জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভাবনাগুলি সাম্প্রদায়িক নয়-২
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:১৯ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
আমরা যখন প্রথম রাজনীতির অনুশীলনে পা রেখেছিলাম তখন বলতে গেলে আমাদের প্রশিক্ষিত বা স্মার্ট কর্মীবাহিনী ছিল না। সামষ্টিক চিন্তায় জনপদ বা গোষ্ঠীর মেরুকরন এবং তাদের একত্রিত হয়ে কোন পাটাতনে সওয়ার হওয়ার খুব বেশী উদাহরন আমাদের এই পূর্ব বঙ্গের জনপদে ছিল না বললেই চলে। তবে কমিউনিজমের ছিটেফোটা বিচ্ছুরনে তারুন্য যুথবদ্ধতার একটা তাগিদ ছিল। সাধারন জনগনের রাজনৈতিক সচেতনতায় নিজেদের অভাব অভিযোগ বা সামাজিক আন্দোলনে সামষ্টিক দেন দরবারের জন্য কোন মঞ্চ বিংশ শতাব্দীর আগে দেখা গেছে বলে মনে পড়ে না। সমাজ বিজ্ঞানী বা ইতিহাস বেত্তাদের মতে রাষ্ট্রের গঠন প্রকৃতি ও শাসন ব্যবস্থায় বৃহত্তর বাংলার কোর বা কোরিয়ামের অংশে (পুর্ব বাংলায়) দীর্ঘকাল যাবত বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায় খন্ড খন্ড ভাবে রাজ্য, সুলতানত, নবাবী, জমিদারী, মোড়লী ইত্যাদি ধরনের শাসন শোষনের বন্দোবস্ত গড়ে উঠেছিল। ফলে হতদরিদ্র ও অশিক্ষিত জনপদে মানব কল্যান বা জনবল উন্নয়নে কোন সামস্টিক উদ্যোগের তাগিদ তদাঞ্চলে ছিল বলে মনে করার কোন কারন নেই। সামন্ত প্রথার রাজা নবাব জমিদারীর খেয়াল খায়েসেই এই জনপদের ভাগ্যলিপির রোজনামচা আবর্তিত হতে থাকে। সেক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে রাজনীতির চর্চা একটু একটু করে হলেও এগোচ্ছিল। কিন্তু জনপদে মোড়লী এবং সামন্ত প্রভূত্বের ছায়া, পাশাপাশি ধর্মীয় উলঙ্গপনার যৌথ ডিগবাজিতে মানুষ তার আপন অস্তিত্ব নিরূপনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ঊনবিংশের শেষ এবং বিংশের প্রথমভাগে দেশে রাজনীতি ও গণতন্ত্রায়নের সূচনাকালে সামষ্টিক সমাজবদ্ধতা এবং তার সামগ্রিকতা অনুভূত হয়। জাতীয় পর্যায়ে এর গ্রহনযোগ্যতায় মানুষজনের মধ্যে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি হয়। ফলে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতি জনপদে তাগিদ অনুভূত হয়। মানুষ তার সমাজবদ্ধ জীবনে জীবন উৎকর্ষতার তাগিদ অনুভব করে। বিভিন্ন মত ও পথের আনাগোনায় সমাজ জীবনে পরিচ্ছন্ন প্রতিযোগীতার বীজ রোপিত হয়। লক্ষ্যনীয়, বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই জনপদে সেই মধ্যযুগীয় আমল থেকে মানুষ ও গোষ্টীর মধ্যে এক ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামীর কূপমন্ডুকতা তাদেরকে আলাদা স্বত্ত্বা নিয়ে চলাফেরার সহজাত শিক্ষা দিয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত প্রথা ও বিশ্বাসের প্রকৃতিগত অভ্যস্ততার কারনে। তবে ধর্মাচারনে ভিন্নতা থাকলেও জাতিগত বা গোষ্ঠীগত একতাবদ্ধতা তাদেরকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। ধর্মীয় আচরনে নিজস্ব উঠান থাকলেও জাতি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক উন্মেষে তারা সদা সচেতন ছিলেন। বাঙালী জনপদের এই অস্মিতা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সমীহ জাগানিয়াই ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী একঝাঁক তরুন তাদের ঊর্ধতন গুরুস্থানীয়দের অনুপ্রেরনায় হোক বা নিজেদের ধর্মীয় অস্তিত্বের তাগিদেই হোক - বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির খোল নলচে পালটে ফেলার এক মহাজাগতিক মিশনে বেপরোয়া হয়। প্রচলিত বাংলার চলন বলনে বৈদিক ভাষার ব্যাপক অনুপ্রবেশে বাংলাকে তারা একতরফা সংস্কৃত ভাষার ঔরষ প্রসূত করে তাকে কাগজ কলমে স্থায়িত্ব দেয়। এভাবেই বেদ বা গীতার ভাষাকে সামনে এনে বাংলার প্রচলিত ভাষা ও প্রকাশকে তারা হিন্দুময় করে তৎ ধর্মের মানুষের মনে একটি ধর্মীয় অহংবোধের ক্ষেত্র তৈরী করে।
বাঙালী মুসলমানদের সিংহভাগ(৭৫%+) ছিল ধর্মান্তরিত। তারা সমাজের নিপীড়িত নির্যাতিত নিম্ন শ্রেণীভুক্ত মানুষ ছিল। তারা অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত পর্যায়ে থাকার ফলে হিন্দু সমাজের পন্ডিত মশাইদের প্রেস্ক্রিপশনের আবর্তেই তাদেরকে সাধারন শিক্ষাদীক্ষায় এগোতে হয়। কেননা, মুসলমান সমাজের সামনের সারিতে থাকা মানুষগুলো বাঙালী হলেও তাদের চিন্তা চেতনায় এবং ব্যবহারিক জীবনে তারা আরবী ফার্সী প্রাধান্যে তাদের বিদ্যা শিক্ষার পসরা সাজিয়েছে। বাস্তবতার সুবিধাভোগে হিন্দু ব্রাহ্মন্য সমাজপতি ও শিক্ষাবিদ পন্ডিতরা বাংলা সংস্কৃতির হাল নিজেদের মত কর্ষন করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে হিন্দু প্রাধান্যে প্রতিস্থাপন করার মিশনে কামিয়াব হন। পনের শতকে রাজা গনেশের পুত্র যদু নারায়ন রায়ভাদুড়ি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ নাম ধারন করে বাংলার সুলতান হন তিনি। তিনিই বাংলা ভাষার লিখিত রূপ দিয়ে তার চর্চার বিস্তৃতি ঘটান। বাংলা ভাষার প্রথম প্রয়াস কীর্তিবাসী রামায়ন তার পৃষ্টপোষকতায় রচিত হয়েছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজ শাসকদের সরাসরি পৃষ্টপোষকতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে হিন্দু পন্ডিতদের দ্বারা বাংলাকে সংস্কৃত প্রাধান্যে এনে তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। এবং তখন থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হিন্দু বাঙালী প্রাধান্যে বেড়ে উঠে। ঋষি বঙ্কিমের মুসলিম বিদ্বেষী লেখনীর মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। এভাবেই একটি পরিকল্পিত ছকে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হিন্দু অহংবোধের প্রকাশ ঘটানো হয়। এর প্রতিফলন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও প্রাধান্য বিস্তার করে। ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্ব মূহূর্তে অখন্ড বাংলা বিভাজনের শোর উঠে। সাম্প্রদায়িক দঙ্গায় হিন্দু মুসলিম ঐক্য তলানীতে ঠেকে। হিন্দু দাদাদের ক্ষমতা লিপ্সুতা এবং বৃহত্তর ভারতের গরিষ্ঠ হিন্দু নেতাদের আস্কারা, পাশাপাশি মুসলিম জনপদের টিকে থাকার আমাঙ্খায় বাঙলা ভাগের এই সর্বনেশে আয়োজনের সূত্রপাত হয়। এটা ইতিহাসের কথা।
জিন্নাহ যখন পাকিস্তান আন্দোলনের পাটাতনে দাঁড়িয়ে মুসলিম দেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তখন তিনি কোন্ দু:খে বোনাস হিসেবে পাওয়া তার পুর্ব বঙ্গের আর্তনাদ শুনে কাতরাবেন! হয়েছিলও তাই। বৃটিশ ভাইসরয় পত্নী মিসেস মাউন্টব্যাটেন ছিলেন সোশ্যালিষ্ট হিন্দু নেতা জওহার লাল নেহেরুর ঘনিষ্ট বন্ধু। তাছাড়া কংগ্রেসের ডোমিনেটিং নেতাদের মুখগুলো সব হিন্দু ধর্মের মানুষ ছিলেন। সুতরাং তাদের হোমওয়ার্কের ইঙ্গিতে যে র্যাডক্লিপ সাহেব বাংলা ভাগের লাইন টানবেন এবং নেহেরু গান্ধীর মস্তক হেলনে তা ভাইসরয় সাহেব দস্তখত দিবেন সেটা অনুমিতই ছিল। সুতরাং এসব ইতিহাস সমর্থিত কথাগুলি বা ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি কোন্ প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক নয় তা কি কেউ বলবেন? আর আহত পাখির ন্যায় ছটপট করতে করতে একজন বাঙালী মুসলমান এইসব উদগীরন করলে তা কোন্ আঙ্গিকে সাম্প্রদায়িক হয় - সেটার উত্তর আছে কি? একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতা ভোগের আকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী জাতিস্বত্ত্বাকে ধর্মের নামে দু'টুকরো করা হোল - তার উত্তরই বা কে দেবে। যদিও সর্ব ধর্মের বৃহত্তর বাঙালী প্রেমিক সিংহভাগ মানুষ আজকাল বাঙলা ভাগের দুষ্টু চরিত্র দিল্লির তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রীর করুন মৃত্যু কাহিনী বয়ান করে তাদের গায়ের জ্বালা নিবারন করেন।
যে সুপ্ত বাসনা রেখে ভারতকে টুকরো করার সম্মতিতে বৃটিশকে ভারত ছাড়া করা হোল, প্রকৃত অর্থে সেটা কি স্বাধীন ভারতের শাসক কংগ্রেসের প্রথম কনভেনশনের রেজ্যুলেশনকে মনে করিয়ে দেয় না। কেন তারা হিন্দু ইজমের কথা মনে করিয়ে তাদের জাতীয় কনভেনশনে ভারত ভাগের ব্যাপারটা ‘সাময়িক’ বলে উল্লেখ করে! এটাও ভাবা কি সাম্প্রদায়িক! যদিও হিন্দুস্তান নামক কোন রাষ্ট্র বিধিবদ্ধ নয়, যেমন নয় হিন্দু ধর্ম, তবুও আজকের দিনে তথাকথিত হিন্দুস্তানের হিন্দু ইজমকে চাঙ্গা করতে যেভাবে ধর্মীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর স্টীম রোলার চালানো হচ্ছে তা কি সাম্প্রদায়িক নয়। মুসলমানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে সরকারীভাবে আইনের বেড়ি বসানো হচ্ছে - সেটা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদিতা না অন্য কিছু। বাঙালীর বাংলাদেশে সংখ্যা গরিষ্ঠের মুসলমানরা নিজের দেশকে শুদ্ধাচারনে আনার লক্ষ্যে ধর্মীয় রাজনীতি করলে তা হয় মৌলবাদী আচরন। পাশাপাশি দিল্লি শাসনের দেশে খোলা তলোয়ার হাতে জয় শ্রীরাম শ্লোগানে মিছিল করে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের ভীত সন্ত্রস্ত করার নাম যদি হয় সেক্যুলার ভারতের সৌহার্দ ও ভ্রাতৃতের অহংকার, তবে সেটাকে আমরা কি বলে ডাকবো? ইদানীংকালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বেহায়াপনায় রাষ্ট্রনীতি আত্মসমর্পন করার ফলে বিশ্ব খেলাধুলার জগতে যে নির্লজ্জ ও এক তরফা ঘটনাগুলো ঘটছে তা কি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার সম্মান বৃদ্ধি করছে? জন আকাঙ্খায় ক্ষণস্থায়ী শাসকের চেয়ারে বসা একজন স্যুটেড বুটেড নোবেল লরিয়েট যদি মৌলবাদী শাসনের ধারক হন, তবে কপালে চন্দন তিলক আঁকা সর্বাঙ্গ গেরুয়া আবৃত একজন সাধু দেশ শাসককে আমরা কি বলে সম্বোধন করবো?