জালাল উদ্দিন আহমেদ
সাতের সাতকাহন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:৪৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
আমি কোন নির্বাচন পর্যবেক্ষক নই। কিংবা এসব নিয়ে পর্যালোচনা করার ক্ষমতাও আমার নেই। ৬ জানুয়ারী রাত দু'টা আড়াইটা পর্যন্ত জেগে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাবলাম, কালকে একটু দেরী করে ঘুম থেকে উঠে বারটা একটার পর বের হব। কিন্তু তা আর হোল কই? সাত সকালে মেয়ের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গলো। ‘'আব্বু, তাড়াতাড়ি উঠ। ভোট দিতে যেতে হবে। তাছাড়া তুমি পাড়ার মুরুব্বি। একজন সিনিয়র সিটিজেন। ভোট দাও আর না দাও কিন্তু ভোটকেন্দ্রে তোমার উপস্থিতি তোমাকে সম্মানিত করবে। সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হবে, তোমার ভাল সময় কাটবে ইত্যাদি ইত্যাদি।’ মেয়ের এই যুক্তিটা খারাপ মনে হোল না। ছেলে মেয়েরা নিজের নিজের বাসায় থাকে। সুতরাং বুড়িটাকে নিয়ে বেরোতে বেরোতে বারটা বাজলো। দু'শ মিটার দুরেই মেয়েদের স্কুল। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে এই স্কুল। এখন তো কলেজ নামটিও দেখছি। অর্থাৎ কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ। মজার বিষয় হোল এই স্কুলের প্রথম ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল আমার সহধর্মিনী। সুতরাং তার সাথে তার স্কুলে যাওয়াটা একটা আলাদা স্পেস দেয় আমাকে। তাছাড়া পুরনো পিয়ন দারোয়ান থেকে শুরু করে অন্যান্য স্টাফদের আলাপচারিতায় আমার স্ত্রীও বেশ উপভোগ করে সময়টা। তাছাড়া মহল্লার স্কুল এবং চোখের সামনে তার বেড়ে উঠার চিত্রটাও তো বেশ সাজানো গল্পের মত।
সেই কিশলয়ে এই সত্তোর্ধ অবসরের যুবক যুবতী ভোট উপলক্ষে যাবে সেটা নির্ধারিতই ছিল। এই ট্র্যাডিশন তো সেই ১৯৭৭ থেকেই চলে আসছে। তাছাড়া স্নেহ প্রতীম অনুজ এবং আমাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলুর গত চার পাঁচদিন আগে থেকেই টেলিফোনে রেকর্ড করা ভোট প্রার্থনার আকুতি আমি কেমন করে অগ্রাহ্য করি! তিনি তো আবার আমাদের এই ওয়ার্ডের আওয়ামী সভাপতি। এদিকে পাশের বাড়ির শ্রদ্ধেয় আসগর চাচার মেজ ছেলে আলমগীরও আওয়ামী ওয়ার্ড সেক্রেটারী। অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমাদের ওয়ার্ডে বিএনপির সভাপতি সেক্রেটারী কে বা কারা সেটা গত পঁয়তাল্লিশ বছরেও চোখে পড়েনি। এটাই বাস্তবতা। এটা নিয়েও হয়তো রচনা লেখা যাবে কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে আজকের ভোট। সুতরাং এটাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।
ভাগ্য ভাল যে একটু আগেই গেছিলাম। নইলে ওদের প্রস্তুতির নির্ঘন্টে আমার বাসায় আসার হিসাব নিকাশও হচ্ছিল বলে শোনা গেল। ভোট কেন্দ্রের মূল গেটের পঞ্চাশ মিটারের মধ্যেই নৌকার বুথ। সেখানে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওয়াদুদ ভাইয়ের হাঁকডাক। ‘আগে ভোটটা দিয়ে এস পরে কথা হবে। স্পেশাল চা সিঙ্গাড়ার ব্যবস্থা আছে’। দলবল নিয়ে স্কুল গেটে আলমগীর দাঁড়িয়ে আছে। উষ্ণ অভ্যর্থনা নিয়ে স্কুল প্রিমিসেসে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি সবাই চেনা পরিচিত পাড়ার মানুষজন। তবে তরুন যুবাদের সালামের আধিক্যে নিজেকে অন্য উচ্চতায় ভাবতে থাকলাম, যদিও তাদের ৫০% কেই আমি চিনতে পারলাম না। আমার ছোট মেয়ের বড় ছেলেটাই তো এখন ও লেভেলের ছাত্র। সুতরাং বয়স ও সময়ের স্রোত কত দ্রুত এগিয়ে চলছে তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা ফুটে। তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। প্রিজাইডিং অফিসারকে নিজের পরিচয় দিয়ে ভোট কাস্টিংএর হিসাব এবং পরিবেশ পরিস্থিতির বিষয়টি জেনে নিলাম। সবই পজিটিভ মনে হোল তবে ভোট প্রদানের পার্সেনটেজ দশের উপরে দেখাতে পারলেন না। ভোট দিয়ে বেরোতেই দেখি আমার অর্ধাঙ্গিনী ভোট দিয়ে স্কুলের মধ্যমাঠে শীতের মিষ্টি রোদের অবগাহনে বুড়োটার ফেরার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রী বাসায় ফিরতে চাইলেও আমি তাকে নিয়ে একটু অলিগলি হাঁটলাম। এবং সেখানেই আমার নির্বাচন পর্যবেক্ষনের কিছু প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম বোধ হয়।
আবাসিক এলাকার প্রত্যেকটি বাড়ি এখন এক একটি বস্তি। একটি বাড়ি যদি দশতলা হয় তবে তার ফ্লাট সংখ্যা জায়গা ভেদে ৩০ থেকে ৪০ টি। তবে সাততলার ডাবল ইউ ইটের ফ্লাটই বেশী। লক্ষ্য করলাম বড় বড় ফ্লাটের সামনে যুবক যুবতীদের জটলা। অনেককেই চিনি আবার অনেকেই আমাকে চিনে। আগ্রহ নিয়ে দুটি স্পটে ওদেরকে হালকাভাবে জিগ্যেস করাতে স্পষ্ট উত্তর না পেলেও হালকা মাথা নাড়াতে দেখলাম। কি ব্যাপার! তোমরা এ বাড়ির সামনে খাতা কলম এবং ভোটার লিষ্ট নিয়ে জটলা করছো কেন? নাহ! এখানে তো এতগুলো ফেমিলি। কারা কারা দিল কারা দিলনা এটা নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু কেন? তোমরা তো ব্যাচধারী। একটি পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছো। এটা কি তোমাদের কাজ। তাছাড়া ভোট ক্যাম্পেইনিং তো দুদিন আগেই শেষ হয়েছে! ওসব আপনি বুঝবেন না আংকেল। এখন প্রশ্ন হোল এরা কি ভোটারদের তাগিদ দেয়ার জন্য এভাবে বাড়ি ধরে ধরে তাবলিগ করছে না কিছুদিন আগে ভাউরাল হওয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরের হিসাব মোতাবেক ভোটারদের হুমকি ধামকি দিয়ে ভোট দিতে বাড়ি থেকে টেনে বের করছে - সেটা যাঁচাই করার সৎ সাহস আমার হয়নি। তাছাড়া বিকাল তিনটা পর্যন্ত সারা দেশের ভোট কাষ্টিং যেখানে ১৭ থেকে ২০এ সীমাবদ্ধ ছিল, হঠাৎ করে এক ঘন্টার ভোটে সিইসি কর্তৃক সন্ধ্যা সাতটায় ৪০% এ কিভাবে লাফ দিল সেটাও ভাববার বিষয় বৈকি! সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দুজন লোক্যাল ইলেকশন পর্যবেক্ষকের কথা শুনছিলাম। একজন তো বলেই ফেললেন, সব ঠিক আছে কিন্তু এই ৪০%, সেতো একটি গ্রুপ ও মতের মতদান। তাহলে বাকীদের মতামত বা মতদানের খবরের হিসাব কে করবে। তারা কি ভোট ভোটাধিকার, এসবের আওতাধীন নয়? এক সময় কথার ফাঁকে পর্যবেক্ষকদের একজন তো বলেই ফেললেন রেজাল্ট শীটের আগাম তৈরী করে রাখার কথা। সাত তারিখ গত হওয়ার পর গভীর রাত পর্যন্ত পর্যবেক্ষকদের আলোচনা ও নিউজ ফ্ল্যাশ শুনে বা দেখে যা বুঝলাম তা হোল বিকাল তিনটার মধ্যেই প্রিজাইডিং অফিসাররা হুকুমের রেজাল্ট সীট বানিয়ে ফেলেছেন। পরবর্তী এক ঘন্টার ভোট দানের উলম্ফন দেখার সময় তাদের দেয়া হয়নি।
এতক্ষন যা বললাম বা লিখলাম তা স্রেফ সাদামাটা একটা আলোচনা। যে চিত্রটি তুলে ধরলাম, এরকম আরো বহুবিধ চিত্র এই নির্বাচনের আজকের দিনকে ঘিরে রচিত হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত রূপ নিয়ে বহুমুখী চরিত্রের আবরনে যদি বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রীয় মেকানিজমকে কয়েকটি প্রশ্ন করি তাহলে এই কর্মযজ্ঞের কুশীলবরা এর সামাধান দিতে পারবেন কি?
১। বিভিন্ন খবর ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাইর্যাল হওয়া খবরের ভিত্তিতে আমি যদি একজন খেটে খাওয়া দিনমজুর বা প্রান্তিক কৃষক হই, কিংবা ভারে আমি যদি এখন সরকারী প্রনোদনার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কার্ডধারী হই ; তাহলে ওইসব বৃদ্ধ সিনিয়র সিটিজেনদের অনুকুলে দেয়া সরকারী সনদ ভোটে অংশ নেয়া মানুষজনরা জমা নিয়ে নিজেদের কাছে রাখতে পারেন? তারা কি বলতে পারেন ভোট দেয়ার প্রমান পেলে ভোটের পরদিন এসব ফেরত দেয়া হবে! নইলে তা বাতিল করা হবে। প্রকাশ্য জনসভা শেষে দলীয় ক্যাডারদের পঞ্চাশ এক'শ জনের গ্রুপ হেড করে দেয়ার মাধ্যমে পাঁচ'শ একহাজার টাকার নগদ দিয়ে প্রত্যেককে ইন্ডিভিজুয়্যাল অংকের স্লিপ দিয়ে বলা হয় ভোট পরবর্তীতে মাসোহারা হিসাবে এটা চালু থাকবে। এবং ওই টোকনটি হচ্ছে তার টিকেট বা গেটপাশ। গ্রাম বাংলায় ভোটকে কেন্দ্র করে আরো বহুবিধ ঘটনা ও দৃশ্যের সুত্রপাত হয়েছে যা আমাদের অগোচরেই থেকে যায়। গ্রামের প্রান্তিক কৃষকের ঘরে এই নির্বাচনকে সামনে রেখে কিসব অমানবিক ও পাশবিক আচরনের ঘটনা ঘটে এসব কথা লিখিত বাক্যে বর্ননা করাও দুঃস্বপ্ন মনে হয়। বিশেষ করে যার ঘরে স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে কিংবা বিবাহযোগ্য মেয়ে বিরাজমান থাকে।
২। শহরের মানুষজন তো কিছুটা হলেও আবহাওয়া বুঝে পা ফেলতে পারে কিন্তু গ্রামের কাদামাটির মানুষ যতই শিক্ষিত আর পরিপাটি হোক না কেন, সত্য কথাটা সরলভাবে বলেই তারা একটু হলেও হালকা হতে চায়। এবং তাদের স্বীকোরক্তির ধরন এতই ভয়ানক যে, তা শুনলে চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। গত পনের বছরের চলমান শাসনের রোজনামচায় এটা স্বতঃসিদ্ধভাবে সাধারন মানুষের মধ্য হতাশা ছড়িয়েছে যে, সরকারী চাকুরী এবং অন্যসব সরকারী সুবিধা প্রাপ্তিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজটি আগেই করে নেয়া হয়। পরবর্তীতে শীর্ষ বিন্দুর সন্তুষ্টি সাপেক্ষে সেই প্রাপ্তিটি আলোর মুখ দেখে। এটা অবশ্য শোনা কথা। কিন্তু যা রটে তা কিছুটা হলেও ঘটে। এই প্রবাদ তো জন্মের পর থেকেই শুনে অভ্যস্ত আমরা। আজকে যেটা শুনলাম সেটাকেই বা রটনা বলি কেমন করে! শ্যামল কমল বিপ্লবদের চাকুরী পাওয়ার গল্পকেও তা হার মানায় বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। সরকারী চাকুরীর একটি ধাপ পর্যন্ত নির্বাচন কাজে পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে কাজ করতে হয়। প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বার চারেক আমাকে এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সুতরাং এই কাজের অঘোষিত চাপের ব্যাপারগুলো আমার বেশ ভালই জানা আছে। যেটা বলার জন্য এতবড় উপক্রমনিকা জুড়তে হোল তার মজেজা হোল, এবার পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসার সিলেকশনের বিষয়টিও ওই প্রি-পুলিশ ভেরিফিকেশনের আদলেই করা হয়েছে বলে জানা যায়। বিশেষ করে মফস্বলের স্কুল কলেজগুলির ভোটিং অফিসার সিলেকশনে বিষয়টি বেশ গুরুত্ব সহকারে পালন করেছেন সরকারী যন্ত্রের নির্বাচনী কুশীলবরা যেন সুনীল বাবুর ‘'কেউ কথা রাখেনি’’র ঝামেলায় পড়তে না হয়।
৩। চিত্রগুপ্তের লালসালু মোড়ানো খাতায় লেখা চিত্রপট পড়ার সময় কি আর যম রাজের হবে! তিনি যা চান তাইই হবে। খাতার লেখা খাতাতেই থাক। নইলে ৭ ঘন্টার ১২-১৭% যখন একঘন্টায় ৪০%এ পৌঁছে যায় তখন সর্বশেষ রেজাল্ট সীটের ৬০-৭০% ভোট নিয়ে নোঙর করা নৌকার মাঝিদের কোন্ হিসাবে ফেলা হবে? তারা তো ঘোষিত হয়ে গেছেন।কি উত্তর আছে এক্ষেত্রে!
৪। কর্মজীবনের ছোট্ট একটি ঘটনার অভিজ্ঞতা দিয়ে যতি টানতে চাই। দেশের চামড়া শিল্প নিয়ে আমাকে প্রচুর কাজ করতে হয়েছে। এ নিয়ে আমার সরকারী প্রকাশনাও আছে। তখন অর্থাৎ ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত এই শিল্পের ভূত ভবিষ্যত নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া হয়েছে। তখন মতিউর রহমান নিজামী সাহেব শিল্পমন্ত্রী হিসাবে চেয়ারে আছেন। কোন এক মিটিংএ (সম্ভবতঃ একনেক সভায়) তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন হাজারবাগে ২০৭ টি টেনারী রয়েছে। কিন্তু বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমার সরকারী রিপোর্টের প্রিন্টেড ভার্সনে তা দেখানো আছে ১৯৪টি এবং সেটাই বাস্তব। একনেক পরবর্তী সময়ে এসব নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে পাঠাতে হয়। মুস্কিলে পড়েছিলাম আমি। টেনারীর সংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে আমি তথ্য উপাত্ত লিখে উপর তলায় পাঠানোর পর যে ঝড় আমাকে সইতে হয়েছে তা যাতে তথাকথিত গনতান্ত্রিক চর্চার এই একবিংশে পোহাতে না হয় তার পাকা এন্তেজামের এই ড্যামি নির্বাচনকে স্যালুট জানিয়ে মহান রাব্বুল আল আমিনের ভাষায় বলতে চাই, কুল্লুমান আলাইহা ফানিও ওয়া ইয়াবক্বা ওয়াজ্বহু রাব্বিকা জুল জ্বালালি ওয়াল ইকরাম। ফাবিআইয়্যি আলায়ি রাব্বিকুমা তুকাযযিবান।