জালাল উদ্দিন আহমেদ
দাদাগিরি না দূর্বৃত্তায়ন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৪ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৩৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
গত সপ্তাহে রাজনীতির দাদাগিরির কথা লিখতে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে কলম থামিয়েছিলাম। ইদানীং সময়ে এই বিষয়টির বাড় বাড়ন্ত চোখে পড়ার মত। তাইতো এটা নিয়ে আবার কলম ধরতে ইচ্ছে করে। রাজনীতির হাত বড় লম্বা বলেই মনে হচ্ছে। যেসব খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো আড়ালে আবডালে আলো ছায়ার মত জন সম্মুখে এসেও হয়তো মিলিয়ে যেত বা যেসব বিষয়গুলি অতি সাবধানী হয়ে রাজনীতিতে ব্যবহৃত হোত আজকাল তা প্রকাশ্য দাদাগিরির লাইম লাইটেই বিকশিত হতে চলেছে। কি এক অদ্ভুত আচরনে রাজনীতির পসার ঘটে চলেছে তৃতীয় বিশ্বের এই ভূসমাজে। আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে ক্যাটাগরি ওয়াইজ এসব রাজনীতির কালচারে পক্ষ বিপক্ষ হয়ে উলঙ্গ নৃত্য করছি। কেউ রাজনীতি করুক আর না করুক কিংবা রাজনীতির র না বুঝলেও তাদেরকে নিয়ে বাদ্যগীত বাজিয়ে আমরা দশেরা ছুটিয়ে দিই। তারা যে সেলিব্রেটি! তাদের ফেস ভ্যালু দিয়ে আমার রাজনীতির মন্দাভাবটুকু যতদূর এগিয়ে নেয়া যায় - এটাই হোল আজকের দিনের গন প্রজাতন্ত্রী রাজনীতির সর্বশেষ রোজ-নামচা।
বলছি, সেলিব্রেটিদের দিয়ে রাজনীতির চাকচিক্য বাড়ানোর এক অদূরদর্শী রাজনৈতিক কালচারের কথা। তিনি হতে পারেন সদ্য অবসরের ডাকসাইটে সরকারী আমলা, অবসরের চৌকস আইন শৃংখলার বড় বাবু কিংবা দেশ রক্ষা বিভাগের উচ্চাভিলাষী পোষাকী ব্যারাক পরিবারের মানুষজন। আমার এই সেলিব্রেটি চয়েসের প্রথম সরণীতে সরকারী আমলা কার্য কর্তাদের কেন আনতে হোল তার নিশ্চয় একটি গূঢ় ব্যাখ্যা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সেলিব্রেটির খাতায় না ফেলে তাদেরকে অনুগতের পরিমাপে আনাটাই শ্রেয় বলে মনে হয়। তবে সেলিব্রেটি ক্যাটাগরিতে না ফেলে উপায় তো দেখি না। কর্ম জীবনে তাদের আনুগত্যের ফালনামায় সাধারন মানুষ তো অনেক কিছুই দেখেছেন। দেখেছেন তারা সরকারী মেকানিজমের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে কিভাবে পার্টিজেন রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে দেশকে একপেশে রাজনীতির কালচারে পরিণত করেছেন। প্রশাসন ও আইন শৃংখলা ইত্যাদির ফিরিস্তিগুলি ক্যাটাগরিক্যালি বিশ্লেষনে গেলে দেখা যাবে এইসব সরকারী মেকানিজমের বেতনভোগীরা কিভাবে দেশে রাজনীতির কলুষতা সৃষ্টির কারিগর হয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত পথ চলার ভবিষ্যত তৈরীতে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। সুতরাং কর্মজীবন শেষে রাজনীতির পটুয়া হিসাবে তাদের চানক্য ব্রেনের বিকল্প আছে কি? সেক্ষেত্রে রাজনীতির শোকেসে ছড়ি হাতে যারা আছেন তাদের সভাসদ হওয়ার প্রথম যোগ্যতায় তো এরাই সেরা।
চলে আসি রাজনীতির অঙ্গনে ছায়া না মাড়ানো মিডিয়া জগতের সেলিব্রেটিদের কথায়। তারা তাদের রূপ লাবন্য এবং অভিনয় ইত্যাদি করে সমাজ তথা রাষ্ট্রে আবাল বৃদ্ধ বনিতার স্বপ্নের নায়ক নায়িকা হন। স্বপ্ন পুরুষ বা স্বপ্ন নারী হয়ে তারা জনপদের প্রতিটি কোনে তাদের ক্রেজ তৈরী করেন। সেক্ষেত্রে রাজনীতি গণতন্ত্র সমাজনীতির বুজরুকি বুঝুক বা না বঝুক, তাদের মত এরকম চুম্বক সেলিব্রেটি রাজনীতির ফোকাশে থাকলে সেটার আকর্ষনই অন্য এক মাত্রা তৈরী করে। রাজনীতির তঞ্চকতায় ক্ষমতা লাভের মোক্ষ হিসাবে এসব চাখালো সালুন আর কি হতে পারে! সুতরাং তাদের মধ্যে রাজনীতির ক্ষমতা ভোগের একটা হাইপ তুলে রাজনীতির বাজারটি আপাত গরম করার এসব মোড় ঘুরানো চমক প্রকৃত রাজনীতির আঁধার ঘরে মোমের বাতি হয়েই ধরা দেয়। সামগ্রিক অর্থে উৎসুক জন সাধারনের ক্ষনিকের এসব টনিক জাতীয় রাজনীতির বোলচাল আজকাল বেশ ভালভাবেই বাজারজাত হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন খেলাধুলার বেশ পসার। বিশ্বে রাজনীতি অর্থনীতি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও সমর নীতির উড়নচণ্ডী আচরনে যুব সমাজের সিংহভাগ এখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে আগ্রহ দেখায় বেশী। সেক্ষেত্রে রাজনীতির রাষ্ট্র চিন্তায় দেশ যেভাবেই চলুক না কেন, খেলায় অন্তঃপ্রান মানুষগুলো তাদের দেশ চিন্তায় একাট্টা থেকে নিজের দেশ বা দলের জন্য জান বাজি রাখতেও পিছপা হন না। সেখানে থাকে না কোন রাজনীতির স্ট্যান্টবাজি বা তঞ্চকথা। দেশপ্রেমের নিখাদ নির্যাস নিংড়ানো ভালবাসায় মানুষ একজাতি একদেশ হয়ে আপন অস্তিতের উপস্থাপনে উচ্চকিত হন। এসব দেশপ্রেম একতা ইত্যাদির শুভ্রতা ও স্বচ্ছতা রাজনীতির কাছে কচু পাতার ফোঁটা জল। এজন্যেই হয়তো রাজনীতির দৈউলিয়াত্ব দাঁত কেলিয়ে জনপ্রিয় খেলাধুলার অঙ্গনের সর্বজন প্রিয় দেশখ্যাত বা বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়ে তাদের ক্ষয়ে যাওয়া রাজনীতি মেরামতের দাবার চালে চমক লাগাতে চায়। আর ক্ষমতা এমন এক সুধা যার আকর্ষন বোধ হয় একজন পাগলও এটার স্বাদ নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। রাজনীতির এই দৈউলিয়াপনার সুযোগে সর্বক্ষেত্রের মানুষ ক্ষমতা নামক ফানুস ছড়ানো এই দিকটাই ঢুঁ মারতে বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ করে বলেই মনে হয়। খেলতে খেলতেই দেশের সেরা খেলোয়াড় যখন মাঠ থেকেই সরাসরি রাজনীতির মাননীয় হয়ে গদ্দিনসীন হয়ে যান তখন সে খেলার কি হোল না হোল সেটার খোঁজ খবর নেয়ার চেয়ে তিনি তখন রাজনীতির দলীয় পরিচয়ে আবর্তিত হয়ে পড়েন। ফলে রাজনৈতিক পরিচয়ে তাকে তখন ক্রীড়া জগতের প্রশাসক হওয়ার চিন্তাতেই ঘুরপাক খেতে হয়।
আজকের রাজনৈতিক দলগুলির চালচিত্রে রাজনীতির প্রকৃত আবাহনের কোন্ সূত্রটি সচল আছে বলা যাবে কি? রাজনীতির পঠন-পাঠন ও শৃংখলাবদ্ধ অনুশীলনের রেওয়াজ কি কোন রাজনীতির উঠানে আছে? নইলে রাজনীতির উঠানে জনসেবা ও মানব প্রেমের দিক্ষা নেয়া পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের এতই আকাল পড়লো যে আজকের দিনে দেশসেরা নায়ক গায়ক ডাক্তার সাংবাদিক ইঞ্জিনিয়ার খেলোয়াড় আমলা বিচারপতি ও স্বনামখ্যাত পেশাজীবি এমন কি শৃংখলা বাহিনীর বড় সাহেবদেরকেও তাদের নিজেদের পেশাজীবনের সুখ্যাতির শীর্ষ বিন্দুর সুনামকে ঠেলে ফেলে ক্ষমতা লাভের এই রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে এমপি মন্ত্রী হতে হবে? কোন মধুর টানে? সবকিছুর শেষ গন্তব্য হিসাবে যদি রাজনীতিই মোক্ষ হিসাবে বিবেচিত হয় তাহলে আর আর সামাজিক অর্থনৈতিক শিক্ষা স্বাস্থ্য ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের শিরোমনিরা দলীয় অনুগত্যের ভাঁড় হতে গিয়ে দেশের বুনিয়াদ বিনির্মানের সামগ্রিকতা বিসর্জন দিয়েই এগোবেন - এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। আমরা দেখেছি এক এগারো পুর্ববর্তী জনতার মঞ্চ নামক কলুষিত রাজনীতির সেই উঠান থেকে কিভাবে দেশের প্রশাসন ও পেশাজীবি উঠানের মেরুদন্ড গুলিকে রাজনীতি করনের বিষে জর্জরিত করা হয়েছে। এমন কি সরকারী খাস আমলা তন্ত্রের উঠানেও রাজনীতির বিষাক্ত রেসের দলীয় পরিষদ গঠনে উৎসাহ ও মদদ দেয়া হয়েছে। আজকের দিনে এসব এখন আত্ম পরিচয়ের সূত্র বলেও বিবেচিত হয় বলে খবর আসে।
রাজনীতির অনুশীলনে দাদাগিরি একটি আলাদা উচ্চতার পরিশীলিত ডাক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উচ্চারিত সেই বিখ্যাত ‘মুজিবভাই’ ‘দাদাভাই’ ডাকের কথা কি আমরা ভুলে গেছি! মাঠের রাজনীতির পোড় খাওয়া সেই অগ্রজদের ‘বড়ভাই’ ডাকের শৃংখলিত উচ্চারন আমরা ভুলি কেমন করে। বড়ই পরিতাপ ও দুঃখ নিয়ে বলতে হয়, যেদিন থেকে কর্মজীবন শেষের এই অবসরের আদমরা রাজনীতির কেউটে হয়ে দলীয় রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ নিয়েছেন তখন থেকে রাজনীতির সেই মধুর ডাক দাদাভাই বা বড়ভাই ‘'স্যার” আর “ম্যাডাম” হয়ে আমাদের ঘড়ে নিঃস্বাস ফেলা শুরু করেছে। বলা যায় রাজনীতির সেই বিশুদ্ধ উচ্চারনের দাদা ডাক ও তার ব্যবহার এখন দাদাগিরির হুমকি-ধমকির চোরাগলিতে সাঁতার কেটে দুর্বৃত্তায়নের পচা প্যাঁকে খাবি খাচ্ছে।