠাম্মা তার প্রৌঢ়ত্বে এসে অবসরের অগাধ সমুদ্রে হয়তো কিছুটা বাণী অর্চনা বা সুরা কেরাত শুনে একটু রিল্যাক্স হতে গিয়ে কিছু বিনোদনের টিকটক জাতীয় ভিডিওতে আঙ্গুল চাপলেন। নিজের অজান্তেই হাসি ঠাট্টার সেসব ভিডিও দেখতে দেখতে ন্যাকামির চরম মূহুর্তে যখন অখাদ্য অরুচিকর এবং ন্যুডি টাইপের ভিডিও সমূহ তার চোখের সামনে ভেসে উঠে, প্রাথমিকভাবে একটু বিরক্ত হন বটে কিন্তু পঞ্চ ইন্দ্রীয়ের রক্ত মাংসের মানুষ হিসাবে এসব তার সময়টাকে তরতাজাই করে দেয় বলে মনে হয়। একসময় ছেলেমেয়ে বৌ বেটি বা নাতি পুতিদের আড়ালে রেখে হলেও এসব দেখা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে লক্ষ্য করা যায় আগের কালের ঠাম্মাদের সাথে একালের আধুনিকা ঠাম্মারা অনেকটাই অস্থির মস্তিস্ক মনোভাবাপন্ন হন। নাতিপুতি বাচ্চাদের কাছে বসিয়ে রুপকথার গল্প বলা ঠাম্মা এখন আর পাওয়া যায় না।
ওদিকে শিশু কিশোর বাচ্চারাও লেখাপড়াকে তাদের সেকেন্ডারী আইটেমে রেখে সেভাবেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়। চিমনিওয়ালা হ্যারিকেনের কালিঝুলি মাখা কাঁচের গ্লাস ন্যাকড়া দিয়ে মুছে সন্ধার আলোর উৎসের ওই একমাত্র উপকরণটা আমাদের নিজেদেরকেই তৈরী করে পড়তে বসতে হোত। হ্যারিকেনে পর্যাপ্ত কেরোসিন আছে কি না, চ্যাপ্টা ফিতাটা ঠিকঠাক আছে কি না - এসব তদারকি নিজেকেই করতে হোত। তারপর চিলেকোঠা বা উঠানের নির্দিষ্ট জায়গায় পাটি(মাদুর) বিছিয়ে পড়তে বসার আয়োজন - সেসব ভুলি কেমন করে। এসব কাজ এখন সুইচ রিমোটে চলে। প্রাপ্তির প্রাচুর্য এখন তাদের পরনির্ভরতার শেষ কিনারে ঠেলে রেখেছে। একটি শিশুর বেড়ে উঠা এবং তার বাহ্যিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ন্যুনতম প্রকৃতিগত সংস্রব হতে সে সম্পুর্ণ বিযুক্ত। গুরুজন কারা, কিভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলা চলাফেরা ইত্যাদির মনুষ্য আচরনের পাঠ তারা পায় না। আর এসবের শিক্ষা দেয়ার মানুষ এবং পরিবেশইবা কোথায়। সবার হাতেই তো ওই সাত-আট ইঞ্চি পর্দাওয়ালা এন্ড্রয়েড। পিতা যন্ত্রটি টিপতে টিপতে বা কানে লাগিয়ে কথা বলতেই দরজা খুলে অফিসগামী গাড়িতে উঠছে। গৃহকর্তীর বাম হাতে আধুনিক প্রযুক্তির সেট আর ডান হাতে রুটি সেঁকার খুন্তি। ওদিকে রিটায়ার্ড দাদু অভ্যেসের নিয়মাচারে সকাল বেলার সংবাদপত্র নিয়ে ব্যস্ত। দাদীমা নিজের সেটটি নিয়ে গুগলের নিউজ আর ইউটিউবের ভিডিও নিয়ে খুঁচাখুঁচি করছেন। সুযোগ বুঝে স্কুল পড়ুয়া ক্লাস ফাইভের একমাত্র নাতিটি দাদুর স্মার্ট ফোনের মালিক হয়ে নেট খুলে কিসব হিজিবিজি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই হোল এখনকার সময়ের দৈনন্দিন চালচিত্রের দিন শুরুর পটচিত্র।
প্রযুক্তি আমাদের এগিয়ে নিচ্ছে ঠিকই। তারপরেও একটি মনুষ্য সন্তানের বুনিয়াদ বিনির্মানে যে অধ্যাবসায় ও অনুশীলনের প্রক্রিয়া তাদেরকে বেড়ে উঠার পুষ্টতায় সমৃদ্ধ করে তা কি আমরা নতুন প্রজন্মকে দিতে পারছি! সামাজিক বিন্যাস, সমাজবদ্ধতা, নৈতিকতা, সহমর্মিতা, শুদ্ধাচারের সুফলতা ও মানবতার বেসিক মূল্যবোধে আমরা কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে পারছি। রুচির দীনতায় আজ আমরা সমাজবদ্ধতার কোন্ স্টেজে পড়ে খাবি খাচ্ছি তা কি আমরা জানি! রুচিহীন রাজনীতির বোলচাল আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের শিকড় উপড়ে ফেলেছে। প্রযুক্তির আধিক্য আমাদের সাজানো গোছানো পারিবারিক কাঠামোয় আগুন ধরিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য প্রযুক্তির বাধাহীন উঁকিঝুকিতে আজ আমরা আসক্ত হয়ে পড়েছি। বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম রূচিহীন টিকটক, রিল, ইউটিউবের এডাল্টেরিয়ান ভিডিও ক্লিপ এবং ভায়োলেন্স মার্কা ভিডিও গেমস ইত্যাদির সানিধ্যে নিজেদেরকে মিশিয়ে ফেলেছে। এটা এখনও সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেয় নি। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কাঠামো মেরামতে এখনকার সময়ে যে তোড়জোড় চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় আসুন না আমরা সমাজ মেরামতের এদিকটাও একটু খেয়াল করি।