জালাল উদ্দিন আহমেদ
কোটা না কাঁটা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ আগস্ট,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:২২ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বড় ভেজ্যাল্লা জাতি আমরা। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে এইসব ভেজালের তেলেসমাতি উপাদান। অপরের ঘাড়ে বন্ধুক রেখে পুলসিরাত পার হওয়ার অন্তিম খায়েশ নিয়েই আমাদের দিনমান। আর শক্ত বাহুবলে সবকিছু ম্যানেজ করার শক্তি নিয়ে যদি আমি চলতে পারি তবে আর কি লাগে! আমার গীত তখন আর আমাকে গাইতে হয় না। চারিদিক থেকে বাদ্য গীতের জমকালো আয়োজনের ধুম পড়ে যায় তখন। দেশ জনপদ তখন ক্ষমতাসীনদের কাছে অপাংতেয় হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের তরুন প্রজন্ম তাদের ভবিষ্যত পথ চলার সরল রেখায় সপুর্ণ অরাজনৈতিক পন্থায় কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে যোক্তিক পন্থায় পথে নেমেছিল। স্বচ্ছ ও অহিংস পন্থায় তারা তাদের কর্মসূচি বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর কেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু রাজনীতির নাম নিয়ে যে দেশে নেতা কর্মীদের প্রতিটি নিশ্বাসে এক'শ একটি মিথ্যা, হিংসা, গালমন্দ ইত্যাদির চর্চায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে থাকে সেই দেশে অহিংস অরাজনৈতিক ইত্যাদির মতপ্রকাশ বা আর্জি আব্দারের কোন অস্তিত্ব থাকে কি?
রাজনীতি, দেশ শাসন ও ক্ষমতার বলয়টি যখন একমুখী স্রোত তৈরী করে চলার পথে স্বেচ্ছাচারপুষ্ট থাকে তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থার রাজপথ গলিপথ বা মেঠোপথে চলে একমুখী চলন বলনের ধুমধাম। বিরুদ্ধবাদী কথাবার্তা বা আবেদন দূরে থাক, সাদা মাটা অরাজনৈতিক সামাজিক চাহিদাও তখন ফ্যাসিস্ট শাসকের কাছে বিরুদ্ধ শক্তির ষড়যন্ত্র বলে মনে হয়। আর গণতান্ত্রিক নামের এই জবরদস্তির সরকার যখন ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং এর অবৈধ কারসাজিতে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্র শাসনের ওজিএল(ওপেন জেনারেল লাইসেন্স) নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলে তখন তার সৃষ্ট সরকারী মেকানিজমও বেপরোয়া উচ্ছৃংখল হয়ে রাজকীয় পাইক পেয়াদা স্টাইলেই তাদের গতি প্রকৃতি নির্ধারন করে ফেলে। শাসন ব্যবস্থার সেই আঙিনায় তখন সাধারন জনপদের চাহিদার কোন মূল্য থাকেনা। মাসলম্যান দাদাগিরি ও দূর্বৃত্য বেনিয়া হাটুরের দল হয়ে তখন দেশকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে তাকে খুবলে খামচে ছিন্নভিন্ন করার উন্মত্ততায় বেপরোয়া হয়। আর দেশের সাধারন আমজনতা খাঁচায় ভরা অসহায় গিনিপিগ হয়ে ছটপট করতে থাকে। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে। নিজেদের চাহিদার ন্যুনতম অংশটিও তখন তাদের কাছে অমৃত সন্ধানে সমুদ্র মন্থনের মত বিশাল কর্মযজ্ঞ বলে মনে হয়।
গত জুলাইয়ের বাইশ তেইশ তারিখের দিকে হাদি ভাইয়ের একটি কলাম প্রথম আলোতে ছাপানো হয়েছিল। হ্যাঁ, কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আব্দুল হাদির কথা বলছি। তিনি আমার থেকে না হলেও নয় দশ বছরের বড় হবেন হয়তো। এ শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় সালের কোন এক দুপুরে বন্ধু মাকিদ হায়দার আমার অফিস কক্ষে হাজির। ‘'চল একটু প্রেস ক্লাবের ওদিক থেকে ঘুরে আসি’’। কেন! জিগ্যেস করায় সে শুধু বললো ‘'চল না। দুপুরে লাঞ্চ খাওয়াবো”। আমি আর বাধা দিইনি। মতিঝিলের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিল্ডিংয়ের দুতলায় আমার অফিস। ওখান থেকে রিক্সায় উঠে প্রেসক্লাবের গেটে থামলাম ঠিকই কিন্তু রিক্সা থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে এনএসআই সংলগ্ন তথ্য দপ্তরের বৃটিশ মডেলের বিল্ডিংয়ে ঢুকলাম। বড় বড় রুম। বিশ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল। আঠার বিশ ফুট উঁচু ছাদ। রেল লাইনের পাতের মত লোহার ছাদবীম। কাঠের খড়খড়ি লাগানো ইয়া মস্ত জানালা। যেন বৃটিশ শাসনের উম লাগানো ডেপুটিদের আপিস। দোতলার একটা রুমের সামনে এসে মাকিদ আমাকে নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লো। রূমে ঢোকার আগে নেম প্লেটটাও ঠিকমত দেখার সুযোগ পাই নি। খুব ছিমছাম গুছানো রূম। চেয়ারে বসে আছেন সংগীত জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি সৈয়দ আব্দুল হাদি। “আরে মাকিদ আসো আসো। তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। কি অর্ডার দিব বলো”। পরিচয় হবার আগেই হাদি ভাই বলে ফেললেন আমার পরিচয়। “তা কেমন আছেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব”। আমি তো থ বনে গেলাম। বিশেষ করে হাদি ভাইয়ের আতিথেয়তায়। হাদি ভাইয়ের সাথে ওটাই ছিল আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। তখন তিনি সম্ভবত: তথ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ছিলেন। ওই বিল্ডিংয়ের চার তলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং উইংয়েরও অফিস ছিল। সে ২০১০ সালের দিকের কথা। ওখানে প্রায়শই যাওয়া পড়তো। বন্ধুবর যুগ্মসচিব ডা: মুন্সি আনোয়ার হোসেন তখন ঐ উইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
শ্রদ্ধেয় হাদি ভাইয়ের অতি দরদ নিয়ে “নিজেদের কাঠগড়াই দাঁড় করাতে হবে” হেড লাইনের বক্তব্য সম্বলিত কথগুলি সত্যিই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিংবদন্তি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী কাদেরী কিবরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে রাজহাঁস শিকারের সত্য ঘটনাকে উদ্ধৃত করে তিনি মাতৃত্ব পিতৃত্ব বা সঙ্গীর বিরহে অকুতোভয় হওয়ার ছবি তুলে ধরেছেন। আজকের দিনে কিশোর যুবাদের চাকরী সংক্রান্ত বৈষম্যের কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সমর্থনেই হয়তো এই কথাগুলি বলেছেন। বলেছেন বা স্মরন করিয়ে দিয়েছেন সমাজের নাগরিক হিসাবে নিজের দায়বদ্ধতার কথা। তার এই বোধদয়কে আমি শ্রদ্ধা করি। স্যালুট জানাই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সচেতন শুদ্ধাচারের অকপট উচ্চারনের জন্য। সত্যিই তো তাই। যারা মেধার মূল্যায়ন চেয়ে মাঠে নেমেছে সেইসব তরুন যুবা আজ বাংলার দৃশ্যপটে আছে কি? দেশকে ভালবেসে স্বপ্নচারী হওয়ার সূচনা লগ্নেই তারা হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার উর্বর জমিন থেকে। আমরা হারাচ্ছি আমাদের মেধাবী তরুন প্রজন্মকে। নিজেদের ভাগ্যান্বেষনে দেশের মধ্যবিত্ত ঘরের দামাল ছেলেমেয়েরা আজ বিদেশে গিয়ে সেখানে তাদের মেধার পরিচয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে। অথচ দেশ বিনির্মানে এই তরুন প্রজন্মকে বাংলার বড় প্রয়োজন। মানব সম্পদ উন্নয়নের এসব ধারালো হাতিয়ারগুলোকে অবহেলায় তাচ্ছিল্যে রেখে আমরা চেতনার বিকিকিনি করে দেশটাকে মেধাশূন্য করে ফেলছি। শুধু তাই না, কোটা সুপারিশের শুভংকরের ফাঁক সৃষ্টি করে অযোগ্য তরুন যুবাদের পার্টিজান রাজনীতির ছাঁচে ফেলে স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থা তার মেকানিজমের হাতকে পোক্ত করার উন্মত্ততায় ঢেকুর তুলছে। পরম্পরাপুষ্ট কোটা সৃষ্ট কাঁটাদের মাধ্যমে দেশকে আমরা কতদূর এগিয়ে নিতে পারবো তার নমুনা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না!
একজন হারুন বিপ্লব বা শাহ কামাল বেনজির আসাদুজ্জামান মিয়ারাই কি শুধু এই চেতনার পাল্লায় উঠে আমাদেরকে ধন্য করেছেন! এরকম শত শত শহীদুল শাকিল মনিরুল আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে কোটার নামে কাঁটারূপে বিছানো রয়েছে - তার হিসাব কি আমরা রেখেছি! এরা পচা শামুকের ন্যায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতি নিশ্বাসে আমাদেরকে দংশন করে চলেছে। এদের দংশনে(অন্ন যোগানে) বাঙালীর উঠানে নীরব হাহাকার চলছে। এরা আমাদেরই ভাই ব্রাদার বা স্বজন সেজে আমাদের গায়েও ক্যান্সারের বিষাক্ত বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ক্ষমতা ও অর্থ বিত্তের জোশের তোড়ে আমরাও আজ নৈতিক অবক্ষয়ের পথে নিজেদেরকে মষিলিপ্ত করছি। সুতরাং আন্দোলন বা গনবিপ্লব করে শুধু সরকার পরিবর্তন করে এসব জঞ্জালের রাহু মুক্ত হওয়া বড়ই মুস্কিল। শেকড়ে হাত লাগাতে হবে। সরকার ব্যবস্থার খোল নলচে পাল্টে ফেলে সরকারী মেকানিজমের ঘুনে ধরা কল কব্জাগুলি ঝেড়ে মুছে সাফ করতে হবে। বৃটিশদের শিখিয়ে দেয়া আইডিয়া বা সূত্রের বিনাশ সাধন করে ওই নবীনদের কাছেই যেতে হবে। রবি ঠাকুরের ভাষায় কোরাস গেয়ে আকুতি করতে হবে -
“ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা”।