জালাল উদ্দিন আহমেদ
সংস্কারের গলিপথ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ নভেম্বর, বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:০১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দেবপ্রিয় ভট্যাচার্য একজন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবি। দেশের হাতে গোনা বুদ্ধিজীদের একজন। অবশ্য এই ‘বুদ্ধিজীবি’ নামক জটিল অংকের চার পাঁচটি ধ্বনিযুক্ত শব্দটি আমাদের এই বাঙাল মূলুকে ইদানীং বেশ খ্যাতি কামিয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে যিনি তার জীবিকা নির্বাহ করেন তিনিই বুদ্ধিজীবি। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র জীবনে জ্ঞান চর্চার শিখরে থেকে যারা তাদের আহরিত জ্ঞানের আলোকিত নির্যাসগুলি রাষ্ট্র সমাজ তথা জনপদ গঠনের কল্যানে অকাতর হন, তারাই আমাদের সমাজ কাঠামোয় আলোকিত মানুষ হিসাবে বিচরন করেন। যদিও রাষ্ট্র কাঠামোর রাজনৈতিক তঞ্চকতায় সমকালীন সময়ে আমরা এসব মেধা বিদ্যা বুদ্ধি ইত্যাদির ধার ধারি বলে মনে পড়ে না। নাম বাচ্যের গুনকীর্তন সংকীর্তন ইত্যাদি করতে করতে নিজের আনুগত্যের পারাকাষ্টায় উত্তীর্ণ হও, তারপর এসো তোমার জ্ঞান বুদ্ধির ডালি সাজিয়ে। শর্ত একটাই - বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ভাবধারার ভিতরে থেকেই আওড়াতে হবে। লক্ষ্মন রেখা পেরোলেই অকেজো ওএসডি বা বিরুদ্ধবাদী গোষ্টীর তকমা নিয়ে জীবিকা নির্বাহের অলিখিত খড়্গ। রাজনীতির তঞ্চকতায় এভাবেই চেতনা নাশক জারিজুরি দিয়েই চলেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিইয়ে রাখার সাড়ম্বর আয়োজন। আলোচনায় ভিন্নতা থাকলেও বলতে দ্বিধা নেই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি তারাই বেশী উচ্চারন করেন যারা গত তেপান্ন বছরের এই স্বাধীন মুক্ত দেশে এর মৌলিক উদ্দেশ্য ও চাহিদাকে পদে পদে অপদস্ত করেছেন। যাকে শিরোমনি ও শিরোধার্য মেনে আপামর বাঙালী নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সৃষ্ট এই বাংলা ভূখন্ডকে তার হাতে তুলে দিয়েছেন, সেই তিনিই ‘'তাল গাছটা আমার” ভেবে নিয়ে বাংলার মানুষদের প্রজার অবজ্ঞায় নিজেকে আমৃত্যু রাজা বানিয়েছেন। প্রবল প্রতাপে রাজ সিংহাসন সাজাতে গিয়ে তিনি অকাল প্রয়াত হয়েছেন। ফলে শক্ত ভিতের উপর তারই তৈরী রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্ব কাঠামোয় কামড়া-কামড়ি শুরু হলে তখন অনুগতরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে শিরোমনির দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে নেতৃত্বের চাবি তুলে দিয়ে তারা আশস্ত হতে চান। কিন্তু রক্ত পরম্পরা বলে কথা। পিতৃ পরম্পরার ডিএনএতে যেখানে ক্ষমতাই সবকিছুর মাপকাঠি, সেক্ষেত্রে চেনা পথে হাঁটতে গিয়ে বংশ পরম্পরার দ্বিতীয় প্রজন্ম মাফিয়া স্বৈরাচারীর ভূমিকায় দেশটাকে সর্বশান্ত করে ছাড়ে।
শান্তি ও সাম্যের বাঙালী দেখলো এবং উপলব্ধি করলো রাজনীতির গতানুগতিক ধারা তাদের মুক্ত নি:শ্বাস ও মৌলিক অধিকারের বদলে শুধুমাত্র ক্ষমতা বদলের ভোটটাকেই একমাত্র ইস্যু করে ঢিমেতালে চলার চক্র বানিয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের সাধারন জনগন অরাজনৈতিক যুথবদ্ধতায় ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছকে নিজেদের সম্পৃক্ত ক’রে দেশ থেকে স্বৈরাচারী শাসককে বিতাড়নের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বা তাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তবে সেটা করতে গিয়ে বাংলার সহস্রাধিক তরুন যুবা ও সাধারন মানুষেকে বুকের রক্ত দিতে হয়েছে। ছাত্র জনতার চাহিদায় দেশে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হোল। জনগনের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আসার পর দেখা গেল এত দিনের উন্নয়নের সাতকাহনে যেসব গল্প কেচ্ছা বানিয়ে শুধু ইট পাথরের চাকচিক্যে বাঙালীকে ঘোরের মধ্যে রাখা হয়েছিল তা স্রেফ সেই খনার বচনের বাক্যটিকেই মনে করিয়ে দেয় (উপরে চিকন চাকন ভিতরে ভস্কা বেগুন)। মাফিয়া স্বৈর শাসকের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার গত দেড় দশকে দেশের প্রতিটি সেক্টরে আনিয়ম অরাজকতার মচ্ছ্বব করে আর্থিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইন শৃঙ্খলার অধ:পতনে দেশটাকে দেউলিয়া করা হয়েছে। এখন দেশকে নতুনভাবে গড়ার শপথে অন্তর্বতী সরকার জেঁকে বসা দুর্নীতি ও অনিয়মের মূল উৎপাটনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের কাজে হাত লাগিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো প্রবীন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে দেশের অর্থনীতি অবকাঠামোর উপর ডাইগনস্টিক স্টাডি করে একটি স্বয়ং সম্পন্ন রিপোর্ট দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। তিনি তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে দেশের বিগত উন্নয়ন প্রকল্প সমূহের খুঁটিনাটি সবকিছুই দেখছেন বলে মনে হয়। তিনি এই অর্থনীতির আঁতুড় ঘরে ঢুকে তার হাঁড়ির খবর নিচ্ছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। গত ক'দিন আগে পত্রিকার খবরে দেখলাম তিনি সরকারের মেগা প্রকল্পগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সচিব, প্রকল্প পরিচালক এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে মতবিনিময় বা ক্রসচেক করে যেটা পেয়েছেন তার সারমর্ম হোল কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাওয়ার সেই পুরনো কাহিনী। এক্ষেত্রে কর্তাটিকে পরিণত করে বিকশিত করার সুচারু দায়িত্ব পালিত হয়েছে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরন করা অতি উৎসাহী ও লাই পাওয়া সেইসব চেটে উঠা মহামান্যবরদের মাধ্যমে যারা কালের পরিক্রমায় যোগ্য ও সরকার বান্ধব কর্মচারী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন। সেই তারাই আবার নিজেদের যোগ্য প্রমানে রঙ বদলিয়ে বেসুরো কথা বলবেন এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে কি! নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার কথা একটু শেয়ার করে বিষয়টি পরিস্কার করতে চাই। সে পঁচিশ তিরিশ বছর আগের কথা। দেশের চামড়া শিল্প ও পরিবেশ দূষন ইত্যাদি নিয়ে একটি ধুমায়িত অসন্তোষ তখন জনপদে মাথা চাড়া দেয়া শুরু করেছে। পরিবেশ আন্দোলনের নাসির খান এবং আজকের মাননীয় উপদেষ্টা রেজওয়ানা আপারা সেসময় পরিবেশ আন্দোলন ও জন সচেতনতা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছেন। আমি শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিধিবদ্ধ একটি করপোরেশনে তখন নির্বাহী প্রকৌশলী পদ মর্যাদায় চামড়া শিল্প বিশেষজ্ঞ হিসাবে কর্মরত। মনে পড়ে পরিবেশ বান্ধব চামড়া শিল্প নগরী স্থাপনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমার লেখা আর্টিক্যাল সমূহ সেসময় দেশের পত্রিকা ম্যাগাজিনে ছাপা হোত। সে সময় (৯৮-৯৯ সালের দিকে) দেশের উত্তর পশিমাংশের কোন এক জেলার তৎসময়ের মাননীয় সংসদের চাহিদামত সেখানে টেনারী স্থাপনের দাবি জানানো হয়। প্রথামত প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহনের নিমিত্তে জাতীয় সংসদের কার্যবিবরনীর কপি শিল্প মন্ত্রনালয় হয়ে তা সরকারী চামড়া শিল্প বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমার মতামত চাওয়া হয়। যথাযথ স্টাডি পূর্বক আমি আমার স্টাডি রিপোর্টে দেশের উত্তর পশ্চিমের জেলা দিনাজপুরে এই ঘন পরিবেশ দূষনযুক্ত ভারী শিল্প স্থাপনের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছিলাম। বিস্তারিত না বলে শুধু এটাই বলতে পারি কর্মস্থলে এটা নিয়ে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়লেও চুড়ান্ত বিচারে সত্যটাই সাব্যস্ত হয়েছিল। অবশ্য তখনকার প্রেক্ষিতে চেটে উঠাদের গ্রুপ ভিত্তিক দৌরাত্ম্য ততটা জমে উঠেনি। যাহোক চেটে উঠা আর খেটে উঠাদের গল্প বলতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চেয়েছিলাম তার সারমর্ম হোল সরকারী মেকানিজমে মিড লেভেল থেকে টপ লেভেল পর্যন্ত কর্মকর্তা বিন্যাসে এক ধরনের চেইন তৈরী করে নেয়া হয় যারা তাদের যোগ্যতার পাশাপাশি আরো একটি যোগ্যতা অতি সন্তর্পনে লালন করে থাকেন। ফলে এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে পা দিয়ে রাখা কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দেশপ্রেমের শুভ চিন্তায় কোন সুখকর সিদ্ধান্ত এবং তার ব্যাখ্যা টপ লেভেল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। সেক্ষেত্রে দেশীয় আঙ্গিকে গড়ে উঠা প্রজাতন্ত্রের কর্মক্ষেত্রের তরুন ও উদ্যমী কর্মকর্তারা দেশপ্রেমের যে আকাঙ্খায় দেশ গড়ার কর্মী হতে চেয়েছিলেন তা যেন সেই দু'শ বছর আগের বৃটিশ দাওয়াইয়ের রাজ কীর্তনের গুলি(ট্যাবলেট) খাইয়ে শুরু করতে হয়।
এর বেশী ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু বলতে চাই, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করে নিজেদের উৎকর্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এভাবেই যুগে যুগে আমলা তান্ত্রিক মন্ত্রগাঁথায় কর্তা মশাইকে স্লো পয়েজনিংয়ের মাধ্যমে জনতার রেলগাড়ির মূল ট্র্যাক হতে লাইনচ্যুত করানো হয়। এক্ষেত্রে আমলা তান্ত্রিক জটিল অংকের সাথে তাল মিলাতে না পেরে অপরিপক্ক রাজনীতির নীতি বর্জিত অব্জেক্টগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের বিনিময়ে জনস্বার্থ বিরোধী কর্মধারায় উৎসাহিত হন। এভাবেই ক্ষমতা ও লক্ষীর একছত্র নিরঙ্কুশতায় শীর্ষবিন্দুর এক নায়কোচিত আচরনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অপরাজনীতির মচ্ছ্ববে দেশের কাঠামোগত বিন্যাসে ধ্বস নেমে আসে। আজকের দিনে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার ব্যবস্থায় যখন সত্যের সন্ধ্যানে অসত্য ও দুর্নীতির সেইসব দুর্বিনীত হিসাব নিকাশের পথচলা শুরু হয়েছে তখন সরকার পরিচালনার মূল কারখানা সেই সরকারী মেকানিজমের হেঁসেলেই তো ঢুঁ মারতে হবে! আর সেখানে গিয়েই তো আমাদের বর্তমান সহিসদের শুনতে হচ্ছে সেই তোতাপাখির গল্প, ‘আমরা তো জনতার কর্মচারী। আর জনতার নির্বাচিত মন্ত্রী এমপি তো আমাদের হুকুমদাতা কর্তা’। সুতরাং সেই পুরনো কাহিনী - ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’’।
ক্যান্সারের বিভিষিকায় আচ্ছন্ন রাষ্ট্রযন্ত্রের এই গলিপথ, সংস্কারের কোন মহাষৌধে নিরাময় হবে সেটাই এখন আযুত সহস্র প্রশ্ন।