জালাল উদ্দিন আহমেদ
গুইসাপের কামড়
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ অক্টোবর, বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:৩৯ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
Clinton Global Initiatives - leaders Stage নামক এক সম্বর্ধনা সভায় ড. মোহাম্মদ ইউনুসের প্রানবন্ত আলোচনা শুনলাম। শুধু শুনলাম বলাটাও বোধ হয় অসম্পুর্ণ হবে। কেননা বতৃতা দেয়ার ফাঁকে তিনি তার ইউনুস সুলভ আচরনের যে ক্যারিশমা দেখালেন সেটাই বোধকরি পৃথিবীর তাবড় স্রোতা ও দর্শকদের অভিভূত করেছে। তাছাড়া Global initiatives for Women empowerment এবং Leadership for young generation এর উপর তার প্রানবন্ত আলোচনা এবং অনুষ্ঠানের ফাঁকে নেতৃত্বের তরুন যুবাদের উপস্থাপন করে অনুষ্ঠানটিকে উৎসব মুখর ও জীবন্ত করে রাখার কৌশলটি ছিল সত্যিই অনবদ্য। জাতি সংঘের ৭৯ তম সাধারন পরিষদের অনুষ্ঠানে যোগদান উপলক্ষ্যে মাত্র চারদিনের আমেরিকা সফরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা - তা লক্ষ্য করার মতই বটে। হোক না তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন! কিন্তু আমেরিকার একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বব্যপী তার অসামান্য জনপ্রিয়তায় তিনি এখনও তুঙ্গে। সেই ক্লিনটন সাহেব যখন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হয়ে আমাদের সম্মানিত অন্তর্বতী সরকার প্রধান ড. ইউনুসকে তারুন্যের আমেজে যে স্টাইলে উঁকিবুকি করলেন কিংবা আবেগে বক্তৃতা মঞ্চে জড়িয়ে ধরলেন, তখন সেই দৃশ্যের পোস্ট মর্টেমে তিনি কি বাংলাদেশের সরকার প্রধান না নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনুস সেটা ভাবতে গিয়েই আমি দশ সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে ঐ দৃশ্যের দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ছিলাম। এমনকি নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক পরবর্তীতে মুহম্মদ ইউনুসের সঙ্গে আলিঙ্গনরত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঐ আন্তরিকতার দৃশ্যটি আমাকে অভিভূত করেছে।
সত্যি কথা বলতে, আমরা যে বিশ্ব দরবারে একটি বহুল পরিচিত জাতিস্বত্বা তা যেমন খেলার মাঠে রাজত্ব করে শাকিব আল হাসান নামক সোনার ছেলেটি নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে জানান দিয়ে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন তেমনি মুহাম্মদ ইউনুস নামের একজন বাঙালাদেশী নোবেল লরিয়েট অন্তর্বর্তী কালীন সরকার প্রাধান হয়ে বিশ্বমঞ্চের জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানের মাধ্যমে আমাদের সম্মান ও অর্জনকে বহুগুনে মহিমান্বিত করেছেন। আমরা যে একটি সম্মানিত জাতি তার প্রতিফলন এবারকার জাতিসংঘ ৭৯তম সাধারন পরিষদের সম্মেলনে তা বিচ্ছুরিত হয়েছে। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, তথাকথিত বিগত গনতান্ত্রিক সরকার প্রধানের হ্যাংলামীর সেলফি তুলা কিংবা জি-২০ সম্মেলনে আমাদের অনাহুত সরকার প্রধান গান্ধী সমাধিতে পুষ্প অর্পনের নিমিত্তে রেড কার্পেটে হাঁটার সুযোগ না পেয়ে রেশন দোকানের লাইন ভাঙ্গার দৃশ্যে ঘাসের মধ্যে দৌঁড়ে দৌঁড়ে মোদি বাবুর পাশে থাকার যে আকুতি দেখিয়েছেন তা এখনও আমাদের লজ্জা দেয়। বরঞ্চ মাত্র সাতজন সঙ্গী নিয়ে চার দিনের জাতিসংঘ নিউইয়র্ক সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনুস যে সম্মান ও সমর্থন পেলেন এবং যেভাবে পেলেন তা সত্যিই এক যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
আমি কিন্তু বিশ্ব দরবারের কথা বলেছি। আর এই অনুচ্ছেদটা কেন আমাকে লিখতে হচ্ছে, তার মজেজা আছে বলেই তো একটু ব্যাখ্যা দেয়ার তাগিদ অনুভব করছি। কথায় আছে, ‘ভাত দেবার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই’। আমরা তো সেই অভুক্ত কিল খাওয়ার লক্ষ কোটি আম-জনতা, যারা গোঁসাইদের হাজারো কিল থাপ্পড় খেয়েও জয় বাংলা বা জিন্দাবাদের ঝান্ডা উঁচিয়ে নিজেদের ঘরে জন্ম নেয়া সেইসব গোবরে পদ্মফুলের পরম্পরাদের নিয়ে আশায় বুক বাঁধি। উপরের অনুচ্ছেদে তিনটি উদাহারন টেনেছি। বাংলাদেশী সাকিব আল হাসান একজন বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড়। তিনি যে অর্জনে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন সেটা বাংলাদেশেরও অর্জন বলে আমরা গর্বিত হয়েছি। বিশ্বসেরা ক্রিকেট খেলোয়াড় হয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সুনাম ও পরিচিতি বাড়িয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুস একজন নোবেল লরিয়েট হিসাবে বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত ও সমাদৃত ব্যক্তিত্ব। বিশ্বব্যাপী তাঁর মত নোবেল লরিয়েট হাজারে হাজার রয়েছেন কিন্তু ‘বাসযোগ্য পৃথিবীর’ শ্লোগান ও তার প্রায়োগিক বাস্তবতায় তিনি তাঁর ৩-০ এপ্লিকেশন পৃথিবীর শতাধিক দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর সেই তিন শুন্য শ্লোগান হচ্ছে দারিদ্র, বেকারত্ব ও কার্বন নি:সরণ শুন্যে নামিয়ে আনা। তাঁর ভাষ্যমতে, এসব অর্জন করতে গেলে প্রয়োজন তারুন্য, প্রযুক্তি, সুশাসন এবং সামাজিক ব্যবসা। টেকসই উন্নয়নে তার এই তত্বের প্রয়োগে আজ বিশ্বব্যাপী শতাধিক দেশে ইউনুস সেন্টার স্থাপিত হয়েছে যার মাধ্যমে তারা ড.মুহম্মদ ইউনুসের এই ধারনাকে বাস্তবায়নে সফল হচ্ছেন। পৃথিবী ব্যাপী ধনী গরীব প্রায় সমস্ত দেশেই এই নোবেল লরিয়েটের চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের সরকার প্রধান হওয়ার বদৌলতে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ব মঞ্চে তার গ্রহনযোগ্যতা যেকোন সরকারী আমলের থেকে শ্রেয়তর হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের ভূ-ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে বাঙালীর এই দুই কৃতি সন্তান বিশ্বমঞ্চে দেশের গ্রেট এম্বাসেডর হিসাবে আমাদের চলা বলা ও চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশের আশীর্বাদ হয়ে আমাদেরকে আলোকিত করেছেন।
আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয় পরবর্তী প্রথম সরকার প্রধান হিসেবে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করেন। সে পঞ্চাশ বছর আগের কথা (১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে)। তবুও কিছু কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য ছবি দেখে বুঝাতে অসুবিধা হয় না যে অহংবোধের নেতৃত্ব কতবড় কাঁটা হয়ে ভবিষ্যতের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির জন্য দৃষ্টি কটু হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের পহেলা অক্টোবর, ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট জেরার্ড ফোর্ডের সঙ্গে পাশাপাশি আলোচনায় বসার ফটো সেশনে আমাদের নেতার চুরুটে আগুন ধরানোর দৃশ্য এবং পায়ের উপর পা দিয়ে বসার সেই অহংবোধের আচরন এখনও ছবি হয়ে জীবন্ত রয়েছে। একটি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ও সদ্য স্বাধীন ক্ষুদ্র ও অনুন্নত সরকার প্রধানের ঐ আচরন সেদিন কতটুকু দাগ কেটেছিল জানি না। তবে এখনকার দিনে সেটা হয়তো সনর্থন যোগ্য হলেও পঞ্চাশ বছর আগের সেই চিত্র মোটেই সুখকর ছিল না বলে বিজ্ঞ জনেরা কানাঘুষা করেন। বিশ্বমঞ্চে আমাদের ঐ সূচনা পর্বের নির্ঘন্টগুলি সত্যিই কি আলো জ্বেলেছিল! তাছাড়া চল্লিশ বছর পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর তারই কন্যা ক্ষমতার চেয়ারকে স্থায়ী করা, দুনিয়াব্যাপী ফেরি করিয়ে ডজন খানেক ডক্টরেট ডিগ্রি নিজের নামের পাশে বসানো কিংবা একদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন কল্পে বিরোধী রাজনীতির বিলোপ সাধন করে বিনা ভোটের আয়োজনে বছরের পর বছর ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখাসহ দুর্নীতি ও অপশাসনের মাধ্যমে দেশকে অচল করে দেয়ার মিশনে হেন অপকর্ম নেই যা তিনি করেন নি। তাই বলি স্তাবকরা ঢোল করতাল লয়ে যতই দাপাদাপি বা রঙ তামাশার হোলি খেলায় মত্ত হোক না কেন, একজন অর্বাচীন স্বৈর শাসককে মাদার অব হিউম্যানিটি বা বিশ্ব জননী খেতাবে ভূষিত করে যতই তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হোক না কেন কিংবা তার ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়া একমাত্র পুত্রকে সরকারের আইসিটি উপদেষ্টা বানিয়ে তাকে লক্ষ লক্ষ ডলারের মাসিক সম্মানী দেয়া হোক না কেন; সেসবের বিচ্ছুরন বাংলাদেশ নামক ছোট্ট ভূখন্ডের বাইরে অর্থাৎ বিশ্বমঞ্চে কখনোই আলো ফেলতে পারে নি। বরঞ্চ গণতন্ত্র ধ্বংসসহ দুর্নীতি, দমন পীড়ন ও হত্যা গুম খুনের যে মহোৎসব চালিয়ে তিনি বাঙালীকে দেড় দশক বোবা বানিয়ে রেখেছিলেন সেসবের অভিযোগে তিনি এখন বিশ্বব্যাপী নিন্দিত এক স্বৈরশাসক হিসাবেই নথিভুক্ত হবেন।
আমার এই মতামত দেয়াটা কাউরি প্রতি হিংসা বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়ানো নয়। সদ্য স্বাধীন দেশের সাড়ে সাত কোটি হতে বৃদ্ধি পেয়ে এখনকার সতের কোটি মানুষের ভাগ্যলিপির যে অসহায় আত্ম-সমর্পন গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ঘুর্ণায়মান লাটিমের মত ঘটে চলেছে তার হিসেব কি আমরা নিয়েছি! শুধু জনসংখ্যায় স্ফীত হয়েছি। জনতার আশা আকাঙ্ক্ষা, জীবনমান ও অন্যান্য সামাজিক, স্বাস্থ্য, অর্থ, শিক্ষা ইত্যাদির সূচকে কি সাধারন জনগনের কোন উন্নতি হয়েছে? কোন্ রাজনীতি, কোন্ গণতন্ত্র ও দেশাচারে আমরা দেশের বুনিয়াদ বিনির্মানে আত্মনিয়োগ করেছি তার ফালনামা খুলে দেখেছি কি কখনো? গত পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়কাল ধরে ব্যক্তি পুজা,ব্যক্তি বন্দনা বা বংশ পরম্পরার শ্রীবৃদ্ধি করনে যেভাবে গলগঘর্ম হয়ে আমরা প্রাণপাত করে চলেছি তাতে কি আমাদের বাংলাদেশ বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও বোধের কোন শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে!
দেশের নদী খাল বিলে গুইসাপ জাতীয় এক ধরনের সরীসৃপের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। রাঢ় এলাকায় এদের সোনাগুধা বলে ডাকা হয়। এই গুইসাপের কামড়ের তেজ বা জোশ খুব বেশী। ঘাটে বা জলাভূমিতে এরা ওৎ পেতে থাকে। বাচ্চা ছেলেপুলে বা ছাগল ভেড়া পেলে এরা ঠিক কুমিরের স্টাইলে তাদেরকে আক্রমন করে। তাদের এই কামড় বা আক্রমনের ধার বুঝানোর জন্য একটা প্রচলিত কাহাবত আছে। ‘’মেঘ না ডাকলে সোনাগুধা তার কামড় ছাড়ে না।’’ এটাকে ধরেই আমি আমার এই লেখনির ইতি টেনে বলতে চাই, বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে মেঘ ডেকেছে। সম্পুর্ণ অরাজনৈতিক আচরনের এক বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সাধারন আমজনতার সমর্থন পুষ্টতায় গণ অভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে দেশ থেকে স্বৈরাচার বিতাড়ন করেছে। আসুন আমরা সোনাগুধাদের (গুইসাপ) নির্মূল করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অটুট রেখে গণমানুষের আশা আকাঙ্খায় সংঘটিত নব্বই ও চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের চাহিদায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথে এগিয়ে যাই।