জালাল উদ্দিন আহমেদ
অস্তিত্বের নিকাশী-১
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৮:২৩ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
এখন তো বলতেই হয়। বলার সময় বোধ হয় এসেই গেছে। যেভাবে চলছে, দেশ ও দশের চালিকা শক্তির গতি প্রকৃতি যেভাবে মোচড় দিচ্ছে তাতে করে আর বেশী সময় কি আর আছে যখন কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা খাওয়া একজন বাঙালীর মুখ দিয়ে ‘'এ রুটি তো পোড়া হ্যায় কেমন করে খাব হ্যেই” বলেই বাকী জীবনের রোজনামচা তৈয়ার করতে হবে। অবশ্য কোটেশন বাক্যটি আমি যখন ক্লাস সেভেনের শিশু কিশোর ছিলাম তখনই আমার অংক শিক্ষক শ্রদ্ধেয় ভবতারন বাবুর মুখ থেকে শুনেছি। গল্পটা এরকম ছিল। দুই বাঙালী বন্ধু দিল্লিতে বেড়াতে গেছেন। একেবারে চাষাভুষা নিখাদ বাংলা বলা বাঙালী তারা। রাতে হোটেলে খেতে গেছেন। যথারীতি রুটি মাংস সার্ভ করা হয়েছে। তন্দুরী রুটি পূড়া কালচে ছিল বিধায় তাদের সেটা খেতে একটু অনীহার ভাব। যথারীতি বেয়ারাকে ইশারায় ডাক দেয়া হোল। বেয়ারা টেবিলের সামনে হাজির। “দাদা পুড়া রুটি খেতে পারবো না। বদলে দাও”। বেয়ারা কিছুই বুঝেনা। তখন বাঙালী বাবু দাঁত খিঁচিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলেন ‘এ রুটি তো পুড়া হ্যায় কেমন করে খাব হ্যেই’। দাদা অর্থাৎ মহারাজ কিন্তু ভালই বলেন। খেলতে খেলতে চলতে চলতে দাদার ওই বাংলাটা ভালই আসে। আর দিদি! তিনি পাঞ্জাবী মারাঠী গুজরাঠী সবগুলিই আওড়ান। শুনতে বেশ ভালই লাগে। তবে এই হেয়ালীপনার গূঢ় তত্ত্ব তখনই জনমনে আসর করবে যখন ওই ভানু বন্দোপাধ্যায়ের কৌতুক ‘'গৃহস্তের ঘরে চোর ঢুকেছে”র পর্যায়ে এসে দরজায় কড়া নাড়বে। অর্থাৎ চোর ঘরের সবকিছু সাবাড় করে যখন আর কিছু না পায় তখন গৃহস্তের পরনে নতুন চকচকে লুঙ্গিটাতেও টান মারে। টান হয়তো কাউরি না কাউরি উপরে পড়েছিল বলেই আজ বাঙালীর একাংশ আপন স্বত্ত্বায় গর্বিত জাতি হিসাবে বিবেচিত।
আসলে জাতি হিসাবে আমরা বরাবরই একটা আশ্রয়ী মনোবৃত্তির অংশীদার। বৃহত্তর আঙ্গিকে দায়িত্ব নিয়ে নিজের মত করে উঠান সাজানোর স্বকীয়তায় আমরা কখনোই পারঙ্গম হয়ে উঠিনি। কবে সেই শত বর্ষ আগে বাঙালীর ঘরে এক ধ্রুব তারার আবির্ভাব ঘটেছিল। নেতৃত্ত্বের স্ফুরনে যিনি সারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কামনায় যুদ্ধ সেনাপতি হয়ে বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন। কিন্তু জাতি বিভক্তির কসমোপলিট্যান ভারতে তিনি তার কাংখিত আকাংখায় কামিয়াব হতে পারেন নি। ভারতীয় রাজনীতির হিন্দি বলয়ের আধিপত্য তাকে সর্বভারতীয় রাজনীতির শিখর থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছিল অত্যন্ত সুচতুর কায়দায়। বলছি শ্রদ্ধেয় নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর কথা। ভারতীয় রাজনীতির ধ্রুবতারা ছিলেন তিনি। এবং সেটাই বোধ হয় টের পেয়েছিল ভারতীয় রাজনীতিতে থাকা কংগ্রেসের হিন্দি বলয়ের বর্ণবাদী ব্রাহ্মন্য নেতারা। ফলশ্রুতিতে নেতাজীকে যুদ্ধংদেহীর তুষ্টিতে রেখেই কংগ্রেসের ফ্রন্ট লাইনে থাকা হিন্দি বলয়ের কাশ্মীরজাত উকিল মতিলাল নেহেরুর পুত্র বৃটিশ ব্যারিস্টার জওহারলাল নেহেরুকে দিয়ে সাপ মারার কাজটি সেরে নেয়া হয়। আর নেতৃত্বের মহাধিপতি গুজরাঠীয় বাপুজির মাধ্যমে “go ahead” এর বার্তা দিয়ে নেতাজীকে সাবমেরিনে ঢুকিয়ে জাপান পাঠানো হয়। ঠিক যেন “না রহেগা বাঁশ, না বাজেগা বাঁশি”র এক চানক্যীয় দুতিয়ালী। অর্থাৎ সাপও মরলো লাঠিও ভাঙ্গলো না।
এ তো গেল বাঙালীকে নেতৃত্ব শুন্য করার গুজরাঠীয় এক ধুন্ধুমার অথচ রিস্কি আয়োজন। পরবর্তীতে বাঙালীকে ঠুঁঠো জগন্নাথ বানানোর যে মহাপরিকল্পনায় গুজরাঠীয় বৃটিশ ব্যারিস্টার মোহন দাস করমচাঁদ ও তার পোষ্যপুত্র বল্লভ ভাই প্যাটেল করেছিলেন সেই আঁচের আগুনে এখনও বাংলা ও পাঞ্জাব ধুকে ধুকে জ্বলছে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে জ্ঞানে মানে ও ধনে সবকিছুতেই বাঙালী নেতৃত্ব এগিয়ে থাকলেও ক্ষমতার দন্ডের সাহচর্যে পশ্চিম ভারতীয় হিন্দি বলয়ের নেতারা এগিয়ে ছিলেন। বাঙালীর বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তিতর্কের টেবিলে বৃটিশ শাসকরা একটু হলেও অস্বস্তিতে থাকতেন, ফলে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্তের পশ্চিম ভারতীয়দের তারা পছন্দ করতেন। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহারে পশ্চিম ভারতীয় নেতারা বাঙালীকে খর্ব শক্তিতে পরিণত করার হেন অপকৌশল নাই যা তারা প্রয়োগ করে নি। নইলে ভারত ভাগের সেই টালমাটাল দিনগুলিতে সর্বভারতীয় মহাত্মার কাছে শরৎ বসু ও আবুল হাশেমরা বাংলা ভাগ বন্ধ করার দাবীতে গেলে উনি মুচকি হেসে “আমার কিছু করার নাই। যা হরার হয়ে গেছে। তোমাদের তা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নাই” বলে বিদায় করেছিলেন। এই বাক্য থেকেই হিন্দি বলয়ের চানক্য নীতির বলি হয়ে বাংলাকে যে খর্বকায় করার প্ল্যান করা হয়েছিল তা সহজেই বুঝা যায়। অথচ সেদিনের ভারতবর্ষে বাংলা এবং পাঞ্জাবই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট দুটি রাজ্য যারা ধনে মানে জ্ঞানে সর্বক্ষেত্রে ভারতের শ্রেষ্ঠতম রাজ্য হিসাবে বিবেচিত হোত।
আমার তো মনে হয় ধর্ম চেতনাকে সামনে এনে জাতীয়তাবাদ তৈরীর মূল অনুঘটক ছিলেন তখনকার সময়ের গুজরাঠ মারাঠী ঘরানার আরএসএস মন্ডলীয় কেউটেরা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলার মন্ত্রেই তারা আরএসএসের বুনিয়াদ মজবুত করার লক্ষে তৎসময়ের বিজ্ঞ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভারতীয় মনীষী স্যার আশুতোষ মুখার্জীর ছেলে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে সামনে এনেছিলেন। ধর্মকে সামনে এনে বাঙালীকে দুভাগ করার মোক্ষম অস্ত্রটি তারা এভাবেই ব্যবহার করেছিলেন। ধর্মভেদের বিষ ছড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ বাঙালী সমাজকে এমনভাবে বিষাক্ত করে দিয়েছিলেন যে শত শত বছরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই দাদার মত জীবন যাপন করা বাঙালী, হিন্দু মুসলমানের তকমা গলায় ঝুলিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হিংস্রতায় উন্মত্ত হয়ে উঠে। নিমিষেই তারা তাদের পাশাপাশি বেঁচে থাকার শাশ্বত আহ্ববানকে তুচ্ছ জ্ঞানে খাঁটি হিন্দু বা সাচ্চা মুসলমান হওয়ার তাগিদে রক্তের হোলি খেলায় উন্মত্ত হয়ে উঠে। অথচ সেদিনের অবস্থানে বাঙালী তাদের বৃহত্তর পরিসরের চাহিদায় আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলা রাষ্ট্র পাওয়ার বদলে দুটি ধর্মীয় জাতি রাষ্ট্রের অধীনে দুভাগের দুটি আলাদা রাজ্য হিসাবে পরাধীন হোল। একদল নাম লিখিয়েছে হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তার ব্যানারে। আরেক দল বাঙালীর ভাগে পড়লো পাকিস্তানী পতাকার মুসলমান তত্ত্ব। হিন্দু মুসলমানের ধর্ম বিভাজনে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান নামক দুটি জাতীয়তার শিবিরে সামিল হোল তারা। অর্থাৎ বাঙালীর আপন স্বত্ত্বা বলে কিছুই থাকলো না। শুধুমাত্র ধর্ম নামক জুজুর হাত ছানিতে তারা তাদের আপন জাতীয়তার বাদ ও বোধকে বিসর্জন দিয়ে পরাধীনতার তকমা গলায় ঝুলালো।
আগেই বলেছি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও জাত্যাভিমানের অভিযাত্রায় বাঙালী সব সময় এগিয়ে চলার মানসিকতায় অগ্রনী। তবে আপন স্বার্থ উদ্ধারের খেলোয়াড় হিসাবে তাদের কোথাও যেন ছিদ্র রয়ে গেছে। নইলে একজাতি এক ভাষা, আচার আচরন চলন বলন এক ও অদ্বিতীয় হলেও শুধুমাত্র ধর্মকে সামনে এনে একটা জাতি কিভাবে দ্বিখন্ডিত হয় সেটা আমার বোধে আসে না। বাঙালীরা যাতে তাদের বাঙালী অস্মিতায় মাথাচাড়া দিতে না পারে তার মাস্টার প্ল্যান হিসাবেই এই হিন্দু বাঙালী ও মুসলমান বাঙালীর উৎপত্তি। এই উৎপত্তির ধরন ও ধারনের কিছুটা অসংগতি ছিল বলেই হয়তো দুই ধারের দুই বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্ফুরন দু'ভাবে এগিয়েছিল। বৃহত্তর বাংলার পুর্বাশের মুসলমান অধ্যুষিত বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংগীভূত হোল বৃহত্তর ভারতের পশ্চিমের মুসলিম গরিষ্ঠ চারটি রাজ্যের সাথে। অর্থাৎ হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব সৃষ্টিকারী ভারতের মূল ভূখন্ডকে মধ্যে রেখে দুপাশের পাঁচটি রাজ্য সমন্বয়ে এক উদ্ভট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হোল। যেখানে পশিমাংশের পাকিস্তানীরা পূর্বাংশের পাকিস্তানীদের কাছে প্রভুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হোল। ফলে মুসলিম অধ্যুষিত পুর্ব বাংলার বাঙালীরা উর্দু বলয়ের পরিযায়ী শাসকদের চাপিয়ে দেয়া আইন ফরমানে প্রতি নিয়ত আঘাত পেতে থাকলো। অন্যদিকে হিন্দু বাঙালীরা কোলকাতা কেন্দ্রিকতায় থিতু হতে চেয়ে সেখানে এক সামাজিক জগা খিচুড়ির ঘটি-বাঙাল সংস্কৃতির জন্ম দিল। পাশাপাশি হিন্দু বাঙালী তার মেধা ও মননশীলতার সংমিশ্রনে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় হওয়ার ইঁদুর দৌঁড়ে সামিল হোল। ফলে সামগ্রিকতার নিরিখে পশ্চিমের হিন্দু বাঙালী বহু জাতি ও ভাষা সমন্বয়ের ভারতে এক অসম প্রতিযোগিতায় সাচ্চা হিন্দুস্তানী হওয়ার জটিল সমীকরনের মহা সমুদ্রে অবতীর্ণ হলো।
(চলমান)