জালাল উদ্দিন আহমেদ
শপথের সংবিধিবদ্ধতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:২৭ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪
কি সব উদ্ভট উচ্চারন! একজন উচ্চ পদস্থ সিনিয়র অবসরের আদমকে রাষ্ট্র বিবেচনায় দেশের সম্মানিত একটি শপথের আসনে বসানো হয়েছে। জাতীয় বিবেচনায় দেশ পরিচালনার একটি সুনির্দিষ্ট কাজের পরিচালকের আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আস্থার শপথ নিয়ে সেই কাজটি সচারুরূপে পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। ডিজিট্যল আইনের কোন ধারা ভঙ্গে অভিযুক্ত হব জানিনা, তবে যে কথপোকথন ও কার্য পদ্ধতি ঐ শপথ গ্রহনের ডেক্স থেকে বিরতিহীনভাবে চালু রয়েছে তা সত্যিকার অর্থে ঐ ডেক্সের এসাইনমেন্টের সাথে কতটুকু সম্পর্কযুক্ত - সে প্রশ্ন রয়েই যায়। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ বলে একটা প্রবাদ ছোটবেলায় পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে। আমাদের এই জমিনে আইন বিধান বা শপথ ভঙ্গের আঁচ বোধ করি অত উপরে যেতে পারে না। লক্ষ্য করা যায় শপথ নেয়া বিচারপতি থেকে শুরু করে আরো সব শপথের মহা মহিমরা হর হামেশাই তাদের বাউন্ডারীর বাইরে গিয়ে চমক জাগানিয়া কথাবার্তা উচ্চারন করেন। আর এসবের প্রতিবাদ করলেও তা আবার সেই শপথ ওয়ালাদের মাধ্যমেই থামিয়ে দেয়া হয়। আর রাজনীতি করে শপথে আসা শিরোমনিরা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরেই বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে অঙ্গীকারনামা দিয়ে সরকারী মেকানিজমে ঢোকা বাঙালী আদমরা কিছুটা হলেও বেকায়দায় আছেন।
বলছি বিধিবদ্ধ নিয়মের শিষ্টাচারে শপথ নেয়া একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথা। হয়তোবা কথাগুলি বহরে থাকা অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। কারন বাঙালীই তো সেখানে। কর্মক্ষেত্রের সুবিধাভোগে সরকারী ট্রেনিং ও বিভিন্ন এসাইনমেন্টে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করতে হয়েছে আমাকে। ফলে পেশাজীবি ও প্রশাসনের ভিন্নধর্মী মামুষজনের সাথে অফিসিয়ালী ও পাবলিকলি অনেক অম্ল মধুর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে বৃটিশ ও জার্মানদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। তাদের মুখের ভাষা ও অভিব্যক্তিই তার বক্তব্যের সারমর্ম বুঝিয়ে দেয়। তাছাড়া ডেক্স এসাইনমেন্টের একচুল বাইরে টু শব্দটিও তারা করবে না। সেক্ষেত্রে আমেরিকানরা খোলামেলা কথা উচ্চারন করলেও সাবজেক্টের বাইরে মন্তব্য তারা করেনা। এছাড়াও সাউথ এশিয়ার ফিলিপাইন সহ উদীয়মান দেশগুলির আমলা কামলা শ্রেনীর মানুষজনের কথাবার্তায় কাজ ছাড়া তার পেরিফেরির বাইরে কোন নতুন কথা শুনা দুস্করই বটে। অর্থাৎ প্রত্যেকের ডেক্স এসাইনমেন্টের বাইরে কেউ তার এক্সট্রা পারফরমেন্স দেখাতে চায় না বা সেসব কাজ তার কর্মক্ষেত্রের নীতি বিরোধী বলেই মনে করে। এক্ষেত্রে উপমহাদেশের ভারত পাকিস্তানের ক্ষেত্রটি কমবেশী আমাদের সাযুজ্যেই বিরাজমান বলে মনে হয়েছে। তবে তাদের চলার পথটা আমাদের মত অত প্রশস্ত নয় বলেই মনে হয়। কারন মাথার উপর পরিশীলিত রাজনীতির দৃঢ়তা তাদেরকে বেশী স্পেস দেয়নি বলে মনে করার যথেষ্ট কারন রয়েছে। আমার এক বৃটিশ বন্ধু ছিলেন। আছেন বলতে সংশয়ে আছি এই কারনে যে আমার কর্মকালীন শেষ বয়সে তার বয়স ছিল আশির কাছাকাছি। সুতরাং এখন জীবিত আছে কিনা সেটা ঠাহর করতে পারছি না। অবশ্য করোনাকালীন শুরুর দিকে তার সাথে শেষ কথা হয়। পরবর্তীতে মেইল করেও তাকে পাই নি। সম্ভবতঃ মহাভারতের সেই বিখ্যাত পান্ডব পক্ষের উচ্চারন “হত ইতি (গজ)” এর পর্যায়েই পড়েছে বোধ হয়। যাক, যেটা বলার জন্য বন্ধু মাইকেল উডলীর প্রসঙ্গটি আনলাম তার মর্মকথা হোল। মাইকেল খুব অল্প কথার মানুষ। যা বলে তার অর্ধেকটা মুখে, বাকীটা গলায় এঁটকে থাকে। সেই মাইকেল একদিন ডিনার টেবিলে আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, দেখ জালাল যে কাজটির জন্য তোমার পদায়ন করা হয়েছে সেটার জন্য শুদ্ধতা স্বচ্ছতা ধরে রাখার চেষ্টা করবে। দেখবে তোমার চলার পথ সাবলীল হবে। এরকম কথা আমার চাকরী জীবনের শুরুর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাপ্লাই এন্ড ইনস্পেকশন দপ্তরের পরিচালক, পাকিস্তান প্রত্যাগত সিএসএস কর্মকর্তা শফিউল্লা খান স্যারের মুখ থেকেও শুনেছিলাম বলে মনে পড়ে।
এতগুলো কথা বিভিন্ন উপমা দিয়ে বলার কারন নিশ্চয় আছে। নইলে খামোখা ইনিয়ে বিনিয়ে এত লেখালেখির কি প্রয়োজন! বাঙালী সবজান্তা বা ইংরেজীর সেই jack of all trade উচ্চারনটি বোধহয় বাঙালীদের জন্যই উদ্ভব হয়েছিল। আর আমাদের চলা ও বলার উঠানে এসব ঘটে বলেই হয়তো আমাদের ললাটে সবজান্তা শব্দটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। হতে পারি আমি একজন বিদ্যার জাহাজ, সব কাজের কাজি কিংবা ব্যারিস্টার বিচারপতি মহাধিকারিকের পথ পরিক্রমায় বিচরন করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মানিত গুনীজন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তার চলার পথে নানান প্রতিবন্ধকতায় জর্জিরিত হয়ে দিশাহীন অবস্থায় ঠেকে তখন আমি যদি বিচারকের আসনে কিংবা প্রশাসকের আসনে অথবা অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার ও শৃংখলা রক্ষা বা দেশরক্ষার আসনে বসে সেই “হবু চন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী” কিংবা রবি ঠাকুরের “দুই বিঘা জমি”র সেই বিখ্যাত উক্তি “বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুন” এ গুনান্বিত হয়ে ঢোল করতাল বাজাতেই থাকি, সেক্ষেত্রে সর্বনাশা পরিণতির আশংকাটা থেকেই যায়।
সস্তা জনপ্রিয়তার হাত তালিতে রাস্তার মোড়ে ক্যানভারদের বক্তৃতায় আমরা উচ্ছ্বসিত হই। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই চমক লাগানো বক্তৃতা বিবৃতি আমাদের আবেগে নাড়া দেয়। কিন্তু বিধিবদ্ধ নিয়মাচারে আবদ্ধ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীটির মুখে যখন “বিধি বদ্ধে”র বাইরে এসে মিডিয়া কাতরতার মোহে লাগাম ছাড়া কথাগুলো বের হয়ে আসে তখন দুর্ভাগ্যের অশনি জনতার জমিনে গাঁটছড়া বাঁধে। তিনি জানেন তার সক্ষমতার দৌড় কতটুকু! সুতরাং বিধিবদ্ধের ভিতরে থেকেই তো তিনি অতি সন্তর্পনে তা সমাধানে ব্রতী হতে পারেন। আর না পারলে তকমাটা ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে আসা কি তার জন্য এতই কষ্টের! একজন ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেলকে দেখেছিলাম এবং এখনও তাকে আমরা দেখছি। এখন তিনি মুক্তকন্ঠে কথা বলছেন। সে অধিকার তার আছে। এখন তো তিনি শপথের বাইরে! তার বিধিবদ্ধ থাকা অবস্থায় তিনি যে দৃঢ়তা দেখিয়ে তার শপথের সম্মান রাখার পারঙ্গমতা দেখিয়েছিলেন সেই পথ অনুসরনে এগোলেই তো হয়। বর্তমানের তিনি কি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাগুলি মনে করে এগোতে পারেন না! তিনি কি দেখেন নি তার পিতার অসহায়ত্বের দৃশ্য! যদিও সে সময়টা ছিল একটু আগোছালো ডামাডোলে ভরা। তিনি কি ভুলে গেছেন ক্ষমতা, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের সেই ত্রিমুখী লড়াইয়ে একজন প্রধান বিচারপতির ন্যাক্কারজনক নাকানি চুবানীর সেই নাটকীয় দৃশ্য! আর প্রজেকশন করেই যদি এসে থাকেন, তবে মুখটা সেলাই করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মটি সুচারু রূপে পালন ক’রে মানে মানে কেটে পড়ে বেগমপাড়া মুখী হওয়াটাই তো শ্রেয় বলে মনে হয়। খামোখা এসব মিডিয়া হাইপ তুলে সস্তা জনপ্রিয়তা নেয়ার আকাঙ্ক্ষা কোন কাজে আসবে কি?