জালাল উদ্দিন আহমেদ
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:৫৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
আজ সকালটা একটু আগেই শুরু হোল। অবসরের এই সময়ের দিনগুলি একটু দেরিতেই শুরু হয়। তবে স্বপ্ন বলে কথা। কেন যেন এসব স্বপ্ন আজকাল প্রায়শই দেখি। তাও আবার ভোরের স্বপ্ন। অবশ্য স্বপ্নেরই বা দোষ কি! সারাদিন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার খবরে চোখ পড়ে থাকে। ওদিকে সংবাদপত্রের প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে চোখটারও দফারফা। আর সদ্য গজিয়ে উঠা ফেবু আর ইউ টিউবের কল্যানে দিনমান চব্বিশটি ঘন্টাই যেন এক মহা ব্যস্ততার আয়োজন। আজকাল আড্ডা মারার বন্ধু বান্ধবদের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে বলে মনে হবার কারনও নেই। তবুও পুরনো অভ্যেসের দাস বলে হয়তো একবেলা অর্থাৎ সন্ধ্যার মাগরিবের নামাজ অন্তে একটু ক্লাবে ঢু মারার সেই পুরনো বাতিকটা এখনো আছে। সব মিলিয়ে জীবনের এই সায়ংকালে এবাদত বন্দেগীর দীনি সময় বাদে রোজনামচার বাকীটা - দুনিয়াদারির আবেশেই কেটে যায়। তাছাড়া বর্তমান সময়কালে রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতির সঙ্গে ধর্মনীতির অতি সম্পৃক্ততায় কেন যেন এক তালগোল পাকানো জীবনমানে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ধর্মের বিষয়টি এখনকার সময়ে রাষ্ট্রনীতির একটা প্রধান অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ সমুহে এর প্রকটতা বেশ স্পষ্ট। সেকথা পরে আসি। আগে আজকের স্বপ্নটা নিয়েই একটু এগোয়। ধর্ম বিষয়ক স্বপ্নটা না হয় পরের এপিসোডে আলাপের জন্য তুলে রাখি।
স্বপ্ন তো আর দেখতে মানা নেই। কিন্তু এমন সব উদ্ভট স্বপ্ন দেখে ফেলি যা অনেক সময় বর্ণনাতীত হয়ে যায়। তবে আমার মত এই নিরামিষ ব্যক্তি যদি প্রফেসর ইউনুস সাহেবের উপদেষ্টা মন্ডলীর একজন হয়ে বঙ্গভবনে চুপ্পু মিয়ার কাছে শপথ নিই তখন সেই স্বপ্নকে কি বলে আখ্যা দেয়া যায়। আমি বলছিনা যে ওই স্বপ্নটাই আমি দেখেছি। তবে কাছাকাছি এরকমই একটা হবে হয়তো। এটা কিন্তু স্বপ্নই। আমি প্রৌঢ় না বৃদ্ধ তা নিজেই ঠাউর করতে পারিনা। কারন চলি তো সেই চল্লিশ পঞ্চাশ বয়সীদের মন মানসিকতায়। করোনার পর চুলে রঙ লাগানো ছেড়ে দিয়েছি। ফলে অবয়বে সাদা সফেদ দাদা ভাই নানাভাইয়েই শ্রেষ্ঠ সময় কাটছে এখন আমার। কিন্তু কেন সেই তিরিশ চল্লিশ বছর আগেকার স্মৃতি আমাকে টেনে নিয়ে স্বপ্নের মধ্যে ঢুকালো সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন! তখন আমি লেদার কলেজে শিক্ষক পেশায় কর্মরত। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড: করম আলি আহমেদ সেসময় লেদার কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। কলেজ অব লেদার টেকনোলজি তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ডের অধীনে একটি ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসাবে অধিষ্ঠিত।
সেদিন সপ্তাহের প্রথম দিন। হঠাৎ খবর এল ডিসিএমএলএ অর্থাৎ ডেপুটি চীপ মার্শাল ল এডমিন্সটেটর মাননীয় এয়ার ভাইস মার্শাল সাহেব লেদার কলেজ পরিদর্শনে আসছেন। খবরটা এসেছিল উনি হাজারীবাগ কলেজ প্রাঙ্গনে পৌঁছানোর পনের বিশ মিনিট আগে। ফলে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিসিয়াল কোন ব্যস্ততা আমাদের চোখে পড়েনি। এয়ার চীফ সুলতান মাহমুদ সাহেব তখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৬ সালের ঘটনা এটি। হঠাৎ শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্ণধার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আঙ্গিনায় কেন আসছেন, এ প্রশ্ন আমাদের জেগেছিল। তবে সিএমএলএ বা ডিসিএমএলএ বলে কথা। তারাই সে সময় দেশের মূল হর্তাকর্তা। তারা যেখানে সেখানে ভিজিট করতে পারেন। হলোও তাই। তিনি সোজা সামরিক জীপ নিয়ে উইদাউট প্রটোকলে হাজারীবাগের লেদার কলেজে চলে এসেছেন। সোজা প্রিসিপ্যালের রূমে তিনি। সে সময় অধ্যক্ষের কক্ষে এডিবি সহয়তা পুষ্ট একটি প্রকল্পের একটি টেকনিক্যাল ইভালুশন মিটিং চলছিল। আমি ও আমার সহকর্মী রঞ্জিত সরকার, কলেজের টেক্নিক্যাল এডভাইজার মাইকেল উডলী, ট্রেনিং এক্সপার্ট ড.এম এস ওলিভান্নান এবং এডিবির ঢাকা অফিসের দুজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন সে মিটিংয়ে। কলেজের বাজেট ও আকাউন্টস অফিসার আব্দুর রশিদ সাহেবও ছিলেন বলে মনে পড়ে। আমরা তো থতমত অবস্থায় পড়ে গেলাম। খবরটা এসেছিল উনি হাজারীবাগ কলেজ প্রাঙ্গনে পৌঁছানোর পনের বিশ মিনিট আগে। পরে জেনেছিলাম হাজারীবাগ শিল্প এলাকার কোন এক মহারথীর আধুনিক টেনারী পরিদর্শনের ফাঁকে লেদার কলেজের টেনারী ওয়ার্কশপ দেখার জন্যই তার এখানে আসা। এবং এটা তার ব্যক্তিগত অভিলাষ। এজন্যই হয়তো প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিসিয়াল কোন ব্যস্ততা আমাদের চোখে পড়েনি। ডিসিএমএলএ সাহেব শুধু বললেন লেদার কলেজের প্র্যাক্টিক্যাল ওয়ার্কশপটা দেখার জন্য তিনি এসেছেন। পড়বি পড়, মালির ঘাড়েই পড়লো। প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে দেখিয়ে বললেন ওকে সঙ্গে নিলেই আপনার পারপাশ সার্ভ হবে। আমি সে সময় ছাত্রদের প্র্যাক্টিকাল করাতাম এবং প্রডাক্ট আইডেন্টিফিকেশন এর উপর ক্লাস নিতাম। যেহেতু সরকারী পারচেজ ডিপার্টমেন্ট এর চাকুরী থেকে কলেজে এসেছি, ফলে চামড়া ও চামড়াজাত পন্যের র মেটিরিয়াল এবং তার কোয়ালিটি আইডেন্টিফিকেশন ইত্যাদির ব্যবহারিক ধারনা থাকায় স্যার আমাকে দিয়ে ওই প্রফাইলের কাজগুলি করাতেন।
যাহোক ডিসিএমএলএ স্যারকে নিয়ে কলেজের মূল ভবনের পিছনে ফ্যাক্টরী আদলে স্থাপিত বিশাল টেনারী ওয়ার্কশপের দিকে রওয়ানা দিলাম। ওয়ার্কশপে শ্রমিক জাতীয় বিশ পঁচিশজন আছেন। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তাদের সৌজন্যতা রক্ষা করতে বললাম। সঙ্গে নিলাম শুধু নুরুকে। সে হচ্ছে এই ওয়ার্কশপের সব্যসাচী কর্মচারী। সব কাজেই সে ওস্তাদ। এবং ওয়ার্কশপের এ টু জেড তার নখ দর্পনে। টেষ্টিং রুম, স্যাম্পল রুম থেকে ওয়ার্কশপের প্রতিটি খুঁটিনাটি স্যারকে সবকিছুই দেখালাম। বন বিভাগ থেকে আসা একটি কুমির ও চারটি স্পটেড হরিনের চামড়া অন প্রসেসে ছিল। সেসবের খবরও জানলেন। ওয়ার্কশপের শেষ প্রান্তে কেমিক্যাল গোডাউন। ভিতরের গোডাউনে বড় বড় কাঁচের জারে রাখা বিভিন্ন পদের এসিড, ড্রাম ভর্তি ডাইক্রোমেট, বাইক্রোমেট, সোডা, সালফাইড ও অন্যান্য জেনেরিক নামের টেনারী শিল্পের কাঁচামাল অর্থাৎ কেমিক্যাল সমূহ এবং তাদের প্রায়োগিক ব্যবহারের ব্যাখ্যা করলাম। যে কেমিক্যালের স্টেক স্যারকে দেখালাম, সেগুলি সবই ছিল বৃটিশ কলম্বো প্লানের শিল্প শিক্ষা অনুদানের জন্য বরাদ্দ শিল্পের কাঁচামাল। ছোটখাট সাইজের মানুষ ডিসিএমএলএ স্যার বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আধা ঘন্টার মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে চামড়া উৎপাদনের প্রডাকশন সাইকেল ডেমোনেস্ট্রেট করলাম। যাওয়ার সময় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের চেম্বারে উকি দিয়ে শুধু বললেন ব্রিলিয়ান্ট।
তেত্রিশ বছরের কর্মময় জীবনের প্রথম দিকের এই ঘটনাটি কেন যে স্বপ্নের মধ্যে এত বছর পর আমাকে নাড়া দিল তা আমার বোধে আসছে। তবে ঐ যে শুরু করেছি দেশের টালমাটাল এবং স্বৈর শাসনের এলেবেলে চালচলনের কথা। মাসসিক অস্থিরতার কথা। মনে হচ্ছে ওসবের ভুতে ভর করেই আমার আজকের এই স্বপ্ন চারিতা। জানিনা এই স্বপ্নের ভার ও ভরের তফাৎ কতটুকু। তবে ‘স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃত সমান গৌড়ানন্দ কবি ভনে শোন পুন্যবানে’র সেই হবু চন্দ্রের হিং টিং ছটই হবে হয়তো এটা। এখানে ভর আছে তবে ভার নেই।
-চলমান-