জালাল উদ্দিন আহমেদ
মনুষ্য আচরি ধর্ম
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:২৯ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
হেডলাইনটা একটু বৃহত্তর আঙ্গিকে চিন্তা করেই দেয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এটা আপনি আচরি ধর্মেই থাকার কথা। কিন্তু মনুষত্ব ও মানবতাকে এক নিক্তিতে ফেলে একটু ভিন্নধর্মী আলোচনায় এই হেডলাইন নিয়েই কলম ধরলাম। আশা করি গল্পের ছলে এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমরা আমাদের চলার পথকে সুগম করবো।
ভারত শাসিত পশ্চিম বঙ্গের একটি গ্রাম। গ্রামের নাম হরিরামপুর। দুটি পাড়া সমন্বয়ে গ্রামটি গঠিত। পুর্ব পাড়ায় মুসলমান সম্প্রদায়ের আধিক্য আর পশ্চিম পাড়ার জনসংখ্যা হিন্দু সম্প্রদায়ে ঠাসা। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি সামান্য অজুহাতে গ্রামের পুর্ব পাড়া ও পশ্চিম পাড়ার ঠুকাঠুকি লেগেই আছে। ঠিক যেন সাপে নেউলের সম্পর্ক। ঘর গেরস্তি ও শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চিম পাড়ার মুখার্জী অধিকারীরা বরাবরই এগিয়ে। তবে পুবের শেখ সৈয়দদের দু,চারজন ধনী গেরস্থ থাকলেও বাকীরা সবাই নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পর্যায়ের। গ্রামে প্রাথমিক ও কো-এডুকেশনের মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকাতে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজনের লেখাপড়ার প্রতি বেশ আগ্রহ দেখা যায়। ফলে তাদের ছেলে মেয়েরা নিদেন পক্ষে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়া লেখার একটা স্বপ্ন পুষে রাখে। পশ্চিম পাড়ার সবচেয়ে ধনাঢ্য সুরেশ অধিকারীর সুন্দরী মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল। ওদিকে পুব পাড়ার নিম্ন মধ্যবিত্ত প্রাথমিক স্কুলের মাস্টার মশায় এনায়েত শেখের ছেলেটাও বেশ ব্রিলিয়ান্ট। ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ওরা দু'বছরের ছোট-বড়। তারা দুজনেই প্রাইমারী থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেই লেখাপড়া করেছে। মাধ্যমিক শেষ করে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের থানা শহরের কলেজে ছেলেটি ভর্তি হোল। এক বছর পরে মেয়েটিও সেই কলেজে ভর্তি হয়। একই বিভাগের ছাত্র হওয়াতে তাদের দুজনের দূরত্ব কমে। একসময় তারা বন্ধু হয়। এই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নেয়। ছেলেটি অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। মেয়েটিও বছর ঘুরতেই অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ইতোমধ্যে ছেলে মেয়েদের এই প্রেম প্রীতি প্রকাশ্য হয়। ফলে গ্রামে রীতিমত দাঙ্গা ও খুন খারাবি হয়। এক সময় অধিকারীর প্রভাবের জেরে এনায়েত মাস্টারের স্কুলের চাকরীটাও চলে যায়। কিন্তু মেধাবী ছেলের অদম্য প্রতিজ্ঞা তাকে শুধু সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ছেলেটি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে আইএএস হয়। ওদিকে বছর ঘুরতেই মেয়েটি মাস্টার্স শেষ করে তারই শহরে পড়া কলেজে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পায়। এইফাঁকে এই দুজন ছেলে মেয়ে নিজেদের ধর্মকে সম্মান দিয়ে সরকারী ম্যারিজ রেজিষ্টারে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে আবদ্ধ হন। যাহোক একজন মুসলমান আইএএস অফিসার যিনি তার নিজ জেলায় মহকুমা প্রকাশক হিসাবে সবে যোগ দিয়েছেন এবং অন্যজন সনাতনী হিন্দু তারই শহরের কলেজের প্রভাষক পদমর্যাদা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর বেশে গ্রামে এসে যখন বাবা মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম বা প্রণাম করেন, তখন গর্বিত পিতা মাতার অনুভূতি কেমন হতে পারে সেটা তারাই ভাল বলতে পারবেন। গ্রামের সাম্প্রদায়িক ঝুট ঝামেলা যে এভাবেই সম্প্রীতির বিনি সুতো গাঁথবে তা কি কেউ ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল! এনায়েত মাস্টারের চাকরীটাও ফেরত এল। আর হরিরামপুর গ্রামটিতে প্রকৃত অর্থে সম্প্রীতির জোয়ার এল।
জায়গাটি পূর্ব বাংলার একটি প্রত্যন্ত এলাকায়। তবে সেখানে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া বেশ পোক্ত ভাবেই শেকড় গেঁথেছে। পাশাপাশি কয়েকটি গ্রাম মিলে একটি ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের নাম রসুলপুর। এই ইউনিয়ন পরিষদের গ্রামগুলির সমষ্টি মিলে জনসংখ্যা প্রায় তিরিশ হাজারের মত। ধর্মীয় জাতিগত অবস্থানে হিন্দু মুসলিমের অনুপাত ৩০:৭০। অবস্থাগত দিক থেকে মেপে দেখলে মুসলমানরা এই অঞ্চলে অবস্থা সম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী অবস্থানে আছে। গ্রামগুলির নামগুলোও বেশ মিলেমিশে রাখা হয়েছে বলে মনে হয়। রসুলপুর, শ্রীকৃষ্ণপুর, মদনপুর, সৈয়দপুর, শিবপুর, পাঠানগঞ্জ, খড়মপুর, শেখেরটেক, শ্বশানগাছা ইত্যাদি। এলাকায় পাঁচটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই মোটামুটি হিন্দু মুসলমানের পাশাপাশি সহাবস্থান। তবে লেখাপড়ার ফলাফল ও আধিক্যে হিন্দুরাই একটু এগিয়ে।
শিবপুর একটি ছোট্ট গ্রাম। হাজার দেড়েক জনবসতির এক তৃতীয়াংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস সেই গ্রামে। তাতে কি! লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষায় হিন্দুরাই এখানে এগিয়ে। বছর তিনেক আগে এই গ্রাম থেকে সতিনাথ মন্ডলের ছেলে সুরেশ মন্ডল বিসিএস পাশ করে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। সতিনাথ আট মাইল দূরের থানা শহরে রহিম মন্ডলের মিষ্টির দোকানে হেড ময়রার চাকুরী করে। তার স্ত্রী রেনুকা মন্ডল পাশের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে চাকুরী করে। তাদের একটি মেয়েও আছে। নাম কনিকা মন্ডল। মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়া শেষ করে একটি ইন্ডিয়ান স্কলারশীপ পেয়ে যাদবপুর আই আই টিতে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংএ মাস্টার্স ফাইন্যাল ইয়ারে আছে। এদিকে ওই অঞ্চলের রসুলপুর গ্রামের গেরস্থ কৃষক (যিনি রসুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য) কেরামত মাওলার মেয়ে মিন্নাতুননেসা শিবপুর গ্রামের সতিনাথ মন্ডলের মেয়ে কনিকার সহপাঠী হওয়ায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়। তারা বেশ ভাল বন্ধুও বটে। এরই সূত্র ধরে মিন্নাতুন মাঝে মধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় কনিকাদের বাড়ি হয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাত। ফলে সুরেশের সঙ্গে মিন্নাতুনের যোগাযোগের একটা সূত্র অজান্তেই সৃষ্টি হয়েছিল। আবার মিন্নাতুনরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন সুরেশ মাস্টার্স শেষ করে জীবন সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সূত্রে ছোট বোনকে হলে দেখতে আসার সুবাদে মিন্নাতুনের সঙ্গেও তার আলাপ চারিতা চলতো। এভাবেই সুরেশের সঙ্গে মিন্নাতুনের একটা ভাললাগা সৃষ্টি হয়। সেই ভাল লাগা একসময় ভাল বাসায় রূপ নেয়। ওদিকে কনিকা কলকাতা যাওয়ার সময় মিন্নাতুনকে তার দাদার খেয়াল রাখা এমনকি দাদা পরেশকে তার বাল্য বান্ধবী মিন্নাতুনের খোঁজ খবর রাখার জন্য বলে যায়। অবশ্য তার বান্ধবী ও দাদা ইতিমধ্যে যে মন দেয়া নেয়ার পাটাতনে ভাসমান, সেখবর কনিকার ধারনায় ছিল না।
ছাত্রী হিসাবে মিন্নাতুন খুব খারাপ ছিল না। ফলে মাস্টার্সে ভাল রেজাল্ট করেও যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারলো না তখন সে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলো। ওদিকে অনার্স পড়ার মাঝামাঝি সময় থেকেই মিন্নাতুনের পরিবার থেকে তার বিয়ের ব্যাপারে চাপ দেয়া শুরু হয়। কিন্তু মিন্নাতুন ততদিনে সুরেশের সঙ্গে মন দেয়া নেয়ায় শক্ত পাটাতন তৈরী করে ফেলেছে। ফলে বিভিন্ন অজুহাতে মিন্নাতুন তার পরিবারকে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে নিরুৎসাহিত করে। সতিনাথের ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে সতিনাথের কাছে বড় বড় অফার সম্বলিত তার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশ ‘বোন কনিকার ইন্ডিয়ার লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরুক’ - এই অজুহাতে বাবাকে ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু বিধি বাম। ওদিকে ছোটবোন কনিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারই বিভাগে সদ্য প্রভাষক হিসাবে যোগ দেয়া মান্নান সিদ্দিকীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করেছে। তাদের প্রেম এতই গাঢ় হয় যে তারা সরকারী ম্যারিজ রেজিস্টারে গিয়ে বিয়ে রেজেস্ট্রি করে নেয়। মান্নান সিদ্দিকীর বাড়ি দিল্লির নয়ডায়। তারা নিজ নিজ ধর্মমতে সংসার জীবনে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে খবরটি পৌঁছালে প্রভাষক ও ম্যাজিস্ট্রেট যুগলের মাথায় টনক নড়ে। কেরামত মাওলা গেরস্থ কৃষক। গ্রামের সকলের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয়। ওদিকে সতিনাথ ময়রা মানুষ, এসবের ধারে কাছে নেই। ছেলে মেয়েরা যেভাবে সুখে থাকতে চায় সেটাই তার সুখ। মাঝখানে মিন্নাতুনের পরিবার থেকে সুরেশকে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। ভাগ্য ভাল যে সুরেশরা উচ্চ ব্রাহ্মন্য সম্প্রদায়ের নয় বলে বিধি নিষেধের বেড়াজাল সৃষ্টি করে এখানে অত জল ঘোলা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। অবশেষ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তারই সতীর্থ এক ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে এফিডেভিট করিয়ে কলিমুল্লাহ খান নাম ধারন করে মুসলিম মতে মিন্নাতুন নেসার পাণি গ্রহন করেন।
গল্পটা এখানেই শেষ হলে হয়তো ভাল হোত। কিন্তু মনুষ্য আচরি ধর্মে কত কিছুই তো লেখা হয়। আর এসব চলমান ঘটনা চক্রে গল্প সৃষ্টি হয়, উপন্যাস তৈরী হয়। কনিকা-মান্নানের ঘরে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়। নাম রাখা হয় প্রীতম সিদ্দিকী। বছর ঘুরতেই বাংলাদেশের রসুলপুর গ্রামে নানীর বাড়িতে মিন্নাতুন-কলিমুল্লাহর ঘরে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম দেয়া হয় শ্রেয়া খান। গাও গেরামে একটা প্রবাদ আছে। দোয়াশলা অর্থাৎ শংকর। এটা অবশ্য পশু পাখির উপর প্রায়োগিক অর্থে বলা হয়। তবে প্রচলন হতে হতে এটা এখন মনুষ্য আঁতুড় ঘরেও স্থান করে নিয়েছে। দুই বর্ণ বা প্রজাতির মানুষের ঘরে যে সন্তান আসে তারা কিছুটা অতিরিক্ত মেধা সম্পন্ন হয়। হোলও তাই। খান এবং সিদ্দিকীর ঘরে আগত বাচ্চা দুটি প্রকৃত অর্থেই বেশ উচ্চ মেধা সম্পন্ন হিসাবেই প্রস্ফুটিত হোল। এক সময় তারা নিজ নিজ দেশে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে দু'বছর আগে পিছে অক্সফোর্ডে স্কলারশীপ নিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। ফ্যাকাল্টি আলাদা হলেও সপ্তাহান্তে তাদের দেখা সাক্ষাৎ আড্ডাবাজি ভালই চলে। এভাবে চলতে চলতে তাদের দুজন একে অপরের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠে। অবশেষে কোন এক গ্রীষ্মের ছুটিতে নানি ও দাদির বাড়িতে বেড়াতে এসে তারা পারিবারিক সম্মতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
মোর্যাল অফ দ্যা স্টোরি কি হবে জানি না। তবে মনুষ্য আচরি ধর্ম যে শাস্বত ও চির সত্য তা এই তিন জেনারেশনের জীবন চক্র অধ্যয়ন করলেই বেশ ভালভাবে উপলব্ধি করা যায়। বাঙালী চরিতনামার এই অবজেক্টগুলো স্টাডি করলে দেখা যায় নিজ ধর্মের প্রতি অনুগত থাকলেও বৃহত্তর বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং মানুষ ও মানবতার প্রতি উদারনৈতিক আচরনে সমৃদ্ধ হয়ে তারা তাদের চলার পথ তৈরী করেছে। মানব ধর্মের চাহিদাতেই তারা উচ্চকিত হয়েছে। ধর্মের বিভাজনে না থেকে তারা মানব ধর্মের উদারতায় পরিশুদ্ধ হয়ে মানবতাকে উচ্চকিত করেছে। এটাই শাশ্বত তবে অপরিহার্য নয়। ধর্মীয় বন্ধনীর শাসনে বেড়ে উঠা মানুষ যখন মনুষ্য পরিচয়ের স্বকীয়তায় নিজেকে পরিমার্জিত করে এগোতে চায় তখন মানব ধর্মের ঔদার্যবোধ তাকে আরো মহৎ করে তোলে। এভাবেই যুগ পরম্পরায় মানব ধর্মের আশা আকাঙ্খা সমাজ তথা রাষ্ট্রে সমাদৃত হয়েছে।