জালাল উদ্দিন আহমেদ
অস্তিত্বের নিকাশী-৩
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:৩৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাংলা মূলত: দুটি খন্ডে খন্ডিত হোল। তবে বাঙালীর বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দেশ বা প্রদেশে ছিটকে গেল। যেমন আরাকানীয় অঞ্চলের রোহিঙ্গা বাঙালীরা বার্মার রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দা হয়ে বার্মিজ জাতীয়তাবাদের অংশীদার হোল। আবার বৃহত্তর আসাম রাজ্যের শতকরা চল্লিশ শতাংশ বাঙালী হলেও তারা ভারতীয় অসমিয়া হিসাবে চিহ্নিত হোল। ওদিকে বিহারের বাঙালী গরিষ্ঠ মানভূম ছাপড়া মুঙ্গের ধানবাদের বাঙালীরা ভারতীয় বিহারী হিসাবে পরিচিত হোল। যাহোক হিন্দু মুসলমামের দুই পরিচয়ে বাঙালী দুটি রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে পরিচিতি পেল। পশ্চিম বঙ্গের ৭০% হিন্দু মেজরিটিতে ৩০% মুসলিম মাইনোরিটি রয়ে গেল। এদিকে পুর্ব বাংলার ৮০% মুসলিম মেজরিটির পুর্ব পাকিস্তানে ২০% হিন্দু মাইনোরিটি হিসাবে রয়ে গেল। যদিও পরবর্তীতে উচ্চ জীবন মানের হাতছানি ও কলকাতা জৌলুষের টানে হিন্দু মাইনোরিটির বাঙালরা ব্যাপক হারে ভারত মুখী হয়েছিলেন। তবে তৎসময়ের মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিমাতা সুলভ আচরনে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশকে পুর্ব বাংলা ছাড়তে হয়েছিল বলে মত পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে পশ্চিমের মুসলিম মাইনোরিটিরা পশ্চিমবঙ্গে অতটা বিমাতা সুলভ প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন বলে মনে হয়না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে উন্নত জীবনের হাতছানি ও কোলকাতার কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিদ্ধস্ত একটি অংশ পুর্ব বঙ্গ মুখী হয়েছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। দুই বঙ্গের বাঙালীদের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এই সেটেলড হওয়ার প্রবণতা বা বাধ্যবাধকতা ১৯৫০ পর্যন্ত চলমান থাকে।
বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাঙালী আইনগতভাবে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের দুটি আলাদা রাজ্য হয়ে নিজেদের ভাগ্যান্বেষনের সংগ্রামে ব্রতী হলো। যে বাঙালী বাংলা বিহার উড়িষ্যা সমন্বয়ের গ্রেটার বাংলার একটি শক্তিশালী জাতিস্বত্ত্বার পরিচয়ে বৃটিশ শাসনের India Act এ স্বীকৃত ছিল, সেই তারাই ধর্মভেদের জাতীয়তার তুষ্টিতে ভারতীয় ও পাকিস্তানীর পরিচয়পত্র গলায় ঝুলালো। সেক্ষেত্রে বার্মিজ অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের বাঙালী (যারা রোহিঙ্গা নামের হিন্দু মুসলিম) জনগোষ্টী বার্মিজ জাতীয়তাবাদে থিতু হোল। অর্থাৎ গ্রেটার বেঙ্গল এবং তার বাঙালী অস্মিতা ভারতীয় হিন্দি ও হিন্দু বলয়ের কুটকৌশল এবং বৃটিশ বেনিয়া শাসকদের মদতে ভগ্নদেহের বিচ্ছিন্ন জাতি পরিচয়ে বিলীন হোল। তবে মুসলিম গরিষ্ঠ পুর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেটি তার বাংলা অস্তিত্ব ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত টিকিয়ে রাখে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো স্থিতিশীল হলে তখন পুর্ব বাংলা পুর্ব পাকিস্তান হিসাবে স্বীকৃত হয়। ওদিকে ভারত শাসিত পশ্চিম বাংলা সাংবিধানিকভাবে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে।
আগেই বলেছি পাকিস্তানের অসম গঠন প্রণালীতে পড়ে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার শক্তিবলে পুর্ব বাংলার মুসলিম গরিষ্ঠ ভূখন্ড পুর্ব পাকিস্তানের তকমা নিয়ে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের উর্দু ভাষা-ভাষীদের কাছে প্রজা রূপে সাব্যস্ত হোল। এবং এটাই সম্ভবত: বাঙালীকে তার আপন স্বত্বা আবিস্কারে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। এছাড়া আধুনিক চিন্তাধারা ও রাজনীতি সম্পৃক্ততায় পুর্ব বাংলার আমজমতা ততটা প্রাগ্রসর চিন্তা চেতনায় না থাকলেও তাদের নেতৃত্বের সম্মুখ সারিতে যারা ছিলেন তাদের ধর্মীয় আচার আচরনের আদর্শিক আবরনে বাঙালী সন্তুষ্ট ছিলেন। তবে সময়ের বহমানতায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুর্ব পশ্চিমের কৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈষম্য এক সময় প্রকট আকার ধারন করে। ফলে পশ্চিমের উর্দুভাষী গোষ্টী তাদের শাসক হয়ে থাকার ক্ষমতার দন্ডে একসময় বাঙালী অহংবোধের বিপুল জনগোষ্ঠীর পাকিস্তানীদের স্রেফ তাদের প্রজা জ্ঞানে শাসন ও শোষন কার্য বলবৎ রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
‘'বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দঢ়’ কাহাবতের সেই শাশ্বত বাণীকে সত্যি করে বাংলার সবুজ উঠানে ততদিনে আরেক বাঙালী ধুমকেতুর আবির্ভাবে বাঙালীকে তার আপন অস্মিতার জাগরনে সুবাস ছড়ালো। সুভাস বসু আপন তেজস্বীয়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে বৃটিশের মত পরাক্রমশালী দখলদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন। তারই যোগ্য উত্তর পুরুষ হয়ে মুসলিম বাংলার সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবর রহমান পরিণত রাজনীতিবিদ হয়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আপামর বাঙালীর নেতা হয়ে উঠলেন। বাঙালীর ভালবাসায় তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ ডাকের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন। তাঁরই নেতৃত্বে পাকিস্তান অধ্যুষিত পুর্ব বাংলার বাঙালী পৃথিবীর দূর্ধষ্য পাক ফৌজের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে বাঙলাকে ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পত্তন ঘটালো। বাঙালী তার আপন ঠিকানায় নিজেদের বন্দোবস্ত করে নিল। ফলে ভারত ভাগের বাংলা বিভাজনে ধর্মীয় রেসের যে কলঙ্ক বাঙালীকে কলুষিত করেছিল তার প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও বাঙালী করতে পেরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ধর্ম নির্বিশেষের বাঙালী নিজেদের আপন ভূখন্ডে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তার অহংবোধে পৃথিবীতে নিজের পরিচয়ে উজ্জ্বল হয়েছে।
বাংলা ভাগের সেইসব কলুষিত অধ্যায়গুলি মুছে ফেলার আয়োজনে ঢাকা কেন্দ্রিক পুর্ব বাংলা আপন অস্মিতায় নিজস্ব পরিচয়ে সার্বভৌম হলেও বৃহত্তর বাঙালী জাতীয়তাবোধে আমরা কি উচ্চকিত হতে পেরেছি? নিজের অস্তিত্ব বিনির্মানে বৃহত্তর বাংলার পুর্বাংশ অর্থাৎ কচু ঘেচু খাওয়া কাদামটির আন-পাড় বাঙালীর বাঙালরা আজ বাংলাদেশী বাঙালীর আত্মপরিচয়ে পরিতৃপ্ত। অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,বিহার ও আসামের বাঙলীরা এবং মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য অধ্যুষিত বাঙালী আজ ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে সংবিধিবদ্ধ। তারপরেও দুধ বেচে মদ খাওয়ার বাতিক এবং রবি ঠাকুরের বিখ্যাত উক্তি ‘'বাঙালী আত্ম সমালোচনা করতে জানে না। অপরের নিন্দায় সে গগন বিদীর্ণ করে”র সেই শাশ্বত ঘুর্ণাবর্তেই আমাদের জীবনমান লাটিমের মত একই গতিতে চলমান রয়েছে। নইলে এত এত বছর কেটে যাওয়ার পরেও বাঙালী এখনো হিন্দু মুসলিম আইডেন্টিটির ঝুট ঝঞ্জাটে নরুনবাজি করে! পরমত সহিষ্ণুতা ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের অনুশীলনে আমরা যদি মানুষ হয়ে এগোনোর চেষ্টা না করি তবে বিধির লিখন যে দিনে দিনে উইপোকার ঢিপি হয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের সমগ্রতায় অশনির ডংকা বাজাবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ইদানীং সময়ে সাতচল্লিশের সেই ধর্মীয় কলুষময় শ্লোগান এবং রাজনীতির উড়নচন্ডি কার্যকলাপে এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, কবিগুরু কথিত “সাত কোটি(এখন অবশ্য ৩২ কোটি)বাঙালীরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি”র সেই ঘুর্ণিচক্রেই আমরা খাবি খেতে থাকবো। ধর্মগুরুদের কূপমন্ডুকতা থেকে বেরিয়ে এসে মানবতার সমগ্রতাকে নিয়ে ভাবতে হবে। সমাজপতিদের বাঙালী হওয়ার অহংবোধে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি রাজনীতির ভন্ডামী পরিহার করে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হবে। তবেই না আমরা উচ্চরবে নজরুলের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারবো “বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে”।