জালাল উদ্দিন আহমেদ
স্মৃতিদীপ - ১
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:০৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মানুষের জীবন চক্র একটি বিন্যস্ত কাঠামোর আবর্তে সীমাবদ্ধ থাকে। পরিবর্তনশীল সমাজ কাঠামোয় যখন মানুষ তার সামাজিক বিন্যাসের স্বচ্ছ্বতা ও শুদ্ধতা আনয়নের চিন্তায় হন্যে হয়ে পড়ে তখন ধুমকেতুর ন্যায় উদয় হয় নতুন নতুন তন্ত্র মন্ত্রের। আর সে সবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন ও তার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে জনপদে বেড়ে উঠা আমাদেরই সন্তান সন্ততিরা। এভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর খোল নলচে ঘষামাজা করে চমক দেয়া কিংবা পাল্টে দেয়ার বিভিন্ন তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে যুগ পম্পরায় আমাদের সামনে হাজির হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের আখ্যান। সেই আখ্যানেরই একটি পৃষ্টায় লেখা হয়েছিল পুর্ব বাংলার সর্বহারাদের জয়ধ্বনির কথা। নইলে কোন কপাল দুঃখে সময়ের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তার জন্য নির্দিষ্টকৃত স্পেস, নিউক্লিয়ার বা এটোমিক সাইন্সের বিষয়াদি ছেড়ে কাদামাটির এটোঘেটু খেয়ে জীবন সংগ্রাম করা মানুষের কথা ভেবে তাদের জন্য জীবন জয়ের মন্ত্র উচ্চারন করে নিজেকে উৎসর্গ করেন।! বলছি কমরেড সিরাজ শিকদারের কথা। ক্ষমাশীল এবং উদার নৈতিকতায় আবিষ্ট বাঙালী সব সময় নিরিবিলি ও নিরুপদ্রব জীবনাচারে অভ্যস্ত। এদেশে সিংহভাগ মুসলমান অধ্যুষিত জনপদ হলেও ইসলামিক সাম্যের আলোয় সমৃদ্ধ মার্কসবাদ লেলিনবাদ তাদের কাছে অনাহূত হয়েই থেকেছে। ইসলামিক বিচার বিশ্লেষনে জীবন ও সমাজ তত্ত্বের সাজুয্যে কমিউনিষ্টদের সাম্যতার কথা ওইসব মানুষগুলির ধর্মবোধের কাছাকাছি অবস্থানে বিরাজমান।
এতগুলো তাত্ত্বিক কথাবার্তার অবতারনা এই কারনে যে ধর্মভীরু মুসলমানের ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে যারা দেশ শাসনের দন্ডটি হাতে তুলে নেন তারা কখনোই ইসলামিক বিধি বিধানের তোয়াক্কায় না থেকে প্রবল প্রতাপশালী শাসক হয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতার শ্লোগানে দেশটাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেন। আবার ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গেলে তখন তারাই ওদের উগ্র মৌলবাদী আখ্যা দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কথা বলেন। আর ধর্মে বিশ্বাসী না হয়েও যারা ধর্মের নির্দেশনাগুলোকে বিন্যস্ত করে এগিয়ে সাধারন জনগনের কাছে পৌঁছাতে চায়, তাদেরকে ডানপন্থী রাজনীতির উঠান থেকে সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে ফেরারী করা হয়। এমনি এক দেশদ্রোহী ফেরারী আসামী পুর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির কমরেড সিরাজ শিকদারের ক্রস ফায়ার পরবর্তী একটি স্মৃতিকাতর ঘটনা আমার মানসপটে এখনো ধ্রুব তারার মত আলোকিত হয়ে আছে।
বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক ক্রস ফায়ারের কথা খুব কম বলা হয়। তবে সেটা রাজনীতির একটা ব্ল্যাক স্পট বলেই হয়তো সচেতন নাগরিকদের অনেকেরই তা মনে থাকার কথা। বামপন্থী মহান নেতা সিরাজ শিকদারের ক্রস ফায়ারে মৃত্যু পরবর্তী কিছু দৃশ্যপটে এই অর্বাচীনের উপস্থিতি ছিল বলেই হয়তো তা না বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড় এবং সলিমুল্লাহ ও শের শাহ সুরী রোড সংলগ্ন জামে মসজিদ মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রীয় মসজিদ। মসজিদ সংলগ্ন খেলার মাঠ, পাশে কবরস্থান এবং তারপাশে ছিল এক টুকরো খোলা মাঠ যেখানে বর্তমানে মাদ্রাসা দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই আমরা ভলিবল খেলার মাঠ বানিয়ে ভলিবল খেলতাম। ফুটবল প্র্যক্টিসটা মর্নিং এক্সারসাইজের পর সেরে নিতাম। বলছি ১৯৭৫ এর জানুয়ারীর প্রথম দিকের কথা। রাজনীতি সচেতন ছিলাম ঠিকই কিন্তু সক্রিয় কর্মী কোন সময় ছিলাম না। সুতরাং দেশের টাল মাটাল অবস্থায় একের পর এক ঘটনা ঘটে গেলেও খেলাধুলা আর লেখাপড়া ছাড়া আর কোন কাজ আমার থাকার কথা নয়। তবে অনুভূতির ইনস্টিনক্টটা বেশ প্রখর ছিল বলেই হয়তো রাজনৈতিক সচেতেনতা বেশ হালনাগাদ ছিল।
সেদিন ছিল জানুয়ারীর তিন তারিখ। সকালেই পত্রিকায় দেখেছি সিরাজ শিকদারের মৃত্যু বা হত্যা সংবাদ। আর ভাঙ্গা রেকর্ডের সরকারী প্রেস নোটের সেই কাহিনী, যেটা একবিংশের আজকের দিনেও ওই একই কায়দায় পরিবেশন করা হয়। বলা হয়ে থাকে ওটাই স্বাধীন বাংলার প্রথম ক্রস ফায়ার। তিন তারিখ যথারীতি বিকেল বেলা ভলিবল খেলা শেষের পথে। মাগরিবের আযান শুরু হয়েছে। খেলা বন্ধ। নেট খুলে গুছানোর কোন অবকাশ নেই। নেট পোলের সাথেই বাঁধা থাকতো। হঠাৎ বাবুল অর্থাৎ আখতারুজ্জামান বাবুল (পরবর্তীতে'৮৭এর এরশাদ গনতন্ত্রের নির্বাচনে জাপা এমপি হয়েছিল সে। শরীয়তপুরে বাড়ি) চিৎকার করে উঠলো, সিরাজ শিকদারের লাশ এসেছে। ইতি ভাই অর্থাৎ হাসানুজ্জামান ইতি, তিনি আমাদের ভলিবল খেলার দলপতি ও মেন্টর। বয়সে বছর সাতেকের বড় হলেও বন্ধু আচরনে আমাদের আবহটা বিরাজমান ছিল। তিনি বিখ্যাত চার নেতার একজন শ্রদ্ধেয় শহীদ কামরুজ্জামান হেনার ছোটভাই। ইতি ভাইকে বলেই বগলে ভলিবল নিয়ে কবরস্থান ডিঙ্গিয়ে লাশের কাছে পৌঁছালাম। অন্ধকার নেমে আসছে। গোটা পাঁচেক পুলিশ কর্ডন দিয়ে লাশ গোসলের ব্যবস্থা করছে। আশেপাশে সাদা পোষাকের বাহিনীও ছিল। এদিকে বিপ্লবী সর্বহারা নেতার আত্মীয় স্বজন বলতে তার পিতা আব্দুর রাজ্জাক সিকদার এবং ছোটবোন শামীম সিকদার ও অন্যান্য তিন চারজন আত্মীয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাজ্জাক শিকদার সাহেব সে সময় সম্ভবতঃ নরসিংদী থানার সার্কেল অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। আর শামীম শিকদার সম্ভবতঃ ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী। আমি ভলিবল বগলদাবা করেই শামীমের পাশে দাঁড়িয়ে লাশের গোসল এন্তেজাম দেখতে থাকলাম। লক্ষ্য করলাম বুকের দুপাশে গলার নীচে এবং বাম পাঁজর বরাবর চার থেকে পাঁচটা গুলির স্পট দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসায় মোমবাতি আনা হোল। শামীমের হাতে মোমবাতি, আমার হাতেও জ্বলন্ত মোমবাতি। আধাঘন্টা পরে লাশ গোসলের পুর্ব মুহুর্তে আমি স্পট থেকে চলে আসি। তখন তো সিকিউরিটি এখনকার মত এত মজবুত ছিল না। সবকিছুতেই একটা মানবতা মিশ্রিত আবহ ছিল বলেই হয়তো জাতীয় পর্যায়ের এতবড় অঘটনের দৃশ্যপটে বল হাতের সেদিনের ছেলেটি(আমি) এই স্পটে এভাবে দাঁড়াতে পেরেছিল। যাহোক সেদিন একটু দেরি করেই বাসায় ফেরা হোল।
বিপত্তিটা ঘটলো পরের দিন সকালে। সকাল সাতটায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মনসুর ফুফা অর্থাৎ মনসুর আলি। তিনি তখন এনএসআই অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় দপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসাবে কর্মরত। হাতে ইংরাজী বাংলা মিলিয়ে গোটা চার পাঁচেক পত্রিকা। 'দেখ মোয়াজ্জেম, জালালের কান্ড দেখ। পত্রিকার হেডলাইনে তার ছবি। তাও আবার দেশদ্রোহী সিরাজ শিকদারের লাশকে ঘিরে’। প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় গত সন্ধ্যার সেই মহান কমরেডের গুলিবিদ্ধ লাশের ছবি। পত্রিকার প্রথম পৃষ্টায় প্রধান হেড লাইন। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে মোমবাতি ধরে আধো আঁধারে তা দেখার চেষ্টা করছি। বড় ভাইয়া অধ্যাপক মানুষ। একটু হতচকিত হলেন। সেজভাই গোলাম রসুল। মুক্তিযোদ্ধা। বাস্তবিক ক্ষেত্রে তিনি যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের সঙ্গে সক্রিয়। আর আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নাদান ছাত্র। হৈচৈ ভর্ৎসনা পর্ব হোল বটে, তবে আমার তাৎক্ষনিক বুদ্ধিমত্তায় তা মিইয়ে গেল। আমি শুধু ফুফাকে বললাম আপনারা কি লক্ষ্য করেন নি যে আমার গায়ে খেলার জার্সি এবং বগলে একটি বল। অর্থাৎ খেলার মাঠ থেকে খেলতে খেলতে সেই দৃশ্যপটে আমার আবির্ভাব হয়েছে এবং তা কাকতালীয়। আমার এই অকপট কথাটি তারা আর গিলতে পারলেন না। আশংকা ও উত্তেজনা এখানেই শেষ। এটা নিয়ে আর কোন ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। কথাগুলি বললাম এই কারনে যে চার তারিখের জাতীয় দৈনিক সমূহের ছবিযুক্ত ওই সংবাদ আমাদের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু মহলে কিছুটা চঞ্চলতা সৃষ্টি করেছিল বটে, তবে ওটা স্রেফ ঘটনা চক্রের কাকতালীয় একটি ঝলক ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে একথা সত্য যে সেদিনের মোহাম্মদপুর কবরস্থানে দাফন করা বিপ্লবী বাম নেতার সেই স্মৃতি এখনো সেখানে থাকার কারনে আর দশজন কবরবাসীর মত মহান নেতা সিরাজ শিকদারের কবর জিয়ারত পর্বটি এক ভিন্ন মাত্রার আবেগ তৈরী করে। জানা অজানা অনেক মানুষই সেই নাম ফলকের পাশে দাঁড়িয়ে ‘'আস সালাম ওয়ালাইকুম ইয়া আহলিল কুবুরে’ বলে শান্তভাবে কবরস্থান ত্যাগ করেন।