জালাল উদ্দিন আহমেদ
ক্ষমতা বনাম দায়িত্ব
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ১০:৪৪ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক করে কিন্তু দায়িত্ব মানুষকে বিনয়ী করে। এসব বাণী চিরন্তনী পড়তে পড়তেই আমরা বড় হয়েছি। ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত থেকে আমরা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয়ে নিজেদেরকে তৈরী করার মন্ত্রগাঁথায় নিবেদিত থেকেছি। কিন্তু বড় হওয়ার পর সামাজিক বিন্যাসের চলমান হতচ্ছাড়া চলন বলনে আমরা নিজেরাই এখন এক একজন অহংকারী দু'পেয়ে জীব হয়ে দন্ড মুন্ডের কর্তা সাজার অশুভ প্রতিযোগীতায় সামিল হয়েছি। আমাদের প্রতিযোগীতা ছিল। ছিল সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের অঢেল প্রাণস্পন্দন। সামাজিক মূল্যবোধের অপার মর্মবাণী ও তার প্রায়োগিক অনুশীলন আমাদেরকে মানবিক হয়ে গ’ড়ে উঠার রসদ জুগিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে গুরুজনদের প্রতি পাহাড়সম শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় আমারা নত মস্তকে জীবন বিনির্মানের রসদ খুঁজে নিয়েছি। অনুজদের প্রতি স্নেহ ভালবাসায় আমাদের সমাজ ও সংসারে ছন্দোবদ্ধ সাবলীলতা এনেছে। মানবিক মূল্যবোধে সমাজ তার স্বাভাবিক চলনে স্বাচ্ছন্দ থেকেছে। এভাবেই আঁতুড় ঘর সুসজ্জিত রেখে ভারতীয় সভ্যতা তথা বিশ্ব মানবতায় বাঙালী তার জাত চিনিয়েছে।
নৈতিকতা সহিষ্ণুতা মানবিক মূল্যবোধ এবং পারস্পারিক সহমর্মিতার প্রতিটি অঙ্গনে আম-বাঙালী সব সময় একটি আদর্শিক কক্ষপথে থেকেছে। এটা সম্ভব হয়েছে তাদের পূর্ব পুরুষের সততা নিয়মানুবর্তিতা এবং সৎ ও সরল পথে চলার হাত ধরে। ধর্ম ভীরুতা এসবের নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে বলে ভাবার যথেষ্ট কারন রয়েছে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বাঙালী সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ ছিল না বলেই হয়তো তাদের বেড়ে উঠার পথটা খুব সুখময় ছিল না। স্বাধীন রাজা নবাব সুলতান জমিদার যারাই এদেশের শাসনকর্তা হিসাবে ক্ষমতা নিয়েছেন তারা কখনোই বাঙালীর কাদা মাটির মানুষ ছিলেন না। ফলে এদেশ তার চিরায়ত ভাগ্যের লিখনে শাসক পেয়েছে, শোষক পেয়েছে কিন্তু সেবক পায়নি। সেন পাল খাঁ শাহ যারাই এ বাংলার কর্ণধার হিসাবে শাসন কর্তার আসনে বসেছেন, তারা এদেশজাত মানবকুল নয়। খান বাহাদুর রায় বাহাদুর নামের প্রবল প্রতাপশালী শাসক কুলও ওইসব বহিরাগত শাসক শ্রেণীর বংশজাত অপভ্রংশ ছাড়া কিছুই নয়। বহিরাগত প্রভুদের হাতে গোনা এ মাটির দু’চার জন বশংবদ গৃহস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরগনার শাসক হয়েছিলেন বটে, তবে তারা তাদের প্রভু ভক্তির লাগাম টানতে গিয়ে নিজের বর্ণ পরিচয় ভুলে শাসক ঠিকুজির ময়ূরপুচ্ছ লাগাতেই ব্যস্ত থেকেছেন। ফলে এই বাংলার মাটিতে বাঙালী তাদের স্বাধীন স্বদেশীয় শাসক এবং সেবক পেতে আদিকাল থেকেই বঞ্চিত হয়েছে।
এশিয়ার বৃহৎ কয়েকটি নদীর গতিপথ বাংলার বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে শেষ হয়েছে। ফলে পুরো বাংলা ভূখন্ডটাই ওইসব নদী বিধৌত পলি মাটির আশীর্বাদে পুষ্ট। প্রাকৃতিক দৈব দুর্বিপাকের সঙ্গে লড়াই করে এ মাটির মানুষকে টিকে থাকতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর আঙ্গিকে দেশ বা রাজ্য শাসন ও পুনর্গঠনের গুরুদায়িত্বে বাঙালী কখনো পা রেখেছে বলে ধারনা পাওয়া যায় না। ফলে ‘'প্রজা” হেরিডিটির আদলেই বাঙালীর চৌদ্দ পুরুষের দিনমান গেছে - এটা ধরে নেয়া যায়। যতই স্বাধীন সুলতান স্বাধীন নবাব বা রাজা মহারাজা কিংবা জমিদারীর কেচ্ছা কাহিনী আমাদের শোনানো হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে বাঙালী বরাবরই বহিরাগত বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর একটি পরাধীন ভূখন্ড হিসাবেই পরিচিত ছিল। বৃহত্তর ভারতবর্ষকে উদ্দেশ্য করে লেখা রবি ঠাকুরের “শক হুনদল মুঘল পাঠান এক দেহে হোল লীন”এর প্রকৃত আধার ছিল এই সুজলা সুফলা বঙ্গভূমি। বাঙালীর মেধা ও শিল্প সাহিত্যের স্ফুরনেই মূলত: ভারতবর্ষের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রকাশ বিকশিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এক সময় কলকাতা কেন্দ্রিকতায় ভারতবর্ষের রাজনীতি এবং শাসন নীতির ব্যবস্থাপনা আবর্তিত থেকেছে। এর যোগফলে বাংলার সার্বিক উৎকর্ষতায় কতটুকু সফলতা এসেছে তা গবেষনার বিষয় হলেও শাসন ক্ষমতার চেয়ারে বসে দেশের শাসক ও সেবক হওয়ার মিশনে তাদের অংশীদারিত্ব কতটুকু ছিল সেটাও নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে দাসত্ব ও কর্মচারীর ঔজ্জ্বল্যে বাঙালী বরাবরই সুনাম কুড়িয়েছে বলে আমরা জেনেছি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের অনুশীলনে বাঙালী রাজনীতি আস্তেধীরে শাসনতন্ত্রের ফেরিফেরিতে পা রাখার সুযোগ পেয়েছে। তবে তা আপন স্বত্ত্বার সোল অথারিটির ক্ষমতা নিয়ে নয়। সেক্ষেত্রে মুখাপেক্ষী হয়ে ক্ষমতা ভোগের আঙ্গিনায় সেবকের ভূমিকায় শাসক হয়ে বিকশিত হওয়ার স্পেস কতটুকু ছিল তা পরিমাপ করার সুযোগ তার হয় নি। ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও ক্ষমতার মানদন্ডে তার ক্ষমতার নিরঙ্কুশতা বাঙালীময় ছিলনা বলেই মনে করা হয়। তাছাড়া ধর্মীয় হানাহানি অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফ্যাসাদেই বাঙালীর পঁচিশটি (১৯৪৭-১৯৭১) বছর পার করতে হয়েছে। এই পঁচিশ বছরে বাঙালী মোটা দাগে হিন্দু মুসলিম দুটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আত্মীকরন হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা গ্রহন বা এর প্রায়োগিক বাস্তবায়নে বাঙালী তার একক সিদ্ধান্তে ব্রাত্য ছিলেন। ক্ষমতার দাপট তারা দেখেছেন। রাজনীতির অনুশীলনে ক্ষমতার সেবক হয়েছেন ঠিকই কিন্তু ক্ষমতার পারিপার্শ্বিক আচরনে বা টানাপোড়েনে তারা ক্ষমতা প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে সফলতা পান নি। এক্ষেত্রে বাংলার পশ্চিম ভাগের বাঙালীরা রাজ্য পেলেও প্রকৃত অর্থে তারা রাজত্ব পাননি বললে ভুল হবে না। আপন অস্মিতায় প্রস্ফুটিত হওয়ার অদম্য বাসনা নিয়ে এগোতে চাইলেও আল্টিমেটলি তারা ভারতীয় পরিচয়েই বাঙালী। ফলে নিজস্ব আঙ্গিনায় আপন আঙ্গিকে থাকার চটকদার গালগপ্প থাকলেও শেষ দাঁড়িটা তাদের ভারতীয় হয়েই টানতে হয়। সুতরাং তাদের ক্ষমতা গ্রহন ও দায়িত্ব পালনে কোথাও যেন একটা শুভঙ্করী ফাঁক রয়ে গেছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাঙালীর পুর্বাংশ তাদের চাহিত স্বাধীনতায় আপন অস্তিত্বের খুঁটি গেড়েছে। ফলে আপন অস্তিত্বের বটতলায় দাঁড়িয়ে তারা বাঙালীর জন আকাঙ্খায় নিজস্ব কায়দায় শাসন ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো নির্মানের সুযোগ পেয়েছে। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও বিদেশ নীতিতে তারা বিশ্বময় বাঙালীয়ানার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সুষম সমাজ গঠনের ব্যর্থতা,রাজনীতি অনুশীলনে অপরিপক্কতা, ব্যক্তি প্রাধান্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা এগিয়ে নেয়া, রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে রাজনীতি মিলেমিশে একাকার করে ফেলা, সর্বোপরি পরিবার তান্ত্রিক ভাবধারায় ব্যক্তি একনায়কত্বে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে জন্ম লগ্ন থেকেই বাঙালী তার গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় বার বার হোঁচট খেয়েছে। নিজস্ব ভূখন্ড সৃষ্টি করে বাঙালী স্বাধীন সার্বভৌম হয়েছে ঠিকই কিন্তু হাজার বছরের মোসাহেবী চাকর বাকরের অভ্যস্ততায় ‘'কি হনুরে’’র শাসক হয়ে নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য বেমালুম ভুলে গেছেন। দায়িত্ববান বিনয়ী শাসকের পরিবর্তে তারা প্রবল পরাক্রান্ত শাসনকর্তা হয়েছেন। রাষ্ট্র শাসনের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে তারা স্বেচ্ছাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বৈরাচারী হয়েছেন। সুতরাং “ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক করে কিন্তু দায়িত্ব মানুষকে বিনয়ী করে”র এই আপ্তবাক্য আজ ক্ষমতার দাপট ও দাম্ভিকতায় ন্যুব্জ হয়ে বাঙালীকে তার দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে ছিটকে দিয়েছে।।