জালাল উদ্দিন আহমেদ
প্রতিবাদের ক্ষয়িষ্ণুতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:৩৫ পিএম, ১০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মফস্বল শহরে অবস্থান এখন আমার। অবশ্য এটাকে মফস্বল বলাটা অযৌক্তিক হবে। কারন দেশীয় বিবেচনায় এটি একটি মহানগর। বিভাগীয় হেড কোয়ার্টারও বটে। আর বিজ্ঞ বিবেচনায় এটি তো এখন দেশের সুন্দর স্বচ্ছ ও পরিবেশ বান্ধব এক নম্বর মহানগর। নিশ্চয় এতক্ষনে পরিচয়টা পেয়ে গেছেন যে আমি এখন কোথায় আছি। তবে যেখানেই থাকি না কেন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এত মানসিক চাপ ও অস্থিরতা নিয়ে দিনগুলি পার করছি যা আগে কখনোই এমনটি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এখন তলানীতে ঠেকেছে। প্রতিবাদ করার ভাষা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। নইলে দেশের রাজনীতি ও শাসন নীতি যখন একব্যক্তি ও দলের চাহিদায় সাঁতার কাটে তখন দেশের সিংহভাগ মানুষের চেয়ে চেয়ে দেখা আর হাপিতেশ করা ছাড়া কিইবা থাকে। সামাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুর্দমনীয় আচরনের দাদাগিরির মেকানিজমে জনপদের অসহায়ত্বের বিষয় সমূহের ছিটেফোঁটা উল্লেখ করে দেখতে চাই কি অসহনীয় জ্বালা যন্ত্রনা নিয়ে আমাদের দিনগুলি পার করতে হয়েছে।
অবশ্য ব্যক্তি ক্যারিশ্মা ও দলীয় দাদাগিরির শেকড় তখনই মাটির ছায়া সুশীতল কোমল স্পর্শের আস্বাদনে তার অভয়ারন্যের জমিন খুঁজে পায় যখন সেনা ট্যাগ লাগানো এক এগারোর কেয়ার টেকার নামের দুর্মর শাসনের লম্বা হাত দেশের প্রতিটি খাতে তাদের দাদাগিরির আস্ফালনে নাস্তানাবুদ হয়। এরপর তো ইতিহাস। গণতন্ত্র ও রাজনীতি নামক কলংকিত অধ্যায়ের একদলীয় শাসনের নাটক মঞ্চস্থের পুন: আয়োজনে এবং ব্যক্তি ক্যারিশমার যথেচ্ছচার ক্ষমতা প্রয়োগে দেশ থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও রাজনীতির ভাসান হয়ে গেল। একসময় মনে হয়েছে দেশে রাজনীতি নামের যে ছিটেফোঁটা আওয়াজগুলি শোনা গেছে তা স্রেফ ক্ষমতাসীন এক নায়কের অনুকম্পার নাটক সেগুলো। যা দেখিয়ে বিশ্বকে বোঝানো যে এদেশে রাজনীতি ও গণতন্ত্র পাশাপাশি সহবস্থানে রয়েছে। একটি নয় দুটি নয়,পর পর তিন তিনটি নির্বাচন নিজস্ব মেকানিজমে করে ফেলে ততদিনে স্বৈরাচারী বনে যাওয়া শীর্ষবিন্দু ক্ষমতার ঘোর লাগা ধন্ধে তার মৃত্যুর পরেও এ দেশটি কোন্ ডেস্টিনেশনে রইবে তার দিশাও ঠিক করে দেন। নইলে ৭৬ বছরের বৃদ্ধ এক অবৈধ সরকার প্রধান কোন্ স্পর্ধায় তার লুটপাটের সাম্রাজ্য ২০৪১ সালের রূপকল্পের ভাবনায় অনাহারে অর্ধাহারে থাকা বাঙালীকে নিয়ে এগোতে চায় তা না বুঝার কোন কারন থাকতে পারেনা।
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভাগ জেলা উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন লেভেলের প্রতিটি স্থানীয় সরকারের শাসন ব্যবস্থায় একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করেছে পতিত স্বৈরাচারী রজনীতির ধরক দল। এক্ষেত্রে পরিচালনা কথাটি লঘু বলেই সেটাকে শাসন ও শোষন বলাটাই শ্রেয়। দেশে একদলীয় রাজনীতির রমরমা আচরনে বিপক্ষীয় মতামতের কোন সুযোগ ছিলনা বরং ভিন্ন মতাবলম্বীদের জন্য জেল জুলুম গুম খুনের নিয়তি অবধারিতভাবেই নির্ধারিত ছিল। এর ফলে রাজনীতি ও শাসন নীতির একচেটিয়া অভয়ারন্যে রাজনীতি করতে আসা ভাই চাচারা দাদাগিরির আচরনে সমাজে নিজেদের উচ্চতা তৈরীতে উন্মত্ত হয়েছে। পাশাপাশি দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় মেকানিজম বিশেষ করে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় নিয়োজিত প্রশাসন, বেসামরিক আইন শৃংখলা বাহিনী এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রের সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ স্বৈরাচারী শাসকের পাইক পেয়াদার আচরনে বাংলার সাধারন জনপদে মূর্তমান আতংক হয়ে বিচরন করেছেন। দেশে ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কলমের স্বাধীনতা, মিডিয়া স্বাধীনতা ইত্যাদি কোনটাই সাবলীল ছিল না। বিগত পনেরটি বছর ব্যক্তি ক্যারিশমার বংশ পরম্পরায় উত্তর পুরুষের সুবিধাভোগে এদেশে সৃষ্টি হয়েছে একচেটিয়া রক্তচোষা স্বৈর শাসনের ভিত্তি।
রক্তচোষা শাসক বা শাসন ব্যবস্থা কথাটি শুনতে বেশ শ্রুতিকটু শোনালেও দেশের সৃষ্টি ও দেশ গড়ার হাতিয়ার হিসাবে যাদেরকে নিয়ে আম বাঙালী স্বপ্ন দেখতে ভালবেসেছে, সেই তারই যখন স্বৈশাসকের ভূমিকায় বাংলাদেশ ও বাঙালীকে ফোঁকলা করে দেয় তখন কোন্ দু:খে বাঙালী তাদের নমস্যের স্থানে তুলে রাখবে বলা যাবে কি?
(১)উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষকের সাথে হাঁটার পথে পরিচয়। ভদ্রলোক বেশ সাদাসিধে এবং চলনে বলনে মনে হোল বেশ পরিশ্রমী ও বাস্তব বাদী একজন মানুষ। কথা কম বলেন, তবে যেটুকু বলেন তার সারমর্ম অনেক বিস্তৃত। গন্তব্যের ভিন্নতা থাকায় বিদায় লগ্নে শুধু নিজের অসহায়ত্বের কথাটুকু জানালেন। তার উচ্চমাধ্যমিক ও অনার্স পড়ুয়া দুটি মেয়ে ও তাদের নিরাপত্তা নিয়েই তাকে তটস্থ থাকতে হয়। হুমকি, কিডন্যাপিং এবং মুক্তিপনের সন্ত্রাসে তিনি আজ দিশেহারা। বললাম, দাদা থানায় যাচ্ছেন না কেন? বললেন কি যে বলেন, অসৎ ও অবৈধ পথ-ঘাটের পরিধি বাড়ানোর জন্য আমি নিজের পায়ে কুড়াল মারবো! অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তার গন্তব্যের পথে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিইবা করার ছিল আমার। (২) সরকারী টেকনিক্যাল কলেজের একজন প্রফেসর। একাডেমিক ইনচার্জের দায়িত্বেও আছেন। সুতরাং পরীক্ষা সংক্রান্ত জটিল সমীকরনের টেবিলে তিনিই রাজা। কিন্তু কিসের কি? কলেজ ছাত্র রাজনীতির সরকারী গিরগিটির ছোবলে তার তথৈবচ অবস্থা। শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে চলাফেরাই দায় হয়েছে তার। পরীক্ষার দিনক্ষন, প্রশ্নপত্রের বিষয়ে ছাড় দেয়া, উত্তরপত্রে কিছু না পাওয়া গেলেও ফেল করানো যাবে না। এহেন হাজারো অনৈতিক কদাচারে সায় দিয়ে সেই শিক্ষকের একাডেমিক ইনচার্জের পদে সম্মানিত থাকতে হয়। (৩) তিনি একজন সরকারী আমলা। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের কর্মজীবনে না হলেও তের বার বদলী হয়েছেন। বছর তিনেকের মত চাকরী জীবন অবশিষ্ঠ আছে। একজন উচ্চ শিক্ষিত, সৎ এবং প্রতিভাবান ও কর্মঠ আমলা হয়েও তিনি সাকুল্যে চারবার পদোন্নতি পেয়ে এখন যুগ্ম পর্যায়ে তার সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ তার ব্যাচের পিছনের ক্রমপুঞ্জির চেটে উঠার দল আজকের দিনে সর্বোচ্চ সাচিবিক পদ নিয়ে সরকারী অন্দর মহল আলোকিত করে রেখেছেন। শপথবদ্ধ কর্মীজীবনে বিভাজনের দেয়াল তুলে যে তুষের আগুন জ্বালিয়ে আজকের বাংলায় প্রশাসনে বিশৃংখলা ও হতোদ্যমের সূচনা করা হয়েছে তা কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। (৪) যারা রাজনীতি করেন সেখানেও খেটে ওটা আর চেটে ওঠাদের বিভাজন স্পষ্ট। এক্ষেত্রে চেটে ওটারা রাজনীতির শীর্ষবিন্দুর নেক নজরে থেকে সর্বক্ষেত্রেই সরকারী ফ্রন্টলাইনে চলে আসেন। ফলে মেধা শ্রম ও ত্যাগ তিতিক্ষায় রাজনীতি করা ও দলের জন্য সর্বোচ্চ দিলেও তারা পরাজিত সৈনিকের ভূমিকায় ব্যাকবেঞ্চার হয়ে পড়েন।
কোনটা থুয়ে কোনটা বলি। ভ্যানে করে সবজি বেচা ফেরিওয়ালা, মাছওয়ালা, মুরগীওয়ালা,বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া, আর ফুটপাতে পসরা সাজানো দোকানদারেরা - কোথায় যাবেন! বিনা বাক্যব্যয়ে চলছে সিংহভাগ মানুষের রুটি রজির অমানবিক জীবন সংগ্রামের রোজনামচা। প্রতিবাদের অসহায়ত্ব সেখানেও মাথা কুটে মরছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কোন এক বিকেলে রাজশাহীর নতুন করে গড়ে উঠা বনগ্রাম এলাকার মসজিদ মোড়ে গিয়েছিলাম। কি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। মোড়েই দাঁড়িয়ে একজনের অপেক্ষায় ছিলাম মিনিট পনের। লক্ষ্য করলাম চৌরাস্তার মোড় রাস্তা ঘেঁসে একটি নতুন করে বানানো চকচকে টং ঘরের দোকান। চা-পান-চিপস-চকলেটের দোকান ওটি। একটি বিশ বাইশ বছরের তরুন দোকানটি চালাচ্ছে। ভাব জমিয়ে জিগ্যেস করলাম কত করে দিতে হয়। প্রথমে হতচকিত হলেও, আমার বয়স ও অবয়ব দেখে সে সংকোচের সঙ্গে বললো স্যার ডেইলি পঞ্চাশ। এক পার্টি না সব মিলিয়ে? না স্যার শুধু ভাইয়া। আমি আর এগোয়নি। এরকম বছর তিনেক আগে ঢাকা ধানমন্ডিস্থ সাত মসজিদ রোডের ফুটপাতে ডাবের স্টেক লাগানো এক ফড়িয়ার সঙ্গে ভাব জমিয়ে জিগ্যেস করে যা পেয়েছিলাম তা বেশ চমকপ্রদ। স্থানীয় ছাত্রলীগের বড়ভাইকে দিতে হয় পঞ্চাশ, ভ্রাম্যমান পুলিশ পঞ্চাশ, থানার পুলিশ পঞ্চাশ এবং টুকটাক উঠতি মস্তানদের সপ্তাহে দুই’শ টাকা করে তাকে গুনতে হয় বিনা বাক্যব্যয়ে। তাহলে ফুটপাতের হকার্স মার্কেটগুলোর হালচাল নিশ্চয় না বুঝার বিষয় নয়। শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক ফুটপাত ও অন্যান্য সবজি আনাজের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কি সব তেলসমাতি কায়-কারবার চলছে তার হিসাব কে রাখে! আজকে নিউজে দেখলাম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন হতে সরকারে আগত উপদেষ্টা মহোদয়ের তৎপরতায় ঢাকা স্টেডিয়ামের মার্কেটে ভাড়া সংক্রান্ত শুভংকরের ফাঁকির সব ভুতুড়ে কান্ড কারখানা। সরকারের কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে শুধু এই একটি স্টেডিয়াম মার্কেটকে ঘিরে।
আসলে বর্তমান দিনগুলিতে আমাদের নৈতিক অবক্ষয় এমন এক পর্যায়ে গিয়ে ঠেঁকেছে যে জীবনবোধের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আর এসবের একমাত্র এবং শুধুমাত্র যে অনুসঙ্গকে দায়ী করতে হয় তা হোল রাজনীতি এবং তার অনৈতিক অমানবিক ও কাদাচারী আচরন। অরাজনৈতিক তরুন-যুবাদের নৈতিক স্ফুরনে সায় দিয়ে দেশের সাধারন জনগন তাদের সঙ্গী হয়ে মাঠে নেমেছেন। হাজার খানেক তরুন যুবা ও জনগনের তাজা রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচারী শাসককে উৎখাত করেছি। দেশের জনগন বুকভরে নি:শ্বাস নিয়ে এটাকে তাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যা দিয়েছে। স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার সুউচ্চ মানদন্ডে জাতির ভবিষ্যত এই তরুন যুবাদের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাক - কায়মনোবাক্যে এই প্রত্যাশাই রইলো।