জালাল উদ্দিন আহমেদ
খাতনা দিয়ে শুরু করতে হবে
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:০০ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আদল বদলাতে হবে। এই আদল সেই আদল নয়। অনেকে বলবেন সিস্টেম চেঞ্জ করতে হবে। হয়তোবা তাই! ইংরেজীর Change আর Transfigure এর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ছোট বেলায় অর্থাৎ HS লেভেলে রসায়ন পড়ার সময় এই পার্থক্যটা বেশ ভাল ভাবেই শিখানো হয়েছিল। এই যে শিখানোর কথাটি উচ্চারন করলাম, এটার গুরুত্ব জীবন জিগ্যাসার প্রতিটি স্তরেই আমাদের শিখতে হয়। এটা আমরা দেখেছি। একজন কৃষক যখন লাঙ্গলের হাল ধরেন বা একজন মাঝি নৌকার বৈঠা হাতে নদীতে পাড়ি দেন তখন এসব কাজের বেসিক শিখেই তাদেরকে মাঠে বা নদীতে নামতে হয়। ছেলেটি প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েই হাইস্কুলের চৌকাঠে পা দেয়। অর্থাৎ জীবন জিগ্যাসার প্রতিটি স্তরেই মানুষকে কৃচ্ছ্বসাধন করে পরীক্ষার মাধ্যমে সফলতার মুখ দেখতে হয়। সমাজের প্রতিটি আঙ্গিনায় এই পরীক্ষা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শাশ্বত কর্মধারাই হচ্ছে সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার আদি সূত্র।
যে উঠান বা আঙ্গিনার ব্যবস্থাপনা বা অনুশীলনের ধারা নিয়ে এতসব ইনিয়ে বিনিয়ে রচনা লিখতে হচ্ছে তার নাম রাজনীতি। এখানে নাম নিয়েই গলদ। এক্ষেত্রে রাজনীতি যে ভাবার্থে ব্যবহৃত হয়েছে তার খোলামেলা ব্যাখ্যা জানতে কি আমদের মন উসখুস করেনা! কিন্তু এই অল্প শিক্ষিত মানুষটার পক্ষে এর যুতসই ব্যাখ্যা দেয়া বেশ দুস্কর। কারন সেই গ্রীক সভ্যতার এরিস্টটল ও প্লুটোদের রাজনীতির সংজ্ঞা বুঝতে হলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের নাড়ির খোঁজে ঢুঁ মারতে হবে, যেটা করা এই অধমের পক্ষে অসম্ভবই বটে। রাজা নেই রাজ্য নেই অথচ রাজার নীতি বা রাজনীতি নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা। সেটা তো জননীতি লোকনীতি গননীতি বা নিদেনপক্ষে রাষ্ট্রনীতি নাম নিয়েই সামনে আসা উচিত ছিল। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এটা যেন সেই বৃটিশদের রেখে যাওয়া বিলাতি সাবান বিলাতি বিস্কুটের মতই হবে হয়তো। রোম্যান সাম্রাজ্য বা সেইসব প্রচন্ড প্রতাপশালী রাজা মহারাজাদের নগর কেন্দ্রিক পলিস ট্রিকস থেকে এসেছে পলিটিক্স। অর্থাৎ শহুরে মন্ত্রনা। তবে রাজনীতিটা সম্ভবতঃ ইবনে সিনার সিয়াসত নামক কথাটির যুতসই সমাধান হতে পারে। তিনি বলেন বিষয়াবলীর ব্যবস্থাপনা করাই হোল সিয়াসত বা নীতি বা রাজনীতি। এখানে বিষয়বলীর ব্যাখ্যা বেশ বিস্তৃত। আরব দেশ সমূহে রাজতন্ত্র থাকলেও সংবিধান মেনে গনতান্ত্রিক আচরনের ভোটাধিকার ইত্যাদির প্রচলন সেখানে আছে বা ছিল। যদিও তা সীমিত সংখ্যক জনগোষ্ঠী কেন্দ্রিক ছিল। তবে জনপদের মতামতের গুরুত্ব আংশিক হলেও ছিল। আবার লেলিনের মতে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার ঘনীভূত বহিঃপ্রকাশ হোল রাজনীতি। ডেভিড ইস্টন বলেন কোন সমাজের মূল্যবান বিষগুলোর গুরুত্বপুর্ন সুষম বন্টন রাজনীতির মাধ্যমে সমাধান করা হয়। ফাইরুজ আব্বাদি একজন বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি বলেন রাজনীতিবিদ বা শাসকেরাই রাজনীতি ও শাসনতন্ত্র নিয়ন্ত্রন করেন। আবার তারাই এটা ধ্বংস করেন।
সংজ্ঞা ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ যদি উপরের অনুচ্ছেদের শেষের কথাটিকে আলোকিত করে তাহলে সেটা গ্রাম্য কথ্যের সেই রম্য বাক্যটির কথা মনে করিয়ে দেয় না কি? রাম বাবুর বাগানের আম খুব মিষ্টি। আবার সেটাই যদি প্রায়োগিক আচরনে আম বাবুর বাগানে রাম খুব মিষ্টি হয়ে ঘোট পাকায়, তখন সেই মিষ্টি রাম আপনার সর্বনাশের কোন্ সিঁড়িতে অবস্থান করে, তার ঠাহর পেতে আপনাকে সহস্র যুগ লাটিম ঘোরার মতই ঘুরতে হবে। সুতরাং এরিস্টটল প্লুটোরা কি বলেছেন সেটা মুখ্য নয়। বরং তাদেরকে ধারন করে রথী মহারথীর আজকের রাজনীতির অব্জেক্টগুলি কি করছেন সেটাই ধর্তব্যে নিয়ে কথা বলতে হবে। চৌদ্দ'শ বছরের অধিক কাল হতে ভূমিষ্ট হওয়ার পর কানে আযান দিয়ে মুসলমান ঘোষনা করার সিস্টেমটা বদলানোর সময় কি এখনও এক্সপায়ার করে নি? খাতনা দিলেই যদি মুসলমান হওয়ার পর্বটা শেষ হয় তবে পবিত্র কোরান বা হাদিস ইত্যাদির মহা মুল্যবান বার্তাগুলি নিয়ে কেন এত এত তাবলীগ তাফসিরের এন্তেজামে মুসলমানেরা উদ্বিগ্ন থাকেন! একজন মনুষ্য মানব শ্রী রামচন্দ্র যখন তার তীর ধনুকের অতিমানবীয় শক্তিবলে শত্রু বিনাশে অপ্রতিদ্বন্দী হন তখন জঙ্গল বেষ্টিত বন বাদাড়ের অসহায় প্রান্তিক মানুষগুলির কাছে তিনি নমস্য পুজনীয় দেবতায় পরিণত হন। কালের ঢেউয়ে দোল খেয়ে তিনি রাজনীতির বড়ি সেজে এখন একটি রাষ্ট্র বেষ্টিত জন জাতির ভগবানের ত্রানকর্তায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনীতির শিক্ষা এতই ঠুনকো নয় যে বিশ্বময় ঘৃণিত ও বিতাড়িত একটি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্ত্ব স্থায়ীকরনে অন্য একটি সভ্য জাতির হৃৎপিন্ড খুবলে খামচে ছিন্নভিন্ন করে সেই মাটিতে তাদের অস্তিত্ত্বের ভিত গড়বেন। আর এসব করার জন্য সভ্য জগতের মোড়ল বলে খ্যাত পড়শীরা তাতে মদদ দিবেন।
রাজার নীতি রাজনীতি এখন তার রঙ হারিয়েছে। রাজনীতির রাজ বা হাল ধরার জন্য মানব সভ্যতার জনপদে সৃষ্টি হয়েছিল রাজা বাদশা সুলতান বা কিং এম্পারার। সেই রাজা বাদশাহীর একছত্রতা উৎপাটনে দেশে দেশে শুরু হোল জন সম্পৃক্ততার সার্বিক আয়োজনের রাজনীতি। সেখানেও বহুমাত্রিকতার পদচারনা। এবং এটাই শাশ্বত। সেই শাশ্বত সূত্রের পথ অনুসরন করে বহু মত ও পথের অনুসন্ধানে মানুষ বা জনপদে সৃষ্টি হোল ডান-বাম উদার-কট্টর ইত্যাদি ঘরানার রাজনৈতিক উঠান। এভাবেই যুগে যুগে অনুশীলনের মাধ্যমে মানব সমাজের যুথবদ্ধতায় আত্মপ্রকাশ করেছে রাজনীতির গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নামক দুটি মত ও পথের রাজ। এখানে রাজ অর্থ ভূখন্ড বেষ্টিত শাসন ব্যবস্থার আদল। ভূখন্ড বেষ্টিত জনগনের স্বাধীন মত প্রকাশের মধ্য পন্থার গনতান্ত্রিক অনুশীলনে আজকের পৃথিবী তার সমৃদ্ধির পসার সাজিয়েছে। কিন্তু এই আয়োজনের অনুশীলনের ফাঁক গ'লে আম যখন রাম হয়ে ডান-বামের ছকে না থেকে উপরি কথিত ধর্ম ও মাসলকে সামনে রেখে এগোতে চায় তখন অনিয়মের হাজারো ঢিপি তৈরী হয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রে ক্ষয়িষ্ণু বা সিকস্তির প্রাদুর্ভাব ঘটায়। তাছাড়া রাজনীতির গনতন্ত্রে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার প্রাধান্যে যখন রাষ্ট্রনীতির চাকা আবর্তিত হওয়া শুরু হয় তখন সেই রাজনীতি জন গনতান্ত্রিক না থেকে ব্যক্তি প্রাধান্যের বংশ পরম্পরার রূপ নিয়ে তা আদি বা মধ্যযুগীয় আচরনে ফিরে আসে। ইদানীংকালের রাজনীতি চর্চার গনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের যেদিকেই তাকাই না কেন - ধারকদের নৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষয়িষ্ণু আচরনে ধর্ম, দুর্বৃত্তায়ন এবং বংশ পরপম্পরার উঠানে এরা এখন রাজনীতির সহিস। এদের দুর্দমনীয় আচরনে গনতান্ত্রিক এমনকি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্দশার অশনি সৃষ্টি করছে। ফলে ধর্মীয় মৌলবাদী আচরন, মাসলম্যান দাদাগিরির আবহ সৃষ্টি করে সাধারন জনপদে ভীতির সঞ্চার করা এবং বংশ পরম্পরার নেতৃত্বে অবাধ ক্ষমতায়ন - এদেরকে স্বৈরাচারী আচরনের শাসক বানিয়ে জনপদে নাকাল সৃষ্টি করছে।
রাজনীতির এহেন আচরনের আদল বদলানোর সময় এসেছে। সততা, নৈতিকতা এবং মানুষের প্রতি পারস্পারিক সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধের আবহ সৃষ্টি করতে হবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যুথবদ্ধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যক্তি সততা ও নৈতিকতার আবহ তৈরী করতে হবে। রাজনৈতিক স্বচ্ছতার মাধ্যমে গনতান্ত্রিক অনুশীলনের দৃঢ়তা আনয়নে ইদানীং সৃষ্ট দুষ্টক্ষতগুলি পরিহার করে শুদ্ধ রাজনৈতি ও গনতান্ত্রিক অনুশীলনের শপথ নিতে হবে। বাঙালী হওয়ার পাটাতনে চড়ে আমরা আমাদের নিজস্ব আঙিনায় আজ আমরাই রাজা। সুতরাং এই রাজ এবং ভালবাসার রাজা আমাদেরই হোক - এই শপথে আমরা শপথবদ্ধ হই। যে হেমিলিয়নের বাঁশির সুরে আমরা একাত্তরে ইতিহাস তৈরী করে বাঙালীত্বের ছাতিকে শক্ত করেছি সেই বাঙালী ও বাংলাকে ধারন করে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের ব্রত হোক। রবীন্দ্রনাথ কোথায় যেন বলেছেন, বাঙালীর একমাত্র ফ্যাশন হচ্ছে রাজনীতি আর প্যাসন হচ্ছে সন্তান উৎপাদন। আমরা প্যাসনকে এক দুইয়ে নামিয়ে নিয়ন্ত্রন করেছি, আসুন না ফ্যাশনকে ধর্ম, দুর্বৃত্যায়ন ও বংশ শিখন্ডির পরম্পরা থেকে মুক্ত করে শুদ্ধ ও স্বচ্ছ্বতার আলোক বর্তিকায় আলোকিত হই।