জালাল উদ্দিন আহমেদ
গোপালভাঁড় বীরবল গোলাম হোসেন - অতঃপর…..
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৮:২৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দুনিয়ার এটাই বুঝি রীতি। এই রীতির ঘোড়-সওয়ার হয়ে পৃথিবীতে বড় বড় রথী মহারথীর আবির্ভাব হয়েছে। এদেরই বয়ানে সীমানা বেষ্টিত ভূখন্ডে যুগ যুগান্তে চালকে ডাল, ডালকে মধু, মধুকে ঘি বানিয়ে রান্নাবাড়ির ব্যঞ্জন তৈরী হচ্ছে। এরা পরজীবি স্বর্ণলতার ন্যায় তরতর করে লিকলিকিয়ে বেড়ে উঠে। আবার অসময়ের কোপে পড়ে বস্তি নিবাসী মানবেতরেও খাবি খায়। এরা তাদের লব্ধ জ্ঞানকে স্বার্থ চরিতার্থের কুপন হিসাবে ব্যবহার ক’রে সাধারন জনপদে উচ্চ লয়ের হিন্দোল তুলে ফানুস উড়িয়ে দেন। আবার সেই জ্ঞানের কালিদাসীয় অপপ্রয়োগে পরম প্রতাপের শাসক গোষ্ঠীকেও মাঝে মধ্যে একচোখা দৈত্য বানিয়ে জনপদে হাহাকার সৃষ্টিতে মুখ্য পরামর্শক হিসাবে আবির্ভূত হন। তবে এসব ঘটে সাধারনতঃ তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র বেষ্টিত গনতন্ত্রের ধ্বজাধারী বর্ণচোরা রাজনৈতিক শাসনের দেশ সমূহে। ক্ষমতা লিপ্সু এসব নীতিহীন রাজনীতির শাসকেরাই তাদের নিজ প্রয়োজনে এধরনের শিক্ষিত স্তাবক বানিয়ে আম জনতাকে উড়নচন্ডী বানাতে তাদের কাজে লাগান। এরা রাজ যোটক সেজে দেশের মেরুদন্ডে এমন সব অগ্নিবানের তীর ছুঁড়েন যা থেকে ফিরে আসতে হলে অনেক সময় জনপদে রক্তক্ষয়ী যবনিকায় পরিত্রান পেতে হয়। সুতরাং এই শ্রেনীর মানুষজনদের নিয়ে ভাবিত হওয়ার কারন আছে বৈকি!
আমরা গোপাল ভাঁড়ের নাম শুনে এবং তার রাজ মন্ত্রকের ভূমিকা দেখে পুলকিত হই, উচ্ছ্বসিত হই, হাস্যরসে উদ্বেলিত হই। রম্য রচনার এই সর্বকর্মা মানুষটি প্রকৃত অর্থে প্রাচীন কালের কোন রাজ দরবারে সভাসদ বা মন্ত্রনাদাতা ছিলেন কিনা সেটা ইতিহাসের বিচার্য বিষয়। তবে এদের যুক্তিতর্কের বিচক্ষনতায় রাজকার্য সম্পাদনে গতি সঞ্চারিত যেমন হোত, পাশাপাশি ক্ষমতার সুপ্রিমো সেই রাজদন্ডের কর্তা মশাইও যে প্রীত ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন তা গল্পাকারে প্রকাশিত সেসব বই পুস্তক থেকে বুঝা যায়। মধ্যযুগের মোঘল বাদশাহীর সেই বীরবলের চিত্রিত চরিত্রের অনেক গল্প কাহিনী আমরা পড়েছি। সবজান্তা ও সর্বকর্মা সেই বীরবলের সভা মন্ত্রক হয়ে শাহী দরবারে বাদশাহ নমদরের বিশ্বাসভাজন হয়ে ছড়ি ঘুরানোর গল্প কাহিনীও আমরা কমবেশী জানি। রাজ দরবারে তার অবাধ ও যৌক্তিক আলাপচারিতায় তিনি সকলের প্রিয়ভাজন না হতে পারলেও রাজদন্ডের মহাধিরাজের অধিক নির্ভরশীলতায় তিনি ছিলেন রাজ মন্ত্রকদের শিরোমনি। পরবর্তী পরম্পরায় বাংলার শেষ নবাবের গোলাম হোসেনের কেচ্ছা কাহিনীও আমাদের জানা আছে। অর্থাৎ এই বীরবল গোলাম হোসেনদের সপ্রভ উপস্থিতি দেশের ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুর জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগান্ত ধরে।
আধুনিক প্রযুক্তির এই স্মার্ট সময়গুলিতে সেই রাজ দরবারও নেই, নেই কোন প্রকাশ্য রাজ সভাসদের বীরবলীয় আচরন। তবে শাসন যন্ত্রের অতি রাজনীতির তঞ্চকতায় গোলাম হোসেনীয় আচরন এখন সমাজ রাষ্ট্র ও সংসার জীবনের প্রতিটি কোনে কোনে ঘাঁটি গেড়েছে। ঊনবিংশ থেকে বিংশ এমনকি এই আলো ঝলমলে একবিংশের উঠানে এখন গোলাম হোসেনদের গোলামীয় আচরনে বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় তাদের যুক্তি-তর্কের অতিকথন এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় অতি পান্ডিত্যের চেতনা নাশক লেখনীর তোড়ে সাদামাটা বাঙালীর উঠান আজ বিষাক্ত বায়বীয় আচরনে খাবি খাচ্ছে। তদের আয় রোজগারের উন্নতিসহ দিনকাল বেশ ভালই যাচ্ছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার খিস্তি খেউড় মার্কা চ্যানেল গুলিতেও তাদের সপ্রতিভ উপস্থিতিই বলে দেয় থার্মোমিটারে ঢুকানো পারদ আসল না নকল। এই থার্মোমিটারের পারদের উপস্থাপনার মাজেজাটা একটু খোলাসা করা দরকার। মাস ছ'য়েক আগের কেনা একটা থার্মোমিটার হঠাৎ করে চোখে পড়ায় আমার বেটার হাফ তা ব্যবহার যোগ্য কিনা সেটা পরখ করতে চাইলেন। কিন্তু বিধি বাম। থার্মোমিটারের পারদ সেই যে শীর্ষ বিন্দুতে উঠে বসে আছে তার আর কোন নড়ন চড়ন নেই। অগত্যা আমার কাছে যখন নিয়ে আসা হলো এর সুরাহা চাইতে তখন আমার কলম খুঁজছিল এদেশের বুদ্ধিজীবি নামক মাথা বেঁচে পেট চালানো সেইসব স্বর্ণ কমলদের। মিলিয়েও ফেললাম সাথে সাথে। মাথায় পারদ চড়িয়ে চাঙ্গে উঠা এই অকেজো থার্মোমিটারটি সত্যিকার অর্থেই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে গজিয়ে উঠা বুদ্ধিবৃত্তি করে ফেরি করা আঁতেলদের মত নয় কি? বিদ্যা শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে মাথায় এ ও বি এর পারদ চড়িয়ে তাদের বলা ও লেখার পান্ডিত্যে আজ আমরা আম জনতা দিশেহারা - উদ্ভ্রান্ত।
দেশে একচক্ষু দৈত্যের দানবীয় শাসন চলছে। শাসন চক্রের হাতকে পোক্ত করার বেড়া জাল সৃষ্টি করে দেশে বিছানো হয়েছে আইনের চাদর। সেই চাদরের ফুল বিছানার ফুলেল সুবাসে অবগাহন করে বাংলার জনগন আজ সমুদ্র বিজয় করে মহাকাশেও তার উপস্থিতির জানান দিয়েছে। তারা তাদের বৈদেশে লেবারগিরি করে মানবেতরে জীবন কাটানো মানুষগুলোর পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানী আয়ের ডলার জমিয়ে জানান দিয়েছে তাদের রিজার্ভের সবলতার কেচ্ছা কাহিনী। তারপরেও বাঙালী বলে কথা। যেখানে গোপালভাঁড় গোলাম হোসেনদের কদর বেশী সেখানে আমির হামজাদের সোনার মুকুট পরাটাই তো শোভনীয়। সম্মানিত আসফ উদ দৌলা স্যারের একটি কথা বেশ মনে পড়ে। তিনি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপাল গঞ্জেরই মানুষ। আবার ঘটনাচক্রে তিনি বংশ পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়ও বটে। সেই তিনি বৃটিশ বাংলায় তার বেড়ে উঠার কাহিনী বলতে গিয়ে বলেন, তিনি জীবনে কোন পরীক্ষায় প্রথম বৈ দ্বিতীয় হন নি। অথচ স্কুলের খাতায় তার নাম লিখা হোত দ্বিতীয় নম্বরে। পুর্ব বাংলায় বাঙালী হয়ে বেড়ে উঠার সেই জ্বালায় তিনি এখনো পুড়েন। ঘুঁটে পুড়লে গোবর হাসের এই প্রবাদটির যথার্থতা তখনো ছিল এখনও আছে। এই যে শিক্ষা ব্যবস্থার খোল-নলচে পাল্টে দিয়ে এখানে খিঁচুড়ি রান্না বা উঠান ঝাড়ু দেয়া শেখানোর মহা এন্তেজাম চলছে, এতে কিন্তু অতি ভক্তির প্রকাশ্য অবজেক্ট সম্মানিত জাফর ইকবাল স্যারই একতরফা বকাঝকা খাচ্ছেন। অন্দরের প্রধান কুশীলবরা কিন্তু আন্ টাচ অবস্থায় ওই ঘুঁটে গোবরের সমান দূরত্বেই,, অবস্থান করছেন। এদিকে রাজনীতির শিরোমনিদের বগলদাবা করে রাখা বীরবল বা গোলাম হোসেনরা সমাজ ও রাষ্ট্রে হাজারো বীরবল তৈরী করে ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক মিডিয়ায় তাদের মাধ্যমে এক হজবরল অবস্থা সৃষ্টি করিয়ে রেখেছেন। যেন সাগর সেঁচে অমৃতের সন্ধানে অবগাহন করছেন তারা।
যুগে যুগে এই বীরবল গোলাম হোসেনরা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাদের ঔজ্জ্বল্যের ঝঁপি খুলে আপন বৈভবে বিচরন করেছেন। তবে সমসাময়িক বিচরনে তারা আরো উজ্জ্বল হয়েছেন। শাখা প্রশাখার জাল বিস্তার করে তারা এখন রাষ্ট্রের শেকড়ে পৌঁছাতে চাচ্ছেন। হয়তোবা ক্ষেত্র বিশেষে পৌঁছেও গেছেন অনেকে। এটা নিয়ে ভাববার সময় কি আসেনি? আর ভাববেই বা কারা। যাদের ভাবার কথা তারাই তো এসবের পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। এ লাইন ভাঙ্গবে যারা তারাও তো ক্ষমতার কুরসি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কামরূপ কামাখ্যায় ছুটাছুটি করছেন। পাঠক, কোন এক সেনা প্রধানের “ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দা হাঁটিয়া চলিল”র সেই ঘটনাটি নিশ্চয় মনে থাকার কথা আপনাদের।