জালাল উদ্দিন আহমেদ
সম্প্রীতি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:২২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
কিসে হয়! কেন হয়! কার সাথে হয়! কখন হয়। কোন আঙ্গিকে হয়। এই কি কেন কোন্ কবে কখন ইত্যাদির উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের মহাভারত পড়তে হয় না। সাত মন ঘি ঢেলে রাধাকেও নাচাতে হয় না। মানব জাতির ইতিহাসে মানুষ মানুষকে চিনেছে জেনেছে বা তার সাথে সম্পর্কের আত্মীয়তায় পৌঁছেছে শুধুমাত্র তার আপন শেকড়ের বহমানতার শুদ্ধাচার এবং তার প্রায়োগিক আচরনে। বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের ব্যাপ্তি নিয়ে এত বড় আলোচনা করার ক্ষমতা না থাকলেও আপন অস্তিত্বের নিজ মাটিতে দাঁড়িয়ে অন্তত: দু'চার কলম লেখার সাহস রাখি। তবে এসব যতই ভাবি বা লিখি না কেন, ‘গোড়ায় গলদ’ নামক প্রবাদটি বার বার সামনে চলে আসে। বলছি ভারতীয় উপমহাদেশের মানব সম্পর্কের সম্প্রীতি ও সৌহার্দের কথা। বিশেষ করে ভারত বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সম্প্রীতি ও সৌহার্দের কথাগুলি নিয়ে একটু এগোতে চাই। তবে উপর দিকে মুখ করে থুতু ফেলতে গিয়ে আবার সেই থুতুই না গিলে খেতে হয়, এই ভয়ে কলমটা হঠৎ করে থেমে যায়। কারন ঘুরে ফিরে নাটের গুরু তো সেই বাঙালীই। সাধে কি আর গোখলে সাহেব বলেছিলেন, What Bengal thinks today India thinks tomorrow. কিংবা স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এমনি এমনি বাংলা তথা বাঙালীর জাতীয় খেলা হিসাবে হা-ডু-ডু কে নির্বাচন করেন নি। অর্থাৎ বাঙালী আগেও আছে পিছনেও আছে। ঠিক যেন পাটি গণিতের সেই বানরের তৈলাক্ত বাঁশে উঠা নামার গল্প।
যাহোক সম্প্রীতির এই আলোচনা তো আর নিজের হেঁসেলকে নিয়ে নয় যে নিজেকে নিয়ে এত প্রশংসা বা গীবত গেয়ে তা শুরু করতে হবে। তারপরেও মানব আচরনের কিছু ছিটেফোঁটা আলাপচারিতায় যদি পাঠক চাহিদার কিছুটা পুরন করতে পারি তাতে লাভের গুড় পিপড়ায় খেয়ে ফেললেও সেক্ষেত্রে মহাজনের(সমাজের) ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশী। ভারত বাংলাদেশ দুই নিকট প্রতিবেশী দেশ। গায়ে গা ঘেষা যাকে বলে। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ সীমান্তই ভারতের সঙ্গে। ১৯৭১ পুর্ববত্তী সময়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে অংগীভূত ছিল পুর্ব পাকিস্তান নাম নিয়ে। কিন্তু ধর্মের সম্প্রীতি সৃষ্টি করে যে মুসলিম জাতীয়তার পত্তন ঘটানো হয়েছিল, শেষ অব্দি সেই ধর্মীয় জাতীয়তা আদি জাতীয়তার কাছে হার মেনে বাঙালী মুসলিম গরিষ্ঠের পুর্ব পাকিস্তান তার আপন অস্মিতার বাঙালী জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশ নামে প্রস্ফুটিত হোল। সেক্ষেত্রে বাঙালী রাষ্ট্র সৃষ্টিতে প্রতিবেশী ভারতের সাহায্য সহযোগিতার খামতি ছিলনা বলেই হয়তো আমরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিজ ভূখন্ডকে শত্রুমুক্ত করতে পেরেছিলাম। ১৯৪৭ এ ধর্মীয় জাতীয়তার বিষ ঢেলে যে অখন্ড বাঙালী জাতি স্বত্ত্বাকে হিন্দু বাঙালী ও মুসলিম বাঙালী জাতীয়তায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কর্পুরের মত বিলীন হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যে মানবতা ও আন্তরিকতায় মুক্তিকামী পুবের বাঙালীকে পশ্চিমের ভারতীয় বাঙালীরা আপন করে নিজেদের মাটিতে ঠাঁই দিয়ে তাদের খাদ্য বস্ত্রের সংস্থানসহ তৎসময়ের ভারত সরকার যুদ্ধ সহয়তায় মুক্তিযুদ্ধের সফলতাকে ত্বরান্বিত করেছিল সেটা তো ইতিহাস। বাঙালী বন্ধু কৃতজ্ঞতায় তা চিরদিন মনে রাখবে। তাইতো বাঙালীর স্বতন্ত্র বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকে ভারত বাংলাদেশের সম্প্রীতির আচরন অন্য প্রতিবেশী দেশ সমূহের কাছে ঈর্ষনীয় ভাবে দেখা হয়। ভারত বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গত পঞ্চাশ বছর ধরে এতদাঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মাইল ফলক হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত।
কিন্তু প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে - এই সত্য উচ্চারনে যখন আমরা নিজেদের এই প্রেম প্রীতি বা সম্প্রীতির ফালনামা খুঁজতে যাই তখন সেখান থেকে কিছু কিছু ব্ল্যাকহোল এমনভাবে দাঁত কেলিয়ে ভেংচি কাটে যে তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আমাদের বেশ হিমশিম খেতে হয়। ভারত বৃহৎ দেশ। কিন্তু ক্ষুদ্র দেশ হলেও বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্বের নিক্তিতে দাঁড়িয়ে নিকটতম বন্ধু প্রতীম দেশ হিসাবে ভারতের কাছে আত্ম মর্যাদার নিক্তিতে পাশাপাশি দাঁড়াতে চায়। তাছাড়া জনসংখ্যার আধিক্যের মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ভারতের একটি বড় বাজার হিসাবেও স্বীকৃত। এমনকি বিশ্ব ভূরাজনৈতিক স্ট্রাটিজির দিক থেকে বাংলাদেশের একটি অবস্থানগত গুরুত্বও রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভারত রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সময়ের কট্টর মৌলবাদী সরকার ব্যবস্থা যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় অগ্রসর হতে চাচ্ছে তাতে করে আঞ্চলিক অখন্ডতায় সম্প্রীতির বাতাবরনে সৎ প্রতিবেশী হয়ে নিজেদের প্রমাণ করা দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিন্যাসের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের দাদাগিরি আচরণ আজ প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহকে বিষাক্ত করে রেখেছে। ফলে উপমহাদেশ বেষ্টিত প্রতিটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তাদের বন্ধুত্বের তঞ্চকতা হতে মুক্ত হয়ে নিজেদের স্বকীয়তা বিনির্মানে সচল হতে চাচ্ছে। ভারত বেষ্টিত রাষ্ট্র সমূহ যারা শতবর্ষ পূর্বে বৃহত্তর ভারতবর্ষের অংগ রাজ্য হয়ে ভারতীয় হিসাবে পরিচিত ছিল, আজ তারা ভারত রাষ্ট্রর সাম্প্রতিক সময়ের বিমাতাসুলভ দাদাগিরি আচরনে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বন্ধুত্ব ও সপ্রীতির মুখোশে যখন একটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাদের দাদাগিরির খবরদারি নিয়ে এগোতে চায় তখন প্রভূত্বের ছদ্মাবরনে সেই বন্ধুত্ব কখনোই সম্মানজনক পর্যায়ে থাকে না। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক মোড়ল হয়ে নিজেদের প্রমান করার মানসে যখন তাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মীয় দাদাগিরির ডংকা বাজিয়ে এগোতে চায় তখন সেখানে বন্ধুত্বের সম্প্রীতির রঙ ফিকে হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের সম্প্রীতির চিত্রপট এভাবেই বৈরিতায় রূপ নিয়ে আঞ্চলিক অখন্ডতায় ফাটল ধরিয়েছে।
আবারো সেই বাঙালী প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। কারন বাঙালী আজন্ম আত্মসচেতন জাতির খ্যাতি নিয়েই তার পথ চলায় উজ্জ্বল থেকেছে। কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্রের হিন্দি বলয়ের ঠান্ডা মাথার কুটকৌশলে বাঙালীকে দাবিয়ে রাখার যে স্নায়ুযুদ্ধ চলে আসছে তার রেশ একবিংশেও সমান গতিতে বহমান। ধর্মের পাল্লায় চড়িয়ে বাঙালীর বৃহৎ জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বায় খন্ডিত করে বাঙালীকে দুর্বল করার সেই বৃটিশ কুটকৌশল এখনও একই গতিতে প্রবাহমান। সম্প্রীতির উঠানকে তারা বানরের রুটি ভাগের দাঁড়ি পাল্লায় উঠিয়েছে। বৃহৎ প্রতিবেশীর তুলাদন্ডে বন্ধুর রূপ ধরে তারা আগা-মুড়া দুটোই খেতে বা পেতে চায়। অভিন্ন নদী শাসনে তারা যে বিমাতা সূলভ আচরন করে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছে এবং করেই যাচ্ছে তা সৎ প্রতিবেশীর কোন মাপকাঠিতে পড়ে! শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দিয়ে নদীর জল আঁটকে রেখে বাংলাদেশকে খরাপীড়িত দেশে পরিণত করা কিংবা বর্ষা মৌসুমে জমিয়ে রাখা অতিরিক্ত জল ছেড়ে দিয়ে বন্ধু প্রতীম প্রতিবেশীকে বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া, এটা কোন্ সম্প্রীতির নিক্তিতে পড়ে তা কি কেউ ভেবেছেন! বেনিয়া সংস্কৃতির ঢালাও প্রয়োগে নিকটতম বন্ধু রাষ্ট্রের শিল্প সংস্কৃতির সর্বনাশ করা ছাড়াও একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোয় এবং জননিরাপত্তায় নিজেদের দাদাগিরির চরমতম উপস্থিতির লক্ষ্যে হেন কুট কৌশল নেই যা তারা প্রয়োগে কুন্ঠিত হয়েছে। এছাড়া এসব বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে প্রশাসন ও আইন শৃংখলার উচ্চতর প্রশিক্ষনসহ রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্ত ক্ষেত্রেই তারা তাদের নিজস্ব পকেট তৈরীর থাবা সুপরিকল্পিত ভাবেই বসিয়েছে। আর এসবের বাস্তবায়নে সৎ প্রতিবেশীর ট্যাগ লাগিয়ে তারা বাংলাদেশের শাসক সম্প্রদায়কে ক্ষমতার চিরস্থায়িত্ব দেয়ার বন্দোবস্তে স্বৈরাচারী মাফিয়া বানাতেও পিছপা হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বিচারে হত্যা ও গুম খুনের প্রতিবাদে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গন অভ্যুত্থানে তাদের দোসর স্বৈরশাসক যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় তখন সেই ঘৃণিত স্বৈরশাসকে বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র আশ্রয় দেয়। বন্ধু প্রতিবেশীর কোন্ ক্রাইটেরিয়ায় এই সম্প্রীতিকে ফেলা যায় কেউ কি বলবেন!
বিগত দেড় দশকের অধিক সময়কাল ধরে তাদের পছন্দের একদলীয় শাসককুলের সম্প্রীতির এই নমুনায় জর্জরিত বাঙালী আজ জেগেছে। রাষ্ট্র তার নিজ স্বকীয়তায় হাঁটতে চায়। মিথ্যাচার ও শঠতা পুষে রেখে সম্প্রীতির ফুল ফুটানো যায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পৃথিবীর মোড়ল রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি রাষ্ট্রের মাধ্যমে তার কাঙ্খিত গোলে পৌঁছাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী ধর্মীয় মৌলবাদী ভারতকে দাদাগিরির টোপে ফেলে চীন ও রাশিয়াকে বশে আনার নতুন মাস্টারপ্ল্যানে এগোচ্ছে তারা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে জামাত প্রীতির বীজ বুনে তাদের চিরায়ত ফান্ডামেন্টালিস্ট সীলটা বাংলার বুকে এঁকে দিয়ে মালাক্কা প্রণালীতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিতেই তাদের এই দৌঁড়ঝাঁপ।