জালাল উদ্দিন আহমেদ
বুদ্ধিজীবি দিবস
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৫ | আপডেট: ০৮:৫৯ পিএম, ৮ জানুয়ারী, বুধবার,২০২৫
‘বুদ্ধিজীবি’ নামক শব্দটি আমাদের এই বাঙাল মূলুকে ইদানীং বেশ খ্যাতি কামিয়েছে। এই বুদ্ধিজীবি নামক মানুষগুলোর জ্ঞান গরিমার আলোক ছটায় এতদাঞ্চলের মানুষেরা তাদের আপন অস্মিতার বাঙালীত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ভুল করেনি। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে যিনি তার জীবিকা নির্বাহ করেন তিনিই বুদ্ধিজীবি। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র জীবনে জ্ঞান চর্চার শিখরে থেকে যারা তাদের আহরিত জ্ঞানের আলোকিত নির্যাসগুলি রাষ্ট্র সমাজ তথা জনপদ গঠনের কল্যানে অকাতর হন, তারাই আমাদের সমাজ কাঠামোয় আলোকিত মানুষ হিসাবে বিচরন করেন। এই বুদ্ধিজীবি নামক মানুষগুলি আমাদের সমাজে একটা সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত। এরা নিরপেক্ষ নিষ্কলুষ থেকে সমাজ সংসারের আলোকবর্তিকা হন। নিজেদের জ্ঞান গরিমায় রাষ্ট্র তথা সমাজের সঠিক পথের শিক্ষক হয়ে আজীবন জ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকেন। শিক্ষা স্বাস্থ্য সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞান এবং সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তায় একটি রাষ্ট তথা অখন্ড পৃথিবীর সম্মানিত নাগরিক হিসেবে এদেরকে সবাই সম্মান করে। নিজেদের জ্ঞান গরিমায় আলোকে এরা সমাজ তথা রাষ্ট্রকে আলোকিত করেন।
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পত্তন ঘটিয়েছি। বিনিময়ে অবশ্য আমাদের অনেক রক্ত ঝরেছে। এই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো আর হঠাৎ করে শুরু হয়নি। দীর্ঘ বঞ্চনা গঞ্জনা ও জাতিগত অপমান অনুশোচনার অনুশীলনে এসেছিল মুক্তি সংগ্রামের চুড়ান্ত লড়াইয়ের ডাক। মুসলমান এবং বাঙালী মুসলমান এই দুটি পদবাচ্যের উপর দাঁড়িয়ে পুর্ব বাংলার বঙ্গভূমি যেদিন পাকিস্তানী তকমায় (১৯৪৭ সনের আগষ্ট মাসে) তাদের জাতীয় অস্তিত্ত্বের সূচনা করেছিল, সেদিনের সেই সূচনা পর্বেই কোথাও যেন শুভংকরের কিছু ফাঁক ফোকর রেখেই তার পথচলা শুরু হয়। আর এই বিষয়টি প্রথম থেকেই এতদাঞ্চলের সচেতন মহল, বিশেষ করে রাজনীতি অঙ্গনের দেশপ্রেমিক নেতা ও কর্মী এবং বুদ্ধিজীবি মহলে বেশ আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। ভিন জাতি এমনকি ভিন ভাষার মানুষেরা শুধুমাত্র ধর্মের সূত্র ধরে কিভাবে একটি জাতিগত ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র বানায় সেটা বোধ করি পাকিস্তান রাষ্ট্রটির দিকে না তাকালে বুঝা বড় মুস্কিল। কি অদ্ভুত এক সমীকরনে সৃষ্টি করা হোল এই মুসলিম রাষ্ট্রটির, তা ভাবতে গেলে গোল পেকে যায়। সেই সূত্রে এগোলে তো দুনিয়া উলোট করা কান্ড কারখানা ঘটার অবস্থা হয়। সেই ফর্মুলায় তো আরব দেশ বলে একটি রাষ্ট্র হওয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়া মালোশিয়া না হয়ে মুসলিমেশিয়া হয়। এরকম আরো সব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা যায়।
যাহোক, ধর্ম সূত্রে পনের'শ কিলোমিটার দূরবর্তী দুটি ভূখন্ড সমন্বয়ে পাকিস্তান নামক একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হোল বটে, তবে এদের মাটির গন্ধে সৃষ্ট জাতিগত বিভেদের যে আদিমতা তা কিন্তু রয়েই গেল। আর এসবের বাস্তবতা এবং তার ফসল ঘরে তোলার মূলমন্ত্রের গাঁথাগুলো উঠে আসলো বুদ্ধিবৃত্তির সেইসব মাথাওয়ালা মানুষদের লেখনী ও বক্তৃতা বিবৃতির মধ্য দিয়ে। ফলে তা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে সাধারন মানুষের মননশীলতায় স্থান করে নিয়েছিল। এভাবেই বুদ্ধজীবিদের জ্ঞান বিচ্ছুরনে জনপদের জাতি তার আপন অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজে নিতে ভুল করেনা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালে তৎকালীন পুর্ব ভূখন্ডে পাকিস্তানের নাগরিক পরিচয়ে বাঙালী অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি বিদ্যমান ছিল বটে, তবে এতদাঞ্চলের মানুষের মন ও মননশীলতায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে বীজ ঐসব বুদ্ধিজীদের মাধ্যমে বপন করা হয়েছিল তার সুফল ঘরে তুলেছিল তৎসময়ের রাজনীতির পক্ষগুলো। সেক্ষেত্রে মাথাওয়ালা বুদ্ধিজীবিরা ভিন্ন ভিন্ন মন ও মতের মানুষ হলেও বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শে তারা সবাই একাট্টা ছিলেন। ফলে জাতিকে একতাবদ্ধ করে একমুখী আচরনে তাদের সুখস্বপ্ন রচনা করার মূল দায়িত্বে তাদের কোন ভিন্নতা ছিলনা। এজন্যই সামগ্রিকতায় তারা ছিলেন গোটা বাঙালী জাতির নমস্য এবং শ্রদ্ধাস্পদ। এজন্যই তারা বাঙালী জাতীয়তাবাদের পথিকৃত হয়ে আমাদের স্বাধীন স্বত্বার বাংলাদেশীদের কাছে শ্রদ্ধা ও ভক্তির আসনে আসীন হয়ে রয়েছেন।
স্বাধীন বাংলার পটচিত্রে বাংলাদেশী ভাবনায় বুদ্ধিজীবিদের নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। সম্ভবত: গত শতাব্দীর নব্বই এর দশকে দেশের গণতান্ত্রিক আচার আচরনে মিডিয়া চর্চার পসার ঘটে। ফলে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত আধিক্যে বুদ্ধিজীবি নামক এই নমস্য আঙ্গিনায় পার্টিজান রাজনীতির মুখপাত্ররা বুদ্ধিজীবি তকমা লাগিয়ে নিজেদের পান্ডিত্য জাহিরে কিছুটা প্রতিযোগিতাহীন জমিন পেয়ে যান। গড় পড়তা হিসেবে প্রতিটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া(অর্ধশতের মত) তাদের রোজনামচায় এইসব পরিযায়ী শিক্ষক চিকিৎসক ইঞ্জিনিয়ার অর্থনীতিবিদ এমনকি প্রকাশ্য রাজনীতির নেতা পাতি নেতাদের নিয়ে টক-শো নামের রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির আলোচনা অনুষ্ঠানের নিয়মিত প্রতিযোগিতায় নামে। এর ফলে কলুষিত রাজনীতির তঞ্চকতায় পড়ে ‘বুদ্ধিজীবি’ নামের এই শ্রদ্ধেয় আসনটি বাংলার মুক্ত জমিনে হাসিঠাট্টা মারামারি কিংবা গালাগালের এক উন্মুক্ত মঞ্চ হিসাবে পরিচিতি পায়। টিভি টক-শোতে আসা ঐসব অধ্যাপক অর্থনীতিবিদরা সাধারণ জনপদে পার্টিজান রাজনীতির পক্ষ বিপক্ষের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত হন। এমনকি প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের জ্ঞানগর্ভ লেখনী রাজনীতির একমুখী প্রচার হিসাবে বিবেচিত হয়। বর্তমান সময়ে দৈউলিয়া রাজনীতির দাদাগিরি ও অর্থযোগের প্রভাবে দেশের ‘বুদ্ধিজীবি’ নামক এই সম্মানিত আসনটি কলুষিত হয়ে পড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ এই সম্মানের আধারগুলো তাদের অর্জিত গৌরবের আসন থেকে বিচ্যুত হয়ে সাধারন মানুষের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন।
ক্ষেত্র পাল্টেছে বটে তবে স্বাধীন পাকিস্তানের পুর্বাংশে আলোকিত মানুষ হয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবিরা বাংলা ও বাঙালীর অস্তিত্ব ও অস্মিতার দীক্ষায় বলিয়ান থেকে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার আসনে পোক্ত হয়ে রয়েছেন। দুর্মুখেরা হয়তো বলবেন, যাদের নিয়ে এত আবেগ শোক এবং আন্তরিকতা দেখানো হচ্ছে তারা তো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারের অধীনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছেন। সুতরাং তাদেরকে নিয়ে এত আবেগ শোক দিবস ইত্যাদির কি প্রয়োজন! কিন্তু দুর্মুখেরা জানেন কি যাদেরকে আমরা পরাধীনতার ঐ ১৪ই ডিসেম্বরে মর্মান্তিক কায়দায় হারিয়েছি তারা ছিলেন বাঙালীর মণিকোঠায় এক একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের বুদ্ধিদীপ্ত এবং বলিষ্ঠ উচ্চারনের জাতীয়তাবাদী দীক্ষায় দিক্ষিত হয়ে পরাধীন বাংলার তরুন যুবারা সেদিন বাংলার জমিনে যে মুক্তির জোয়ার এনেছিলেন সেসব ইতিহাস বাঙালী ভুলে কেমন করে! তাইতো স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশকে মেধাশুন্য করার নীলনক্সায় বেছে বেছে ধরে নিয়ে নির্মম ও লোমহর্ষক কায়দায় হত্যা করা সেইসব নমস্য গুনীজনদের স্মরণ উপলক্ষ্যে আমরা বিজয় দিবসের পূর্ববর্তী ১৪ ডিসেম্বরকে ‘'বুদ্ধিজীবি দিবস’ হিসাবে পালন করে তাদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।