জালাল উদ্দিন আহমেদ
দুনিয়াটা যাচ্ছে কোনদিকে
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ জুন,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৮:৪৯ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ইদানীং লিখতে বসলেই কেন যেন উল্টাপাল্টা চিন্তাগুলো এসে মাথায় ভর করে বসে। তখন যা নিয়ে লিখবো ভাবি তার বিস্তৃতি অন্য দিকে পাখা মেলা শুরু করে। এটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। গেরস্থ কৃষকের ঘরে জন্মেছি। বিশুদ্ধ জীবন। চাল ডাল সবজি দুধ দই ঘি গুড় মাছ মাংস সবই তো ঘর গৃহস্তি থেকে উৎপন্ন। নুন তেল চিনি মসলা ছাড়া আর কিছু তো কিনে খেয়ে বেড়ে উঠিনি। তাহলে ঠান্ডা মাথায় শান্ত পরিবেশ তৈরী করে কেন এগোতে পারিনা! ব্যক্তি জীবনে হৈচৈ নেই, দাঙ্গা ফ্যাসাদ নেই, সামাজিক রাজনৈতিক কোন জটিলতা নেই - এরকম এক নির্ভেজাল জীবন শুরু করা একটা মানুষ কেন আজ এত জটিল আবর্তে পড়ে খাবি খাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আত্ম বিশ্লেষনের জায়গায় গিয়ে কোথাও তো কোন ব্ল্যাক হোল বা স্পটও দেখতে পাচ্ছি না। সেক্ষেত্রে জীবন সংগ্রামের মোড়গুলির খোঁজ করলে হয়তো বাধা বিপত্তির ব্ল্যাক স্পট দু'একটা মিললেও মিলতে পারে। তবে চিন্তাশক্তির আবেগে সে সবের প্রভাব এক্ষেত্রে পড়ার কথা নয়।
জীবন সংগ্রামের বর্তমান জটিল সমীকরন এবং ডামাডোলের এই ঘুর্ণাবর্তে সবকিছুই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। এই ডামাডোলটা কিন্তু চাপিয়ে দেয়া। আর সমীকরনটা হচ্ছে বুদ্ধি ও শক্তির যথাযথ প্রয়োগ। যেদিকে তাকাই শুধু অনিয়ম আর অনাচারের ভুরি আয়োজন। ক্ষমতার দন্ড হতে আসা বয়ান, তা সত্য মিথ্যা যা কিছু হোক না কেন, সেটাই আইন-বেদবাক্য। রাষ্ট্রবদ্ধ জীবনে বেঁচে থাকার মানদন্ড। দুনিয়াজোড়া আয়োজনের এই বিবেকহীন বোধ নিয়েই আজ সমগ্র জগত সংসারের চাকা এভাবেই ঘূরপাক খাচ্ছে। কোথাও অর্থ কোথওবা শক্তির জোশ। কোথাও আভিজাত্যের রক্ত পরম্পরার রেশ। হিউম্যান রেসের সাদা কালোর ইন্-হিউম্যানিটি প্রকাশ্য না থাকলেও মাঝে মধ্যে সেসব আদিমতা ছিটেফোঁটা প্রকাশ্য হয়ে ধরা পড়ে। সেক্ষেত্রে এই যে অশান্তি অভিযোগ অনুযোগ এবং হানাহানি ও ঝগড়াঝাঁটি দেখা যায় - তার মূল সূত্র হচ্ছে ধর্ম। অথচ এই ধর্ম মানুষকে সংযমী করে। ধর্ম মানুষকে সহমর্মিতা, মানবিক মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধসহ আরো যতশত সুন্দর ও স্বচ্ছ্ব জীবনবোধের শিক্ষা দেয়। পৃথিবীতে যত রকমের ধর্ম থাকুক না কেন, প্রতিটি ধর্মেই মানব জাতিকে পরিমার্জিত মানবিক মূল্যবোধে উচ্চকিত করে। ধর্মের ব্যবহারিক প্রয়োগে ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তি শুদ্ধি ও সামাজিক মূল্যবোধে প্রতিটি ধর্ম নিজ নিজ উঠানে মানব জাতিকে সুশৃংখল করে, পরমত সহিষ্ণুতা শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় উজ্জীবিত করে। অথচ আজকের দিনে এই ধর্মকে ঢাল বানিয়ে ধর্মের জয়ডঙ্কায় বিশ্ব ব্রম্ভান্ড প্রতি নিয়ত ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। মানবতা ভূলুন্ঠিত হচ্ছে।
ধর্মীয় ভেদজ্ঞানের অভিজ্ঞতা ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কোনটা শক্ত গাঁথুনির সুক্ষ্ম ইনস্টিংটে সুপ্ত আকারে বিরাজমান। কোনটা প্রকাশ্য প্ল্যাটফরম তৈরী করে নিজেদের বনেদিয়ানা জাহির করার এন্তেজাম। আবার সম মাতাদর্শী না হয়েও নিজেদের বুদ্ধি অর্থ ও শক্তির সামঞ্জস্যতায় ভিন্নধর্মী হয়েও মাসতুতো ভাইয়ের আচরনে অন্যের ঘাড়ে বন্ধুক রেখেই তাদের অস্তিত্ত্বের জয়গানে তারা উচ্চশির থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। সেক্ষেত্রে ধর্মের উচ্চাকাংখায় নিজেদের পাটাতন শক্ত করার বাতিক তখনই ভূখন্ডের জাতিগোষ্ঠীর কাছে পরম আকাংখিত হয় যখন তারা তাদের আঁতুড় ঘরে দূর্বৃত্য অনুপ্রবেশকারীর অনাকাংখিত আনাগোনা ও খবরদারিতে অতীষ্ট হয়ে পড়ে। যারা শক্তি সম্পদ ও জ্ঞান বুদ্ধিতে সবার উপরে থাকে তারাই দুনিয়াজোড়া এই অনাকাংখিত অনাচারে লিপ্ত থাকে। হোক না সেটা অনাচার বা মনুষ্য আচরনের পরিপন্থী তবুও নিজেদের মহত্ব প্রচার ও প্রসারে তারা এসব অপকর্ম বিভিন্ন অজুহাতে করে থাকে। যার সবটুকুই ক্ষমতার দন্ড ও দম্ভের দুরাচারী বহি:প্রকাশ এবং অর্থ উপার্জনের চালিকা শক্তি হিসাবেই বিবেচিত হয়।
বলা যায় একটি অনাকাংখিত ক্ষত যা তুষের আগুনের ন্যায় সারা বিশ্বে উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তা হচ্ছে, আরব বিশ্বে জোর করে একটি ধর্মীয় জাতিল রাষ্ট্রের চারা রোপন। সেই চারা বড় হতে চায়, ফুলে ফলে শোভিত হতে চায়। কিন্তু যে ধর্মীয় রেশ ও ঘৃণা সৃষ্টি করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বুক চিরে অভিশপ্ত ও ঘৃণিত একটি জাতিকে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল তার সূদুর প্রসারী ফল যে সংলগ্ন এলাকা বেষ্টিত ভূখন্ডকে এক অগ্নিগর্ভ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিনত করবে তা তৃতীয় বিশ্বের কেউ না বুঝলেও এসবের মাস্টার মাইন্ড সেইসব পরাশক্তি তা বুঝেই করেছিল বলে মনে হয়। ওদিকে ধর্মীয় অজুহাতে বৃহত্তর ভারত ভূখন্ডকে অসম কায়দায় দু'ভাগ করা হলেও মুসলিম গরিষ্ঠতায় পুষ্ট একটি রাজ্যকে হিন্দুপ্রধান ভারতের সঙ্গে যুক্ত রেখে প্রকারন্তরে সেই তুষের আগুন জ্বালিয়েই রাখা হোল। ফলে জন্ম থেকে জ্বলছির অভিশপ্ততায় সেই কাশ্মীর তাদের আত্ম নিয়ন্ত্রনের অন্তর্দহে জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছে। এইতো গত শতকের শেষ ভাগে ইউরোপের একটি বলিষ্ঠ রাষ্ট্র তাদের জাতিগত অন্তর্দন্দ্বে কয়েক টুকরো হওয়ার পরেও ধর্মীয় জটিলতায় আরো কয়েকটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিল। এই বিচ্ছিন্নতার করতলে লুটোপুটি খেয়ে কত যে লক্ষ কোটি আদম সন্তানের প্রান বিসর্জন দিতে হয়েছে তার হিসেব দেখলে মানব সন্তান হিসাবে আমাদের লজ্জা ও ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা দিতে পারে।
এভাবেই ধর্মীয় ও জাতিগত অন্তর্কলহ সৃষ্টি করে মোড়ল মাত্ববরীয় আদলের বৃহৎ শক্তিসমূহ নিজেদের কর্তৃত্বের জাল বিস্তার করে আজ দুনিয়াতে তাদের রাজ কায়েম করে রেখেছে। অর্থ বিত্ত অস্ত্র যেখানে যেরকম প্রয়োজন সেভাবেই বিনিয়োগ করে তারা নিজস্ব স্টাইলে পৃথিবীতে একটা অস্থির আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। হয়তো বলা হবে- উন্নয়ন, শান্তি ও প্রগতির আলোকছটা চারিদিকে টলমলে স্বচ্ছ্বতায় স্ফুরিত। তারপরেও কেন এত অনুযোগ অভিযোগ। সত্যিই তো তাই। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে মঙ্গলে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও তো কৃত্রিম প্রতিযোগিতা। মানুষ খেতে পাক আর না পাক, মানবেতরে জনজীবন আহাজারিতে ছিন্নভিন্ন হোক তাতেও আপত্তি নেই, কিন্তু ও মঙ্গলে গেলে আমি কেন চাঁদে যাব না। ওর বোম থাকলে আমার কেন হবেনা। এধরনের হাজারো অসম প্রতিযোগিতায় আজ ধরাধাম বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ফলে প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই গর্জে উঠছে। প্রকৃতির প্রতিশোধে জনপদে হাপিতেশ আহাজারির রোল পড়তে শুরু করেছে। হাড় কাঁপানো শীতের দেশে এখন গ্রীষ্ম মন্ডলীয় উত্তাপের রেশ। ঘন ঘন দাবানল আর টর্নেডো হ্যারিকেনে তাদের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আবার গ্রীষ্ম মন্ডলীয় জনপদে উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ ঝড় বৃষ্টি বন্যা আর ঘুর্নিঝড় জলোচ্ছ্বাসের অনিয়মিত তান্ডব, সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।
তাহলে কি দুনিয়ার আয়ু শেষ হতে চলেছে! পবিত্র ঐশী গ্রন্থের ভাষ্যমতে সেসবের লক্ষ্মনই তো ভেসে উঠছে। তারপরেও বেঁচে থাকার তাগিদে, জীবনকে স্বচ্ছ্ব সুন্দর ও গতিময় করার মনোস্কামনায় আমরা কতই না করে যাচ্ছি। আমাদের জানার শেষ নেই। প্রতি নিয়ত নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে এগিয়ে চলার উদগ্র বাসনায় পৃথিবী জুড়ে চলছে অসম প্রতিযোগিতার তান্ডব নৃত্য। কর্ম যজ্ঞের এই অসম দৌঁড়ে কোথাও যেন ব্ল্যাক হোল তৈরী হয়ে আমাদের সর্বনাশের শেকড়গুলিকে পোক্ত করে দিচ্ছে। দুনিয়া জোড়া অশান্তি অসহিষ্ণুতা এবং অবিশ্বাসের মাশুলে আমরা পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা কৃত্রিমতাকে আঁকড়ে ধরে দুনিয়ার আপাত: চাকচিক্য, ক্ষমতা ও বৈভবের মোহজালে জড়িয়ে গেছি। স্রষ্টা প্রদত্ত আশরাফুল মোখলুকাতের জন্য নির্দেশিত গতিপথ ভুলে আমরা জাগতিক স্বেচ্ছাচারিতায় স্রষ্টার সৃষ্টিকে নিজেদের মত করে সাজাতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খাচ্ছি। ফলে প্রকৃতির প্রত্যাঘাতে আমরা হর হামেশাই জর্জরিত হচ্ছি। তাইতো আশংকা জাগে, আমাদের বাসযোগ্য দুনিয়ার গতিপথ ঠিকপথে আছে তো?