জালাল উদ্দিন আহমেদ
রাজনীতির দাদাগিরি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ নভেম্বর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৩৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সংযুক্ত ছবিটি সংবাদপত্র থেকে নেয়া। ১৩-১১-২০২৩ প্রথম আলোর শেষের পাতা থেকে নেয়া এ ছবি। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট এরকম ছবি আগেও দেখেছি। কিন্তু আজকের ছবিটির একটু আলাদা উচ্চতা আছে বৈকি! চাট্টিখানি ব্যাপার! একজন সামরিক কর্মকর্তার জামাতা বলে কথা। তাও আবার শশুর মশাই নাকি একজন অবসরপ্রাপ্ত টু স্টারের সামরিক কর্মকর্তা যিনি ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাবেক সাংসদও বটে! সুতরাং ক্ষমতাসীন থাকাকালীন অবস্থায় তাদের মিছিলে এরকম শান শওকাত হবে না, তা কি করে হয়! পাঠক, ভাল করে ছবিটি দেখুন। কি চমৎকার এক সিনেম্যাটিক দৃশ্য। রাজপ্রাসাদ থেকে মহামান্য রাজা বাহাদুর সস্ত্রীক আত্মীয় পরিজন নিয়ে জন সম্মুখে বেরিয়েছেন। সঙ্গে তার শৌর্যবীর্যের প্রতীক সশস্ত্র বডিগার্ডও রয়েছেন। কোন এক মহা আয়োজনের মিছিলে তিনি। আর পিছনে রয়েছেন তার তালুকের প্রজাদের ব্যানার সহকারে ঈ অনুগত জনতা। সাংঘাতিক সেই চুলচেরা মূহূর্তটিও কিন্তু আমাদের চোখকে এড়াতে পারেনি। জনতার মিছিলের শব্দ এবং গগন বিদারী শ্লোগান উচ্ছ্বাস মহামান্যের কাছে হৈচৈ চিৎকার চেঁচামেচির এক বিরক্তির উদ্রেক করেছে। তাই তিনি কানে আঙুল চাপা দিয়ে ক্ষনিকের এই কিচিরমিচির শব্দ দূষনের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছেন বলেও মনে হচ্ছে। মধ্যযুগীয় সেই কেদার রায় বা শের খানরা বাংলায় ফিরে এলো কিনা বুঝতে পারছি না।
আমাদের এই দেশটাকে শাসকরা এক সময় ‘বাঙাল মুলক’ বলে সম্বোধন করতো। সেখান থেকে এল বাঙাল ও বাঙালী। মুলতঃ কাদামাটির নদী চর নৌকা মাঝি চাষাভুষাদের মুসলিম ও নিম্নবর্নের হিন্দু অধ্যুষিত পুর্ব বাংলাকেই বাঙাল মুলক বলা হোত। সম্ভবতঃ আরবী ফার্সী ও বৃটিশ বেনিয়া শাসকদের উচ্চারনের টোনেই এই এই শব্দ যুগলের সৃষ্টি। আর যুগ পরম্পরায় বাংলা অঞ্চলের শাসক বলতে তো সেই দিল্লী লখনৌ কেন্দ্রিক খান পাঠান এবং শাহ সাহেবদের সদম্ভ পদচারনা। পুর্বতন আচরনে অবশ্য দক্ষিণ ও উত্তর ভারতীয় সেন ও পালদের এমনকি মৌর্য শাসকদের আমরা পেয়েছি। সেটা অবশ্য হিন্দু ভারতের সেই সাম্যের ব্রতচারী উচ্চারনের, ‘এই পিয়ারী ভারত মা তুঝে ম্যায় শির ঝুঁকাতি হ্যায়’ এর এক বর্ণচোরা উচ্চারণ। কারন শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু উচ্চারনের সেন রায় সিংহরাও কিংবা সৈয়দ খান বাহাদুররা কোন কালেও এ মাটির ভূমিপুত্র ছিলেন না। ফলে তাদেরই ঔরশ পরম্পরায় আমরা যাদেরকে সামনে রেখে আমাদের শোকেস সাজাতে চাই তারা কিন্তু আমাদের আদি আবাহনের এ টু জেডের ডিএনের সঙ্গে কখনোই এক পাল্লায় চড়তে পারবেন না।
একটা কথা বা জন সম্মুখে প্রকাশিত দু'একটা হিসাব নিকাশও আমাদের বলে দেয় যে আমরা সত্যিকার অর্থে এক হীনমন্য জাতি। নিজেদেরকে যেকোন উপায়ে উচ্চতর পাল্লায় চড়াতে পারলে আমরা আপ্লুত হই। খোলসা করে সোজা বাংলায় বললে, ঝেড়ে কাশতে ভয় পাই বলেই হয়তো আমরা এসব নিয়ে আত্ম সমালোচনায় যেয়ে চাই না। তাছাড়া হয়তোবা বাস্তবতায় এসব ক্ষেত্রে সাযুজ্য রয়েছে বলেই আমরা এসব জুড়ে দিতে কুন্ঠিত হইনা। কারন নিজের আঁতুড় ঘর খুঁজতে গেলেই রবি ঠাকুরের সেই ‘শক হুন দল মুঘল পাঠান একদেহে হোল লীন’ এর আপ্তবাক্য এড়িয়ে যাওয়া যায় কি! বার আউলিয়া ও বর্মী বর্গির দেশে এরকম উত্তরাধিকার পরম্পরা হতেও পারে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, নোয়াখালী বরিশালের চর ভাসি লোকজন ও অন্যান্য নদী ভাঙ্গনের ভাগ্যান্বেষী মানুষজন ঢাকায় এসে বড় বড় পদবী লাগিয়ে দিয়ে কেউ চৌধুরী সৈয়দ, কেউবা তালুকদার খন্দকার হাওলাদার হয়ে তাদের ভাগ্যদেবীকে তুষ্ট করে সামনের সিঁড়ি গাঁথা শুরু করেন। সময়কে জয় করে একসময় এধরনের লোকজন সমাজের মাথা হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকেন। মুস্কিল হয়েছে এখানে। সেই চরভাসি বা বনভাসি মানুষটি যখন ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গিয়ে নিজের বংশ পরম্পরার ঠিকুজি লিখতে গিয়ে আরবের মহান সিপাহশালার সালাউদ্দিনের বংশধর বলে নিজেকে পরিচিত করেন। কিংবা হজরত বড়পীরের নাতি অকৃতদার শাহ মখদুম(রঃ)এর বংশধর বলে পরিচয় দিয়ে অন্য উচ্চতায় উঠতে চান সমস্যাটি তখনই সমাজে এক ভিন্নমাত্রার জটিলতা সৃষ্টি করে। এর বেশী ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলেই যতি টানতে চাই যে ‘বৃক্ষ তোমার ফলে পরিচয়’।
আসি রাজনীতির দাদাদের কথায়। ওরা বুভুক্ষু সর্বভুকের ভূমিকায় আজ। তবে অবশ্যই শাসন ক্ষমতার পিড়িতে বসেই এই ক্ষুধা বা খিদে ওদের উন্মাতাল করে তোলে। সর্বাসনে ওরা বাটি চালান দিয়ে জানান দেয় ওদের হাকিমি ও হুকুমি আদল। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এখন পরম্পরার ভাগ বাটোয়ারার মহা আয়োজন লক্ষ্যনীয়ও বটে। সেই ভাগ বাটোয়ারার পাটাতনে এযাবতকাল পর্যন্ত মাথা আর ধড় ছাড়া কোন সমীকরন সৃষ্টি হয়নি। তবে ধড় থেকে বেরিয়ে আসা সেই মহান সিপাহশালারের পক্ষটিই এখনকার দিনে ধড়ের কলিজা হৃৎপিন্ড বাদে অবশিষ্ট হাড় হাভাতে বাঙালীর ফুসফুস হয়ে আপন অস্তিত্ত্বের চুলা জ্বালিয়ে রেখেছে। যদিও তাদের পরম্পরার শিকড় বাকড়ের এত বাড় বাড়ন্ত চোখে পড়ার মত নয়। পরম্পরার এই দুটি পক্ষের প্রথমটি গত দেড় দশক থেকে যেভাবে শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে গ্রাম বাংলায় তাদের বিকশিত করে চলেছে তা সত্যিই তাক লাগানো ব্যাপার বটে। আজকে বাংলার রাজনীতির এই চুম্বকাংশকে সামনে রেখে তাদের বলয়ে সৃষ্টি হওয়া সৈয়দ তালুকদারদের সদম্ভ পদচারনায় বাংলার রাজনীতির উঠান বড়ই উর্বর। দেশে মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থার এ এক চমক লাগানো উত্থান বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া শাসন ক্ষমতার শিরোমনির অনাকাঙ্ক্ষিত বয়ানের সুযোগ নিয়ে পরম্পরায় পুনর্বাসিত শিকড় বাকড়ের কথাবার্তার ক্ষেত্রেও আজকাল বেশ অসংলগ্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এসবের সাযুজ্যে পারিষদ দলের সদস্য ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত মহাজনরাও বেশ ফুরফুরে মেজাজে তাদের রাজনীতির দাদাগিরি অবলীলাক্রমে বিলিয়ে যাচ্ছেন।
আমরা ভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর মত একজন তেজদীপ্ত নেতার নেতৃত্বে আমাদের আপন অস্তিত্ত্বের ঠিকানা তৈরী করেছি। কিন্তু যে সৌভাগ্যের সিঁড়িতে চড়ে আমরা আমাদের হাটার পথ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি সেই পরম্পরাদের ফালনামায় কি বঙ্গবন্ধুর ন্যুনতম বিচ্ছুরন আছে! অপর পৃষ্ঠায় জড়িত পরম্পরাদের বিষয়েও এসব প্রশ্ন করা কি অবান্তর হবে! সুতরাং লাগামের টান যেরকম হবে জিনে বসা সওয়ারীরাও তো সে পথেই হাঁটবেন। সেক্ষেত্রে ছবিতে দৃশ্যমান ভিনদেশীয় আখলাকের জামাই বাবুর রাজনীতির দাদাগিরি তো সেরকমই হওয়ার কথা। আমরা ওদেরই হাওয়ালাতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় তদীয় সুকন্যার সংবিধান সম্মত সুশাসনের উন্নয়ন ও উন্নতির চরমতম উৎকর্ষতায় অবগাহন করছি।৷ রাজনীতির দাদাগিরি কোন্ উচ্চতায় অবস্থান করলে আজকের এই একবিংশের সিকি শতাব্দী ছুঁই ছুঁই সময়ে এসব রাজ-রাজড়া স্টাইলের মধ্যযুগীয় আচার আচরনের সম্মুখীন হতে হয় তা অনুধাবন করার ক্ষমতা আমরা নিশ্চয় হারিয়ে ফেলি নি। ছবিটি মফস্বলের মাঠ পর্যায় থেকে নেয়া। ভাবলে শিহরিত না হওয়ার উপায় আছে কি যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এই আচরনের মাত্রা এখন কোন্ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। আ'মীন!