জালাল উদ্দিন আহমেদ
অর্বাচীনের নির্বাচনী ভাবনা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:১৯ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ছোট বেলার স্মৃতিকে স্মরন করেই শুরু করছি। তখন কতই বা বয়স হবে। সাতষট্টি আটষট্টি সালের দিকের কথা। আমার অবস্থান তখন বৃহত্তর বাংলার পশ্চিমাংশে। পশ্চিম বঙ্গে তখন কমিউনিষ্টদের উত্থানের সময়। একদিকে ডাকসাইটে চারু মজুমদার ও কানু সান্যালদের মাওবাদী নক্সালী উপদ্রব অন্যদিকে ত্রিরত্ন হিসাবে খ্যাত তিন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা প্রমোদ দাসগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার এবং জ্যোতি বসুর সাংগঠনিক দক্ষতায় পশ্চিম বঙ্গ তখন বাম জোয়ারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দিল্লির ইন্দিরা ক্যারিশমায় গাই বাছুরের জোয়ার থাকলেও সেসময় ওই বঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকর রায় মশাই টিমটিমে বাতি হয়ে কংগ্রেস ভাঙ্গা গড়ার দুয়ারে খবি খাচ্ছেন। ওদিকে ভারত আন্দোলনের তুখোড় কংগ্রেস নেতা অজয় মুখার্জী বাবু জাতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে বাংলা কংগ্রেস গ'ড়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এভাবেই ভাঙ্গা গড়ায় কয়েকটি বছর পেরিয়েছে। তবে এসময়টা ছিল ছাত্র রাজনীতির স্বর্নযুগ। রাজনীতির ভাঙ্গাগড়ায় তরুন ও যুবশক্তির মধ্যে পছন্দসই প্ল্যাটফরম বেছে নিয়ে নিজেদের তৈরী করার একটি খোলা ময়দান তারা পেয়েছিল। ফলে স্কুল পর্যায় থেকেই ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনেতা বেশ দৃঢ় ভাবেই এগিয়েছিল।
লক্ষ্য করতাম বামপন্থী ঘরানার তরুন যুবারা ছাত্র রাজনীতি করতেন তাদের নিজস্ব আদলের শ্রেনী বিন্যাসের কঠোর শৃংখলা অনুসরনের মাধ্যমে। সেখানে পান থেকে চুন খসলেই সর্বনাশ। ধাপে ধাপে অনুশীলনের কঠোরতায় গড়ে উঠে তাদের নেতৃত্বের শৃংখলিত সিঁড়িগুলি। কিন্তু ডান ঘরানার রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গুলির আবহ অন্য ধাঁচে গড়ে উঠে। সেখানে বাহুবল বাক্যবল এবং অর্থবলের কোন না কোন যোগসূত্রের যোগানে নেতৃত্বের ডালি প্রস্ফুটিত হয়। ব্যতিক্রমী উদ্যোগেও নেতৃত্ব বিকশিত হয় বা হয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে। তবে ডান ঘরানার রাজনীতিতে পরম্পরা বা হেরিডিটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতির কান্ডারী তৈরী করে এগিয়ে যেতে স্বাচ্ছ্বন্দ বোধ করে। সে সময়কার এ বঙ্গে অর্থাৎ পুর্ব বাংলার রাজনীতিও ঠিক সেভাবে যুবা কিশারদের এগিয়ে নিয়েছে বলে ধারনা করা যায়। শাসক চক্রের কঠোর প্রতিবন্ধতা ও নেগেটিভিটি থাকা সত্ত্বেও ছাত্র আন্দোলনের নৈতিক স্বচ্ছতার উপর ভর করে রাজনীতির মূল স্রোত সব সময় সঠিক পথেই এগিয়েছে। ধারনায় যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে এটাও বলতে বাধা নেয় যে রাজনীতির চালিকা শক্তি হিসাবে স্বাধীন ও স্বতঃস্ফুর্ত ছাত্র রাজনীতির অনুশীলন একান্তভাবে অপরিহার্য। যে সময়টা দিয়ে কথা শুরু করেছি, সম্ভবতঃ তখন ছাত্র রাজনীতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শতভাগ ছিল বলেই ধারনা করা যায়। ফলশ্রুতিতে বিগত দশকগুলিতে যুথবদ্ধ নৈতিকতার আলোকে রাজনীতির গনতান্ত্রিক আন্দোলন সমূহ সফলতার হাসি হেসেছে।
বাংলাদেশ তৈরীর সত্তরের সাধারন নির্বাচন ছিল একটি জাতিস্বত্ত্বার কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর ঐক্যবদ্ধ শপথ। সেখানে রাজনীতি গনতন্ত্র অনুশীলনের পাশাপাশি নিজেদের আত্ম স্বীকৃতির একটি প্রচন্ড তাগিদ ছিল। বৈরী পরিবেশ থাকলেও সে সময়টায় রাজনৈতিক সচেতনেতা, স্বচ্ছতা এবং গনতান্ত্রিক মূল্যবোধে অন্ততঃ বাঙালী পক্ষ টনটনে ছিল, এটা ধারনা করে বলে দেয়া যায়। সেক্ষেত্রে রাজনীতির স্রোতে নৌকার একছত্র আধিপত্য থাকায় সেখানেও আধিপত্য বাদের সেই গোয়েবলসীয় ভূতের আঁতুড়ঘর বিরাজমান ছিল কিনা সেটা বিচরন ক্ষেত্রের তৎকালীন আদম সন্তানেরা ভাল বলতে পারবেন। তবে সৃষ্টির আঁতুড় ঘরে কোথাও না কোথাও ছিদ্র ছিল বলেই হয়তো আজকের দিনের দৃশ্যমান আচরনে যতসব গোয়েবলসীয় উচ্চারনের ট্র্যানজিস্টার গুলো উঁকিঝুকি মারার সুযোগ করে নিচ্ছে। নইলে সৃষ্টির প্রথম সূর্যোদয়ের নির্বাচনে ক্ষমতা লাভের শতভাগ নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কোন দুঃখে একজন হিমালয়সম মহান নেতা তার পছন্দের টুপিওয়ালা মানুষটিকে নিজ ক্যাবিনেটে আনার জন্য হেলিকপ্টারীয় নাটকে নিজেকে কলংকিত করবেন! সেই নির্বাচনের কলংক লেপনের খায়েসেই কি সেদিন মহান নেতা এইসব ভোটাধিকার, নির্বাচন নামক বালাই মুছে ফেলে এক জাতি, এক দেশ, এক নেতার ফরমানে সই করেছিলেন? বিষাদময় দিনগুলি পেরিয়ে রাজনীতি ও গনতন্ত্রের পুনঃ তপশিলে এবার শতভাগ ভোটাভুটির স্বাদে গন্ধে ব্যাংলার মাটি ধন্য হোল। পোষাকী আশেকীদের পদভারে বাংলার জমিনে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি যেন কোরবানীর বেচা-কেনা হাটের রূপ ধারন করলো। সবচেয়ে ক্ষতিটা হোল ছাত্র রাজনীতির হেঁসেলে। মেধাবী ছাত্রদেরকে টার্গেট করে নেতৃত্ব ও অর্থকড়ির জোশে সমৃদ্ধ করে দেশীয় রাজনীতির পাইপ লাইনটাই ধ্বংস করে দেয়া হোল। তবুও কিছুটা অবশিষ্ট ছিল বলেই হয়তো নব্বইয়ের গন অভ্যুত্থানে তাদের শক্তিটাকে সামনে রেখে বাংলার মানুষ পোষাকীদের ব্যারাকে ফিরাতে পেরেছিল।
নব্বইয়ের গন অভ্যুত্থানের সুবাসে সাধারন জনগন বুক ভরে শ্বাস নিতে চাইলো। কিন্তু কিসের কি! হেরিডিটির প্রচন্ড উত্তাপে গনতান্ত্রিক চর্চার প্রথম সিঁড়িতেই বাংলার রাজনীতি হোঁচট খেল। ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা নিয়ে গনতন্ত্রে পথচলার একটা হিল্লে হোল বটে তবে পরম্পরার একছত্র বিচরনের একটি নতুন অভয়ারন্য সৃষ্টি করে মাঠে-ঘাটের পোড় খাওয়া রাজনীতির খাঁটি সোনাগুলি অকার্যকর নেতা পাতিনেতার তকমায় শোকেস বন্দী হলেন। অপরদিকে অতি ভক্তির স্তাবকদের প্যারাসাইটিক আচরনের সুযোগ নিয়ে নেতৃত্ব শুন্যতার সিঁড়িগুলিতে হেরিডিটির শিকড় বাকড়দের জায়গা অবারিত হোল। এভাবেই ক্ষমতায়ন ও ক্ষমতা লাভের ধাপগুলি পরম্পরার অবারিত পথচলায় নিরঙ্কুশ হওয়ার সুযোগ করে নিল। আর গনতন্ত্রায়নের রাজপথ সরু গলিপথের রূপ নিয়ে বাংলার রাজনীতি ব্যক্তি ইচ্ছার গনতন্ত্রে প্রকটিত হোল। বাস্তবিক চলাফেরায় বাংলার জনগন এহেন অবধারিত বংশ পরম্পরার অক্টোপাশে নিজেদের ভাগ্যকে গুলিয়ে ফেলে এখন নিজেদের মৈলিক ভোটাধিকারের চাহিদাটুকুও উচ্চকন্ঠে উচ্চারনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু কি তাই! পোষাকীদের পথ অনুসরন করে রাজনীতির তৃণমুলের পাইপলাইন অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতিতে অর্থ অস্ত্র ও দাদাগিরির মন্ত্র প্রোথিত করে অনৈতিক ছাত্র নেতৃত্বের মাধমে দেশে এক নতুন ক্যাডার বাহিনীর সৃষ্টি করা হয়েছে। বিদগ্ধজনেরা হয়তো বলবেন বেপরোয়া গনতান্ত্রিক আচরনের এই সময়গুলিতে অংগ সংগঠনের দোহায় দিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলিকে যেভাবে রাজনীতিতে পৃষ্টপোষকতা করা হচ্ছে, সামরিক লেবাসের সরকারী আচরনে তার সিকি পার্সেন্টও করা হয়েছিল কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সামরিক আধা সামরিক এবং বেসামরিক আচরনের এই গনতন্ত্র ও নির্বাচন করে ক্ষমতারোহনের সরল পথটি এখন সাপ লুডুর খেলায় পরিনত হয়েছে। রাজনীতির নামে ক্ষমতার স্বাদ নেয়া পার্টিগুলি বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষজনের স্বার্থ সংরক্ষনের দোহায় দিয়ে যেভাবে অংগ সংগঠনের বিস্তৃতি ও সম্পৃক্ততা ঘটিয়ে তাদের ক্ষমতারোহনের নির্বাচনকে প্রহসনে পরিনত করেছে - সেতো দিব্য চক্ষেই দেখা যায়। তাছাড়া ইদানীংকালে সরকারী প্রশাসনযন্ত্র ও আইন শৃংখলার উঠানগুলিতেও পার্টিজ্যান রাজনীতির বীজ বপন করে গনতান্ত্রিক পন্থায় দেশ শাসনের নির্বাচনী ব্যবস্থা রীতিমত প্রহসনে পরিনত করা হয়েছে।
তিয়াত্তরের সাধারন নির্বাচন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় মহান নেতা হয়তোবা কিছুটা হলেও অনুতপ্ত হয়েছিলেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন বলয়ের উচ্চাকাংখী, বেপরোয়া ও বিশৃংখল আচরনে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। সে সময়ে তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে আমরা এগুলো অনুধাবন করেছি। তিনি বাংলা ও বাঙালীর ভালবাসার মধ্যমনি ছিলেন বলেই হয়তোবা নিজ জাতি ও জনপদকে শক্তিশালী ও সুরক্ষিত করার খায়েসেই নিজের সারাজীবনের গনতান্ত্রিক আচরনের ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এক নেতা এক দল ও এক দেশ ফরমানে সই করে দেশকে নিজের মত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।পরবর্তীতে বিষাদময় দিনগুলি অতিক্রম করে কক্ষচ্যুত রেল গাড়ি আপন কক্ষে ফিরে এলেও আবারও সেই কক্ষ বদলের পদধ্বনি আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারন রয়েছে। ইতিহাসের সরল পাঠে শুধু এটুকুই জানি ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের নতুন ইতিহাস তৈরীতে অনুপ্রানিত করে। পুরনোর জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য সতর্ক করে। ছাত্রজীবনে ভোটার না হয়েও যেমন ভোট দেয়ার স্বাদ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছি তেমনি পরিনত বয়সে এসে ভোট দিতে গিয়ে ‘ভোট দেয়া হয়ে গেছে’র যন্ত্রনায় বিমর্ষ হয়েছি। পঁয়তাল্লিশ বছরের এই ব্যবধানটুকু শুধু আমার বয়স বাড়িয়েছে কিন্তু সামন্ত আচরনের সেই শতবর্ষীয় প্রভুত্ববাদের ভুতটা আমার মগজেই মিশে আছে। সময় পেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু চেয়ারম্যান মেম্বারীয় সেই অহংবোধের ক্ষমতা সংরক্ষনের গোবরে পোকাটি আমাদের মাথা থেকে বিতাড়িত করতে পারিনি। কারন নির্বাচন নামক প্রতি পাঁচ বছর পর পালা বদলের এন্তেজামে এখনকার সময়ে যা কিছু হচ্ছে, সত্যিকার অর্থেই তা অর্থবহ এবং জনস্বার্থে হচ্ছে কিনা তার মূল্যায়নে আম-বাঙালী কি সম্পৃক্ত হতে পারছেন?