জালাল উদ্দিন আহমেদ
এসবের মীমাংসা হওয়া দরকার
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ১০:০২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাঙালীয়ানার প্রকৃত পথ চলা শুরু হয়েছে না হলেও নব্বই বছর তো হবে। দু'এক দশক বেশীও হতে পারে। তবে কেতাবী কথার ঐসব হাজার বছরের গল্প কেচ্ছার ভিত খুব যে উজ্জ্বল তা বলা যাবে না। একদিকে সেন পালদের রেখে যাওয়া সংস্কৃতের ঝাঁজে পন্ডিত গুরুকুলীয় আয়োজন অন্যদিকে আরবি ফার্সীর অনুপ্রবেশীয় ভিত তৈরীর আয়োজন। এভাবেই বাংলা তার পরজীবি ভরের বাঙালীত্বে চলমান ছিল। আর চলমান কথাটির গুরুত্ব একারনেই প্রযোজ্য, কেননা বাংলার সুজলাং সুফলাং এর অগাধ শস্যভান্ডার ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য সে সময় অখন্ড ভারতের শীর্ষে ছিল। ফলে বাংলা ছিল বাঙালীও ছিল। কিন্তু বাঙালীর অস্তিত্ব ও অস্মিতার শেকড় কি ছিল? অবিভক্ত বাংলার সেই শেরে বাংলা থেকেই তো আমরা আমাদের অস্তিত্বের ঠিকুজি সাজানো শুরু করেছি। সত্যি কথা বলতে কি, তখনকার প্রেক্ষাপটে গোটা বাংলাটাই তখন ছিল কলকাতা কেন্দ্রিকতায় নিবিষ্ট। সেখানে আম জনতার একজন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন বটে, তবে নাটাইয়ের সুতার টানের দায়িত্ব ছিল ঐসব শান্তিপুরী ধুতির উপর চুড়িদার পাঞ্জাবী পরা ব্রাহ্মন্য বাবুদের হাতে। ফলে নিজভূমের কাদা মাটি ছেড়ে সুতোনুটির বাবুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওমুখী হয়েই তারা ১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলার মেকী মসনদের সহিস থাকার স্বাচ্ছন্দবোধে তৃপ্ত থেকেছেন। এহেন পথ চলায় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন সংস্কার ছাড়া আম বাঙালীর জন্য এপারের শেরে বাংলা নাজিমুদ্দিনরা কতটুকু শ্রম দিতে পেরেছেন তা ইতিহাসই বলে দেয়। যাহোক সাতচল্লিশের ধর্মীয় বিষাক্ত গরল যখন বাংলা ও বাঙালীর অস্তিত্ত্ব ও অস্মিতা ছিন্নভিন্ন করে শক্ত দেয়াল তুলে ফেললো, তখন রাম রহিমের বাঙালী অস্মিতা তার নিজস্ব উষ্ণতায় সুবাসিত থাকতে পারলো না। পুবে পাকিস্তানী আর পশ্চিমে হিন্দুস্তানী হয়ে তাদের ভাগ্য লিপির গননা শুরু হোল।
সে যাক! যা হবার তাতো হোল। কিন্তু বাঙালীয়ানার কি হোল? হয়েছে তো বটে! তপ্ত মস্তিষ্কের মাথামোটা জেনারেলদের হাতে পাকিস্তানী মেশিনারীজ চালু হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বাঙালী পাক্কা নয়টি বছর একটা ব্রিদিং টাইম পেয়েছিল। ফলে বাঙালী তার আপন অস্তিত্বের এই নয় বছরের বাঙালীয়ানায় কিছুটা হলেও আপন ভুবনে বিচরন করতে শিখেছে। পাশাপাশি জন্মলগ্ন থেকেই পশ্চিম ভাগের বাঙালীরা হিন্দুস্তানী আইন কানুনে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে পড়ে ‘বন্দে ভারতে’ থিতু হয়ে ‘জয় হিন্দ’টাকেই নিজেদের অস্তিত্বের মূলমন্ত্র বানিয়ে নিল। তবে এই ভাগ বাটোয়ারার হিসেব নিকেশে ধর্মই যদি সবকিছুর মূলে থাকে তবে কোন্ আহাম্মুকি বিবেচনায় হিন্দু মুসলমানের ভাগাভাগির তারাজুতে বানরের রুটি ভাগের এই চিরস্থায়ী ব্লেম গেমের খাতাটা খুলে রাখা হোল - সেটাই মাথায় ঢুকেনা। সামগ্রিকতার জাত্যাভিমানে না থেকে তৎকালীন সময়ের কোলকাতার জৌলুষ আর হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাধান্যে নিজেদের ধন্য করতে যে বাংলা ভাগের হিসেব নিকেশ হোল তা কি সমতা ও স্বচ্ছতায় নিরঙ্কুশ ছিল! ছিল না বলেই তো আজকে দেশভাগের পৌঁনে এক'শ বছর পেরিয়েও আমাদের এই জনপদে এখনো লঘু গুরুর ঝঞ্জাট চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাতায় নাম লিখে রেখেছে। নিজের পছন্দমত হিন্দু মুসলিম আলাদা জমিনে থাকার খায়েসে ভিনু যখন হয়েই গেছ তখন রহিমের ঘরে ফেলে আসা রামের কি হোল না হোল কিংবা রামের হেসেলে রহিমরা খেলো না মলো তাতে কি আসে যায়!
সত্যি কথা বলতে কি, এই হিন্দু মুসলিম শব্দ যুগল ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ। এটাকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা কোন বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের আছে বলে আমি মনে করি না। যতই হরপ্পা মহেঞ্জোদারো বৈদিক আর্য মৌর্য গুপ্ত সেন পাল বা শিবাজী ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা হোক না কেন, আধুনিক ভারত বিনির্মানের মূল কারিগর ছিলেন মধ্য প্রাচ্য ও এশিয়া মাইনর থেকে আসা মুসলমান সম্প্রদায় ও শাসকেরা। তারা যেমন শাসক ও ধর্ম প্রচারক হিসাবে এসেছিলেন, পাশাপাশি এদেশকে ভালবেসে এদেশের পথে প্রান্তরে নিজেদের প্রজা বাৎসল কর্মযজ্ঞের নমুনাগুলি রেখে গেছেন। তারা এদেশকে ভালবেসে এদেশেই থিতু হয়েছিলেন। এদেশের আর্থ সামাজিক ভিতকে মজবুত করে বিশ্ব দরবারে সমীহ জাগিয়েছিলেন। মহান ভারতের একাত্মতা ও তার বলিষ্ঠ অস্তিত্ব তারাই গড়ে দিয়েছেন। অথচ মুসলিম পূর্ববর্তী ভারতের পূর্বতন স্থানীয় রাজা মহারাজাদের দেখেছি অঞ্চল ভিত্তিক শাসক ও শোষক হিসাবে। উত্তর পশ্চিম বা দক্ষিন ভারতের পাল সেন বা মৌর্য গুপ্তদের আমরা সর্ব ভারতীয় হতে দেখিনি। এমনকি যে শিবাজীকে নিয়ে আমাদের ব্রাহ্ম ঠাকুর মশাই শিবাজী উৎসবের আয়োজন করে মারাঠী বীর শিবাজীকে ভারত শ্রেষ্ঠ বীর বানিয়ে কবিতা উৎসর্গ করলেন সেই শিবাজী কখনোই মহারাষ্ট্রের বাইরে বেরিয়ে ভারতীয় বীরের সমতায় উঠতে পারেন নি। বাঙালীর তো নয়ই।
যে কথা বলার খায়েসে কলম ধরা, তার মূলে এখন আসা যাক। হিন্দু মুসলমান এই দুটি সম্প্রদায়ের সামষ্টিক যোগফল হোল ভারতবর্ষ। যে যতই বলুক, হিন্দু মুসলিম শিখ ইশাই - পরের দুটি হোল লেজ। ঠিক আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশেও ইদানীং এই কালচার বেশ জায়গায় করে নিয়েছে। তারা(অবশ্য তারা নিজেরাই) বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান পরিষদ। কিসের কি! বৌদ্ধ খ্রীষ্টান! কয়জন হবে তারা। তাছাড়া অসাম্প্রদায়িক দেশে এ আবার কিসের পরিষদ। সব যেন রাজনীতি আর ব্যক্তিগত ফায়দা লুটে প্রথম সারির বেঞ্চে বসার ফন্দি ফিকির। কয়জন সাধারন হিন্দু বৌদ্ধ বা খৃষ্টান এর মাধ্যমে আর্থ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বলা যাবে কি? সাম্প্রদায়িক বিষে একটি জাতিস্বত্ত্বাকে বিষিয়ে দিয়ে সেই বিষকে নির্বিষ করার এ এক লোক দেখানো নাটক ছাড়া আর কি হতে পারে! স্রেফ রাজনীতির তঞ্চকতা ছাড়া কিই বা বলা যায় এটাকে। তবে এসবের একটা মজেজা আছে। ঊনবিংশ শতকে বৃটিশ বেনিয়া শাসকেরা যখন দেখলো বুদ্ধি ও শক্তি সামর্থে ভারতীয়রা তাদের থেকে ঢের বেশী এগিয়ে, তখন তারা বিভাজনের মন্ত্র গাঁথায় ভারতীয়দের মনে বিষ ছড়িয়ে দিল। এই বিভেদ বা বিভাজন ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ ছড়ানো। কারন একটাই। তা হোল তাদের শাসন ও শোষনের পথকে মসৃণ করা। পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব মুহুর্তে যে সাম্প্রদায়িক অগ্নিশিখায় ভারতীয় জাতিস্বত্তার বিভেদের লক্ষ্মনরেখা তারা টেনে দিয়ে গেল সেই তুষের আগুনের আঁচেই ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ আজও জ্বলছে। এই অনন্ত যাত্রার যাত্রী হয়ে আমাদের এখনো সেই ধর্মীয় জাত্যাভিমানের অভিশাপে অভিশপ্ত হতে হচ্ছে অহর্নিশি।
এসবের কি শেষ নেই! বোধ হয় নেই। যতদিন না পর্যন্ত ‘হিন্দু’ ধর্ম হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাবে ততদিন এই হিন্দুয়ানী হীনমন্যতায় ভারতীয়রা এভাবেই তাদের হাজারো দেব দেবীর গুন-সংকীর্তনে নিজেদেরকে জাহিরে ব্যস্ত থাকবে। এই দেব দেবীর শ্রেণী বিন্যাস করতে গেলেই জাতিতে বর্ণে গোষ্ঠীতে যে অসন্তোষ বা ঝগড়া ফ্যাসাদের সুত্রপাত হবে সেটার মীমাংসা করার ঐক্যমতে কি তারা কোনদিন এক হতে পারবে! তাছাড়া হিন্দু ট্রাম কার্ডের বিশালত্বে আর্য অনার্যের সেই পুতে দেয়া বীজ উপড়ে ফেলতে না পারলে এই হিন্দুয়ানীর একাত্মতায় কি কোন সুষমতা আসবে? কস্মিন কালেও নয়। কারন তাদের এই হিন্দু ইজমের অভ্যন্তরে যে বৃটিশ শাসনের বিভাজনের বীজ রোপন করা আছে তার বিষাক্ত বীজ উপড়ে ফেলা না পর্যন্ত ধর্মীয় সুষ্ঠতায় তারা কতটুকু এগোতে পারবে তা সময়ই বলে দেবে। প্রকৃত অর্থে হিন্দু কোন স্বীকৃত ধর্ম নয়। হিন্দু একটি জাতি স্বত্তা। এই জাতিস্বত্তার একাত্মতায় তারা যেদিন এক মোহনায় মিলে নিজেদের ধর্মীয় একাত্মতায় একাট্টা হতে পারবে সেদিন থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সার্বজনীনতা তাদের বর্তমান হীনমন্যতার দুয়ার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র যদি তাদের সনাতনী চেতনা নিয়ে ধর্মকে সামনে আনে এবং নিজেদের ধর্মীয় বর্ণবৈষম্যের সমাধান অন্তে গরিষ্ঠ ধর্মীয় সনাতনী সম্প্রদায়কে যেকোন নামে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্টা দেয়, তাহলে চলমান হানাহানি অবিশ্বাস অসন্তোষ বরাবরের মত শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারন রয়েছে। ধর্মকে সামনে রেখে রাজনীতি হবে, আবার সেই ধর্মকে সার্বজনীন করা হবে না - এই দ্বিমুখী আচরনে আখেরে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী। এটা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করা যায়, আঞ্চলিক অখন্ডতা ও সৎ প্রতিবেশীর বিশ্বস্ততায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলে আমরা মনে করি। মনে রাখতে হবে সর্বধর্মের সামষ্টিক পরিচয়ে তারা ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান। তা কখনোই হিন্দু নয়।
যেহেতু হিন্দু একটি জাতিস্বত্ত্বা বিধায় তাকে কখনোই ধর্মস্বত্ত্বায় ফেলে এগিয়ে যাওয়া বিজ্ঞজনের কাজ নয়। মনে রাখা দরকার বাংলাদেশে কোন হিন্দু বাস করে না। যারা আছেন তারা সনাতনী ধর্মে বিশ্বাসী বাংলাদেশী জাতিস্বত্ত্বার মানুষজন। তারা কখনোই হিন্দুস্তানী জাতীয়তার হিন্দু নয়। তাছাড়া হিন্দুস্তান এবং হিন্দু এই শব্দ যুগল রাষ্ট্র স্বীকৃত কোন বিষয় কিনা সেখানেও হাজারো প্রশ্নের কানাঘুষা রয়েছে বলে আমরা জেনেছি। এমতাবস্থায় এই তথাকথিত 'হিন্দুর’ সোল এজেন্সি নিয়ে কেউ যদি অহেতুক বাগাড়ম্বর করে তখন তাকে বা তাদেরকে আহম্মক ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! অপরদিকে সনাতনী ধর্মালম্বীরা হিন্দু সাজতে গিয়ে যে ঘোট পাকানোর মানসিকতায় নিজেদেরকে অরক্ষিত করার মরন নেশায় বুঁদ হয়েছেন বা হতে চান তা মোটেই তাদের অস্তিত্বের জন্য শুভ লক্ষ্মন নয় বলে বিজ্ঞ জনেরা বলাবলি করেন। সনাতনী ধর্মালম্বীরা যত তাড়াতাড়ি এটা অনুধাবন করবেন তা ততই মঙ্গলময় হয়ে তাদের সামষ্টিক কল্যানে ফল বয়ে আনবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা বোধের আকাঙ্খায় তারা পোক্ত অংশীদারিত্বের দাবিদারও হবে।