জালাল উদ্দিন আহমেদ
সংবাদপত্র: ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা-ভাষাহীনের ভাষা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৩৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
চমৎকার সব হেডলাইন দিয়ে আজকাল বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলি তাদের উপসম্পাদকীয় বা মতামত সমূহ উপস্থাপন করে। সংবাদপত্র নাকি ভাষাহীনদের ভাষা, ক্ষমতাহীদের ক্ষমতা! কিন্তু এসবের সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া মুস্কিলই বটে। আজকাল তো বিদেশী সংবাদপত্রের আলোকে ভাষান্তর করা কিছু লেখা ছাড়া প্রানখোলা কোন মৌলিক রচনা বাংলার এই প্রগতিশীল আলো ঝলমলে তথাকথিত গনতান্ত্রিক পরিবেশের সংবাদপত্রে মেলা ভার। মাঝে মধ্যে প্রথিতযশাদের ইন্টারভিউ ইত্যাদির পসারে পাতা ভরার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। তারপরেও চলে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীন ও বৈশ্বিক প্রতিকুলতাকে ছাপিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচন নির্বাচন খেলায় সংবাদপত্রগুলির এখন রমরমা অবস্থা বলেই মনে হচ্ছে। ভোট নামক সেই পুরনো কাসুন্দির রাজনৈতিক উন্মাদনায় পত্রিকাগুলো শান্ত পরিবেশবের ডাইনিং টেবিলটাকে বেশ চকমকে করে তুলছে। তাও তো সেই ক্ষমাসীনদের এক তরফা হম্বিতম্বি ও ক্ষমতার দাপটীয় রাজনৈতিক কদাচার। কোথায় যেন ভাই বোন বাপ বেটা চাচা ভাতিজা মিলে এক ডজন এমপি প্রার্থী। রঙ বেরঙের ছবি দিয়ে বিশাল সব হেডলাইন। এই পারিবারিক প্রার্থীদের ফরম কেনার টাকা দিয়েই সাধারন দু’তিন পরিবারের সাংবাৎসরিক খরচাপাতির সংস্থান হয়ে যায় বলে বিতার্কিকরা বলাবলি করেন। আর এধরনের চটকদার খবরের হালনাগাদে আমাদের সংবাদপত্র সমূহ ভাষাহীনদের ভাষায় উচ্চকিত হয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সমুন্নত করার মহান ব্রতে এগিয়ে চলেছে! তথাকথিত গনতান্ত্রিক আচরনের এই অটোক্র্যাটিক দেশ শাসনের রোজ-নামচায় আমরা ক্ষমতাহীন মানুষেরা যে আজ ভাষাহীন কীটে পরিণত হয়েছি তারই কৈতুকানন্দে বুঝি আমাদের প্রথম সারির সংবাদপত্রের এই সুচিবায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণীয় উচ্চারন। বর্ণচোরা রাজনীতির গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দেশে গড়ে উঠা মুক্ত মঞ্চ বলতে তো এটুকুই সম্বল আমাদের।
১৮১৮ সালের ২৩ মে শুরু হওয়া সেই সমাচার দর্পনের যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র আমাদের হাতে আসে। এটিকেই যেকোন ভারতীয় ভাষার প্রথম সংবাদপত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে ১৯২২ সালের ১৩ মার্চের আনন্দ বাজার পত্রিকার মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষার সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু বলা যেতে পারে। সাতচল্লিশ পুর্ববর্তী সময়ের সংবাদপত্র কিছুটা ধর্মীয় চেতনার হিন্দু প্রাধান্যের সংবাদ বলতেই জ্ঞানীজনেরা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। কারন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায় সেসময় কিছুটা হলেও বাংলা ভাষা সাহিত্য আবর্তের বাইরে ছিলেন। ফলে বাংলার ভাষা ও এর ব্যবহার বিধির নিয়ন্ত্রন মোটামুটি ফোর্ট উইলিয়াম কেন্দ্রিক ব্রাহ্মন্য পন্ডিতদের সংস্কৃত বলয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলা ভাগের পরবর্তী সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক দুটি বাংলা পত্রিকা এতদাঞ্চলের বাঙালী মননে নিজেদের স্থান করে নেয়। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় চালু হয় ইত্তেফাক এবং ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে প্রকাশিত হয় আজাদী নামক পত্রিকাটি। তবে বৃটিশ আমলে সৃষ্ট সমাচার দর্পন ও পরবর্তী সময়ের আনন্দ বাজার পত্রিকার ভারত অন্দোলনে যে ভূমিকা তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পাশাপাশি ধর্মীয় যুযুধান তৈরী করে জাতীয়তা বোধের ধর্মীয় করনের শুভংকরের ফাঁকিকে ভুল প্রমানিত করার কাজে ইত্তেফাক ও আজাদী পত্রিকা বাংলা ও বাঙালী জাগরনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। মোটকথা সংবাদপত্র, বাংলা ও বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনাচারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থেকে তাদের মন ও মননশীলতার আঁতুড় ঘরে জলন্ত এক মোমের বাতি হিসাবেই বেঁচে আছে।
দিন পাল্টেছে। পরাধীনতার অক্টোপাশে থাকার দিনগুলিকে মানুষ বা জনপদ একে একে বিদায় জানিয়ে এখন সবাই মুক্ত নিঃশ্বাসে আপন ঠিকানা তৈরী করে নিয়েছে। দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের অধিকাংশ জনপদে স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার স্বাদ দৈনন্দিন হয়েছে। সেক্ষেত্রে জাগরনের গান, উদ্বুদ্ধকরনের স্তুতিগাঁথা কিংবা অস্তিত্ব বিনির্মানের আয়োজনে অতটা ব্যাতিব্যস্ত থাকতে না হলেও নিজভূমে আপন উঠানের মানুষগুলো যখন শ্বৈরশাসক বা মাফিয়া চক্রের শিখন্ডি হয়ে দেশ শাসনে ব্রতী হতে চায় তখন সংবাদপত্রের চরিত্রগত সেই বহুল আলোচিত ‘'চতুর্থ স্তম্ভ’টির অস্তিত্ব সামনে চলে আসে। তখনই সংবাদপত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামক সেই আর্টিক্যাল থার্টি নাইনের সাযুজ্যে কথিত পত্রিকার বড় বড় হেডলাইন দিয়ে লেখা “সংবাদপত্র ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা- ভাষাহীনের ভাষা” নামক প্রবঞ্চনা মূলক মতামত বা উপ-সম্পাদীয়কের যথার্থতা খোঁজার চেষ্টা করি। প্রেরনা বা উৎসাহের বদলে এটাকে কি বলা যায়! এটাকে ঊনবিংশের সমাচার দর্পনে প্রকাশিত সেই “বাবু কাছারি বাড়ির তক্তপোষে বসিয়া গড়গড়ার নলে ঠোঁট লাগাইয়াছেন। এমন সময় গ্রামের কতিপয় চাষাভুষা করজোড়ে উঠানে হাজির হইলো কোন এক দেন দরবার লইয়া। পুবপাড়ার মহিম চ্যাটুজ্যের ছেলে নরেন মন্ডলের বাড়িতে যাইয়া তার মেয়েকে জোরপুর্বক লইয়া ঘাটে বাঁধা নৈকায় উঠাইয়াছে। বাবু রাগান্বিত স্বরে তাদের তীরস্কার করিয়া বলিলেন এইসব সামান্য বিষয়াদি লইয়া এত শোর করার কি আছে। আমি মহিমকে ডাকিয়া শাসন করিয়া দিব। এইটা লইয়া তোমরা আর হুল্লোড় করিও না। আগামী পরশু তোমাদের গ্রামে আসিয়া নবান্নের আনাজ বিতরন করিব। বাবু মহাশয়ের সহানুভূতিতে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী জলবৎ তরলং হইয়া মৌনব্রতে নিজ নিজ বাটিতে প্রত্যবর্তন করিল” এর মত উচ্চারন নয় কি?
আমরা কোন্ অভিযাত্রার সওয়ারী, বুঝতে বড় অক্ষম। একজন দেশ বরেন্য চিত্রনায়ক কিংবা চলমান সময়ে বিশ্বখ্যাতির তকমাটি কাঁধে রাখা প্রিয় খেলোয়াড়টি যখন তথাকথিত কলুষিত গনতান্ত্রিক চর্চার এই বিতর্কিত নির্বাচনের রেসে সামিল হন তখন আমাদের সংবাদপত্রগুলি দেশের শিল্প সাংস্কৃতি ও অন্যান্য পেশজীবি উঠানের অশনির কথাগুলি উচ্চারন না করে স্তুতির বন্ধনীতে আঁটকে পড়ে থাকে। আর নিজেদের প্রকাশ ও প্রকাশনার স্তুতি মন্ত্রে বুঁদ হয়ে কর্তা কীর্তনের পরবর্তী সিঁড়িতে উঠার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের রাজনীতির চরিত্রগত পরিবর্তনের মাশুল হিসাবেই এটাকে বিবেচনা করা সমীচিন বলেই মনে করা হয়। রাজনীতির নীতিটা এখন কচু পাতার ফোঁটা জলের মত ডিগবাজি খেতে খেতে নায়ক গায়ক ডাক্তার কবিরাজ পেজাজীবি সন্ত্রাসী মাস্তান সবাইকে এক ঘাটে বেঁধে চলতি হিসাবের ফেঁপে উঠা ব্যবসায়ীদের কাঁধে চড়ে বসেছে। ফলে অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তি এবং সঙ্গে কিছুটা ক্যারিশম্যাটিক যশ জৌলুষ আজ রাজনীতির মূল ক্রাইটেরিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠে ঘাটের পোড় খাওয়া রাজনীতির বড়িগুলো এখন রাজনীতির কর্মী সেজে বড়ভাই-দাদাভাই ইত্যাদির ভূমিকায় গ্রাম বাংলার আম জনতাকে সামলানোর ভারে নুব্জ হয়ে ধুঁকছে। সেক্ষেত্রে দেশ ও রাজনীতি পরিচালনার সর্বক্ষেত্রেই এই “চলতি একাউন্ট”এর ব্যবসায়ীরাই আজকে দেশের নিয়ন্তা হয়ে বিচরন করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের আর্টিক্যাল থার্টি নাইনের মুখ ও মাথাগুলো তাদেরই অঙ্গুলি হেলনে চলবে - এ সত্যটি দ্বিমত করার অবকাশ আছে কি!