জালাল উদ্দিন আহমেদ
মেধাহীনরাই সচিব টচিব হন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৫ | আপডেট: ০৩:২৬ এএম, ২১ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৫
নিবন্ধের হেড লাইনটা দেখে রে রে করে তেড়ে আসার লোকের অভাব নেই এই সমাজ সংসারে। আইন আদালত ব্যাখ্যা বিলশ্লেষনে জেরবার হতে হবে এর উপস্থাপককে। কিন্তু কি করি বলুন! একজন হাসনাত আব্দুল হাই, আমার তো বটেই, আমার অগ্রজেরও কর্ম জীবনের স্যার ছিলেন তিনি। এই “স্যার” শব্দটির ফজিলত কোন এক নিবন্ধে বলেছিলাম বলে মনে পড়ে। সবই বৃটিশ বেনিয়াদের হেসেল থেকে আসা। তো, সেই স্যার যখন অজ গ্রামের আরজ আলীদের মত আনপাড় বিদ্যানুরাগীদের নিয়ে কিছু লিখে নিজের বিদ্যাবুদ্ধির চিরকুটটা আমাদের মুখের উপর ছুঁড়ে দেন তখন তার ঐ স্যার উপাধির ভীতিটা কিছুটা হলেও পানসে হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতার এই স্যারেরাই আমাদের রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের মেইন সুইচের কর্তা হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় নিজেদেরকে উপস্থাপন করে রেখেছেন। তাদের মেধা ও শ্রমের নিরলস প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র নামের এই ভূখন্ডটি একটি সরল পথের দিশা নিয়ে আপন মহিমায় বিকশিত হচ্ছে। এই চলার গতিপথ কিন্তু অনন্ত এক ঘূর্ণিচক্র।
ছোট বেলায় যখন স্কুল মুখী হলাম তখন থেকেই এই স্যার বলার প্র্যাক্টিসটা হেফজো করতে হয়েছে। যদিও বাঙালীর বাংলা ভাষা প্রয়োগের স্থান কাল পাত্রের একটা মজেজা রয়েছে। এই যেমন ধরুন আপনি-তুমি-তুই কিংবা মহাশয়-সাহেব, শ্রীমান-জনাব ইত্যাদি। কিন্তু ইংরাজী পড়ুয়া বিদ্যা শিক্ষার আঙিনায় বা ভাষা বিন্যাসে এইসব বিভাজনের বালাই নেই। তাদের মুখে ভগ্নিপতি, দুলাভাই বা জামাইবাবু এমনকি শালা সমন্ধিও নেই। স্রেফ brother-in-laws. যাহোক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার বলার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে আরেক কিসিমের স্যারের গ্যাঁড়াকলে পড়লাম। এরা হচ্ছেন রুটি-রুজি রক্ষার স্যার। সরকারী মেকানিজমে বিচরন করা এসব স্যারেরাই সময়ের পথ পরিক্রমায় একসময় ডিজি চেয়াম্যান সচিব টচিব হন। শিক্ষা জীবনের স্যার আর কর্ম জীবনের স্যারের বেশ পার্থক্য রয়েছে। দুটি ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও একদল মেধা স্বত্ত্বের সূত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করেন আর অন্যদল সেই সূত্রের প্রায়োগিক আচরনে বিচরন করেন। প্রথম দল মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে তাদের জ্ঞানের আলো আলো ছড়িয়ে দেশ গড়ার মানুষ তৈরী করেন। আর দ্বিতীয় দল অর্জিত জ্ঞানের প্রায়োগিক বিন্যাস ঘটিয়ে দেশ গড়ার কর্মযজ্ঞে নিজেদের সমর্পিত করেন। সুতরাং মেধা স্বত্ত্বের অধিকারী দুটি পক্ষের স্যারের গুরুত্ব প্রাসঙ্গিকভাবেই ওতপ্রোত।
তারপরেও চলন-বলনে ব্যতিক্রমী ঘটনা অঘটন তো হর হামেশাই ঘটে। হৈ-চৈ শোর-গোল উচ্চ-বাচ্য এসব নিয়ে চলতেই থাকে। ধরুন একই বয়সের দুই সহপাঠী, দুইজনই বা হবেন কেন! পঞ্চাশ বা এক'শ জনও হতে পারেন। একই স্কুলে থেকে এসএসসি এইচএসসি করে শতকরা পঞ্চাশ জন ডিগ্রি এবং তা থেকে বিশ ভাগ মাস্টারস অর্জন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন। তাদের এক থেকে দশে থাকা মেধার ছেলেরা কেউ প্রাইমারী, কেউবা সেকেন্ডারী এবং কেউবা শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে কলেজ শিক্ষক হলেন। হয়তো সেই ব্যাচের তের বা সতের ক্রমিকে থাকা কোন দুইজন প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হলেন। ভাগ্যের লিপিতে বাকীদের কেউ কন্ডাক্টর, কেউ আদম ব্যবসায়ী, কেউ শিল্পপতি, শ্রমজীবি আর অবিশষ্টের দল বাপ দাদার হাল চাষের কৃষকের খাতায় নাম লিখালেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক আলোচনায় জেনারেশন বিন্যাসের এই চিত্রটাই কমবেশী প্রযোজ্য। তবে ব্যতিক্রমী আলোচনায় অজ গ্রামের ভূমিহীন কফিলুদ্দিনের ছেলে কিংবা অসহায় রিক্সাচালক জমিরুদ্দিনের মেধাবী ছেলেটা পাশের বাড়ির গেরস্থ ঘরে লজিং থেকে পড়াশুনা করে যখন ম্যাজিস্ট্রট হয়ে নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজের অংশীজন হন, তখন আমাদের এই গ্রাম সমাজে আলোড়ন তোলে বৈকি! ডাক্তার প্রকৌশলী ছাড়াও একই ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র বিন্যাসের ধাপে উচ্চাভিলাষীরা উকালতি ব্যারিস্টারী করে রাজনীতি বা কোর্ট কাছারীর আঙ্গিনায় পদচারনা করেন। তবে ইদানীংকালে প্রশাসন যন্ত্রের রুজিজীবিদের আদর আপ্যায়ন ও কদর বাড়ার লাগামহীন দৌরাত্বের চাকচিক্যে প্রলুব্ধ হয়ে ডাক্তার তার মানব সেবার পথঘাট ভুলে ওপথেই পা বাড়িয়ে রাখেন। একজন ইঞ্জিনিয়ার তার দেশ গড়ার কর্মী হওয়ার শপথে বিচ্যুত হয়ে প্রশাসক হওয়ার খায়েসে সেপথে ঢুঁ মারছেনব?। দেশের আইন আদালতের মজবুত ভিত গড়ার উচ্চাকাঙ্খায় যিনি ওকালতি ব্যারিষ্টারী পড়ে আসছেন তিনিও যেন নামের পাশে কেরানী মার্কা নামটিকেই পছন্দ করছেন। তাছাড়া রাজনীতি নামের “নাই কাজ তো খই ভাজ” এর আলাদীনের চেরাগ তো অনাদিকাল হতেই বাঙালীর রক্ত মাংস মজ্জায় কিলবিল করছে।
মানব সম্পদ বিন্যাসের এই গুঁতাগুতির রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় আমরা যুগ যুগান্ত ধরে একটা অসহিষ্ণু আচরনের মধ্য দিয়ে বিচরন করছি। এখানে গুঁতাগুতি ও অসহিষ্ণু নামক দুটি চড়া মূল্যের তীর্ষক বিশেষন আমাদেরকে ভাবাচ্ছে ঠিকই কিন্তু বিচার বিশ্লেষনের আঁতুড় ঘরে প্রবেশ করে এর নাড়ি নক্ষত্র নাড়াচাড়া করলে আমাদের সামাজিক হীনমন্যতার উত্তর অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে। আজকের দিনে সমাজ সংসার ও রাষ্ট্র পরিচালনার পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো নিয়ে চিন্তা করলে খুব যে একটা সুখকর চিত্র পাওয়া যাবেনা তা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। তাছাড়া কর্ম বিভাজনের শ্রেণীবিন্যাসে গ্রাম থেকে উঠা আসা ওইসব গৃহস্ত বা প্রান্তিক চাষাভুষাদের ছেলেপুলেরাই রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের আইন বিচার শৃঙ্খলা প্রশাসন শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদি পেরিফেরিতে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। সেক্ষেত্রে গ্রাম্য আবহে বেড়ে উঠা এই নতুন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় কিছুটা যে গ্রাম্য আবহের ছোঁয়া থাকবে তা কিন্তু বলা যায়। আর এরই ধারাবাহিকতায় গ্রাম ইউনিয়ন থানা জেলা এমনকি বিভাগওয়ারী একটা অস্বচ্ছ্ব প্রতিযোগিতার রেশ কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি উঠানে লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া ইদানীংকার রাজনীতির দস্যিপনার সুযোগে এইসব নিয়োগ পোষ্টিং ইত্যাদি বিষয়ে অনৈতিক আচরনের মাত্রাগুলো দৃষ্টিকটুভাবে কর্মীমহলে অসহিষ্ণুতার বীজ তৈরী করে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই কর্মক্ষেত্রের বড় বাবুদের অর্থাৎ কথিত সচিব টচিবদের বেসামাল হতে হয়। আর তখনই ঐ শিক্ষা অশিক্ষার কথাগুলো সামনে চলে আসে।
নিবন্ধের হেডলাইনের দিকে তাকালে হয়তো একটি শ্রেণী একেবারেই হতাশ হয়ে পড়বেন। কিন্তু কি যে বলি এবং কেমন করে বলি, এখনকার দিনে শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব বিবেকবান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রয়েছে, তারা তো ইদানীং নিজেদের ছেলে-পুলে বৌ-বেটিদের ঝেটিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরী-বাকরীতে নিয়োগ দিচ্ছেন -সেটা তো রীতিমত ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রায়োগিক রেভ্যুলিউশান! সবকিছুর মাপকাঠিতে যদি শিক্ষার ডিগ্রিটাই সর্বোচ্চ মানদন্ডে নিরূপিত হয় তবে শিশুকালে অ আ ক খ শিখানো সেই আইএ পাশ শিক্ষককে আমি কি বলে সম্বোধন করবো। তার ঠাঁই আজ কোথায়! কোন এক অজ গ্রামে সরকারী খাস জমির ঝুপড়িতে জন্ম নেয়া অসহায় জমিরুদ্দির পোলা যিনি সচিব টচিব হয়ে এখন নিজের গ্রামে পদচিহ্ন রাখতে গিয়ে বে-আইনি দখলদারিত্বের ফাঁদে অসহায় পাশ্ববর্তীদের গৃহহীন করে ফেলেন তখন তার হাতে খড়ির সেই আইএ পাশ শিক্ষাগুরু যদি ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে আমার এই আর্টিক্যালের হেডলাইনটা উচ্চারন করেন তাতে দোষের কিছু আছে কি! তবে বাংলার আবহমান সেই শিষ্টাচারে ভর করেই আমার ঐতিহ্য বেঁচে থাকবে। সবাই সবাইকে নিজেদের প্রাপ্যতায় সম্মান করুক। শিক্ষার মান মর্যাদা রেখে সংসার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাজে যে যার স্থানে সম্মানের আসীনে বলীয়ান হোন। হীনমন্যতাকে বিসির্জন দিয়ে আসুন আমরা দেশ গড়ার ব্রতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ও কর্মক্ষেত্রের চলার পথে নৈতিক, স্বতঃস্ফুর্ত ও সাবলীল হই। আত্মরম্ভিতা, পরনিন্দা, পরচর্চার পথকে পরিহার করে আসুন আমরা শুনি এবং করি। তারপর শুনাই এবং করাই।