জালাল উদ্দিন আহমেদ
অস্তিত্বের নিকাশী-২
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ আগস্ট,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ১১:০৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ভারতীয় রাজনীতির কুট কৌশলের এহেন পরিস্থিতির গোলক ধাঁধায় বাঙালীর সামগ্রিকতা কচু পাতার ফোঁটা জলের মত ছিটকে গিয়ে চরম বৈরিতায় ঠাঁই নিল। তবে ধর্মীয় উন্মত্ততার বিষবাষ্প যেভাবে বৃহত্তর বাংলায় জাল বিস্তার ক’রে মানুষের মনে হিংস্রতার বাতি জ্বালিয়েছিল, সে ঘৃণার রেশ আস্তেধীরে স্তিমিত হয়ে যায়। বাংলার বুদ্ধিজীবিদের একাংশের নির্ভেজাল সংস্কৃতি চর্চায় তা চাঙ্গা হয়ে উঠে। তবুও সামগ্রিক সূচনায় ক্ষমতার দাবিদার দুই পারের মুখিয়া অর্থাৎ মুখুজ্জে বাড়ুজ্জে বাবুদের এবং শেখ সৈয়দ সাহেবদের সাম্প্রদায়িক পাশার ঘুটি রাজনীতিতে চলমান থাকে(যা এখনও আছে)। যাহোক চলমান রাজনৈতিক সমীকরনে বাঙালীর বাঙালীয়ানা যেন দু’দিক থেকেই আছাড় খেতে থাকলো। একদিকে বিহারী ইউপি পাঞ্জাবীদের ইসলাম তত্ত্বের পাকিস্তান জিন্দাবাদের সালসা, অন্যদিকে হিন্দি বলয়ের মাড়োয়ারী গুজরাঠী মারাঠী পাঞ্জাবীসহ বহু বর্ণের ভারতীয়দের নিয়ে জয় হিন্দের বারোয়ারী ঘর সংসারে বাঙালীর পশ্চিমাংশের নাভিশ্বাস অবস্থা।
কিভাবে বাংলার পুর্ব পশ্চিম হোল তার বিস্তারিত বাগাড়মম্বর বহুবার বহু আঙ্গিকে শোনানো হয়েছে। সবখানেই দোষারপের কাহিনী। আর এই কাহিনী যারা বর্ণনা করেন তারা বড়সড় পদবীধারী হলেও গায়ের গন্ধে তারা যে হিন্দু মুসলমান সেটা তাদের বয়ানেই বুঝা যায়। তবে ইদানীং সময়ে একজন মতুয়া অধ্যাপক শ্রী নকুল মল্লিকের মুখে তার গবেষনালব্ধ পরিসংখ্যানে বাংলা ভাগের একটা স্বাস্থ্যকর চিত্র পাওয়া যায়। মোটকথা বাংলা ভাগের সারকথা হোল ক্ষমতার রেস। সেই রেসে ক্ষমতার লাইমলাইটে না আসতে পারার খেদ ও হতাশায় বাঙালী শক্তির একটি ধর্ম ভিত্তিক উপর তলার গোষ্ঠী তাদের পরাশ্রয়ী মনোবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। তারা তাদের ভাতের থালা অন্যের পাতে এগিয়ে দিয়ে মহান হওয়ার সেই পৌরাণিক পটচিত্রের ক্ষেত্র তৈরী করে শুষ্ক হাসি হেসেছেন। ধর্মীয় জোশের হাইপ তুলে একটা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে তার যৌক্তিকতা প্রমানে কামিয়াবও হয়েছেন তারা। যে নেতাজীর সৈনিকেরা ধর্মীয় মেলবদ্ধনের সেতু তৈরী করে আযাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে পরাধীন ভারতবর্ষকে সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক মহান রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ইংরেজদের মত পরাক্রমশালী শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল, সেই তারাই একসময় আপন ঘরানার বর্ণাশ্রয়ী গুজরাঠী হিন্দি বলয়ের কাছে অপাংতেয় হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে বাঙালী অস্তিত্বের নেতৃত্ব এবং তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও অস্মিতার সবটুকুই যেন হারিয়ে যেতে বসলো। যে বাঙালী অস্তিত্বের পরিসর আরাকানীয় সভ্যতা থেকে শুরু হয়ে উত্তরে আসামের বরাক, গোয়ালপাড়া, শিলচর এমনকি কামরূপ কামাখ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত, আবার পশ্চিমের মানভূম, ধানবাদ, মূঙ্গের, পুর্ব ঝাড়খন্ড পর্যন্ত প্রসারিত, সেই বাঙালী অস্তিত্বের গৌরব পুর্ব বাংলার ঢাকা কেন্দ্রিকতায় স্থিতি পেল।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে কি পশ্চিম বাংলার বাঙালীরা বাঙালী হিসাবে স্বীকৃত নয়। সোজা উত্তর অবশ্যই নয়। ওরা ভারতীয় হিসাবে স্বীকৃত, যেমন একটা সময় ঢাকা কেন্দ্রিকতার বাঙালীরা পাকিস্তানি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। মোটকথা, দেশ ও জাতির পরিচয়ে উপলব্ধ হয়ে যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের স্বীকৃতি অর্জন করেছেন তারাই সেই দেশ ও জাতির পরিচায়ক হিসাবে গ্রহনীয়। কলকাতাকে সামনে রেখে যারা বাঙালীত্বের অস্তিত্ব ও অস্মিতার বড়াইয়ে পাতাভর্তি গল্প উপন্যাস ও চোখে ঠুলি লাগানোর ইতিহাস রচনা করে তৃপ্ত হতে চাইল তারা মূলত: ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলাজাত মামুষজন। এসব চটকদার গল্প উপন্যাস ও ইতিহাস পড়ে বর্ণ বৈষম্যের শিকার নীচু শ্রেনীর মানুষজন আর্য অনার্যের ভিত্তিমূলকে শিরোধার্য করে সাচ্চা হিন্দুস্তানী হওয়ার আন্দোলনে সামিল হোল। এভাবেই বৃহত্তর বাংলার পশ্চিমের অংশকে নিয়ে কলকাতা কেন্দ্রিকতার জোশে পশ্চিম বঙ্গ প্রতিষ্ঠা পেল। “জোশ” শব্দটা উচ্চারিত হোল এই কারনে যে, সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে সে সময় কলকাতার চাহিদা এক নম্বরে। সুতরাং গোটা বাঙালী সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হিন্দু নেতৃত্বের মহাশয়েরা সব পেয়েছির কলকাতাকে আত্মতুষ্টিতে নিয়ে নিজেদের বাঙালী অবস্থানকে এভাবেই তছনছ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন।
পুর্ব বাংলার মুসলিম নেতারা বিশেষ করে কলকাতায় ক্ষমতাসীন থাকা বৃহত্তর বাংলার মুসলিম নেতা ও তৎসময়ের অনেক ডাকসাইটে হিন্দু নেতাও এই বাংলা ভাগের বিপক্ষে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ক্ষমতার ধন্ধে ঘুরপাক খাওয়া বাঙালী মশাইরা পশ্চিম বাংলাকে হিন্দি বলয়ের ভারত রাষ্ট্রে আত্মসমর্পন করালেন। সেক্ষেত্রে বর্ণ বৈষম্যের হিন্দি বলয়ের একটা স্পষ্ট যোগসাজশ ছিল বলে স্বরাজ আন্দোলনের অনেক নেতাই বলে গেছেন বলে আমরা জেনেছি। পুবের ঢাকা কেন্দ্রিক মুসলিম বাঙালীরা যাদের শতকরা সত্তর ভাগই স্বাক্ষর জ্ঞানহীন ছিলেন, তারা তাদের বর্তমানকে নিয়ে লিল্লাহি তাকবিরের পাকিস্তান জিন্দাবাদের পতাকাতেই সন্তুষ্ট হলেন। সেক্ষেত্রে অতি ইসলামীয় কর্ণার থেকে বিজাতীয় মুসলিম শাসকদের শ্রেয় ভেবে আপন করে নেয়ার বিষয়টি তাড়াহুড়া ও বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে বলে বিদগ্ধজনের আলোচনায় জানা যায়। বাংলা ভাগের হিসাব নিকাশের ফালনামা খুলে দেখা যায় ধর্মীয় জাতি তত্ত্বের হুজুগ সৃষ্টি করে রাজনীতির ক্ষমতা লিপ্সু দুটি গোষ্ঠী একটি অখন্ড বাঙালী জাতীয়তাবাদের অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন।
উপমহাদেশের একটি শক্তিশালী উদীয়মান জাতি স্বত্ত্বাকে ধর্মের বিষাক্ত ছোবলে বিভাজন করিয়ে তারা হিংসা বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। আর কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবির যেসব নমস্য মনীষীদের নিয়ে আমরা হৈচৈ তোলপাড় করে তাদেরকে মাথায় নিয়ে নাচানাচি করি, মূলত: তারা ছিলেন বাংলা ভাগের সাইলেন্ট কিলার। তাদের কবিতা সাহিত্য নিয়ে যতই মাতামাতি করিনা কেন, প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মন্য ডমিনেটিং ক্যারেক্টার সমূহের এক একজন সহিস। এক্ষেত্রে বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবি, যারা হাতে গোনার পর্যায়ে ছিলেন, তাদের মতিগতি ও বেড়ে উঠা বিদ্যাসাগরীয় ও আনন্দবাজার বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায়, তাদের আওয়াজ খুব একটা উচ্চলয়ে বেজেছিল বলে মনে করার কোন কারণ নেই। সেক্ষেত্রে মুসলিম জাগরন ও বাঙালী জাতীয়তাবাদী কবি নজরুল, ‘'মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম-হিন্দু মুসলমান। মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ” আওড়াতে গিয়েও তো “বিদ্রোহী” তকমায় নিজেকে মুড়িয়ে নিলেন। সব্যসাচী কবিকে এই বিদ্রোহী মলাটে লেপ্টে দেওয়াটাও কোন ব্রাহ্মন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্টীর মহাপরিকল্পনা ছিল কিনা তা বোদ্ধারাই ভাল বলতে পারবেন। কারণ নজরুলের কাব্যরীতির আলোকছটা যেভাবে সর্বধর্মের মোড়কে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থানে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে করে ধর্মীয় উস্কানীর বাংলা ভাগ বা বাঙালীর বিভাজন হালে পানি পেত বলে মনে হয় না।
(চলমান)