জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধুসর স্মৃতি-৮
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ অক্টোবর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০১:৫৮ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
গত শতাব্দীর বাহাত্তর থেকে আজকের একবিংশের তেইশ, সেতো অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। বাঁক বদলের এই যৌবনে পা রাখা বাঙালী এখনো যে শৈশব কৈশরের ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে, সেটা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান কিন্তু তাইই বলে। তাহলে কি জন্মলগ্নের সূচনায় কানে আযান না দেয়ার ফল হিসাবেই আজকে আমাদের এই দশা! হয়তোবা তাইই হবে। যখন মুক্ত হলাম তখন দেশের সামগ্রিকতার চিন্তায় না থেকে দলীয় একতরফা শাসন ব্যবস্থায় একছত্র হওয়ার তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলেছিলাম আমরা। পরাধীন ডিক্টেটরের অধীনে নির্বাচিত পাকিস্তানী ম্যান্ডেটের এমপি এমএনএদের দিয়েই স্বাধীন মুক্ত বাংলায় সরকার গঠিত হোল। অথচ সেদিনের প্রথম প্রভাতে যদি দলমত নির্বিশেষে মহান নেতাকে সামনে রেখে একটি সার্বজনীন সরকারের অধীনে দেশের পথচলা শুরু করা যেত তাহলে দলীয় অহমিকার চুঁড়ায় চড়ে আজকের দিনে যে গণতান্ত্রিক শ্বৈরাচারের তান্ডব চলছে তা হয়তো বাংলার মানুষকে দেখতে হোত না। আমরা ভুলে যাই মুজিব আমাদের বঙ্গবন্ধু, তিনি আমাদের রাষ্ট্র পিতা এবং সর্বোপরি তিনি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। অথচ সেই মুজিবকে আমরা দলীয় সংকীর্ণতায় রেখে একটি দলের রাজনৈতিক বড়ি হিসাবে আলু পটলের মত সের দরে বিকিকিনি করছি। তাঁকে সামনে রেখে কোথায় আমরা সামগ্রিক বাংলাদেশের ক্যানভাসে ছবি আঁকবো, তা না করে আমরা একটি দলের শিখন্ডি বানিয়ে দেশে বিভাজনের রাজনীতির হালুয়া রুটি ভাগের এন্তেজামে মশগুল হয়ে পড়লাম। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। এই দুর্ভাগ্যকে মাথায় নিয়ে আজ আমরা দেশের মহান নেতাকে প্রতিপক্ষের সামনে মাঠে নামিয়েছি। কেন বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়ে জাতীয় ঐক্যমতের একই রেখায় দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধার অঞ্জলি দিতে কুন্ঠিত হই আমরা! এ দায় কার? এটা নিয়ে কাদের সর্বাগ্রে উচ্চস্বরে কথা বলা উচিত ছিল। আর যারা বলেছিল তাদের কথা ও গবেষনার মূল্যায়নে আমরা কতটুকু হেঁটেছি! রাজনীতির দৌড়ঝাপে আজ আমরা নিজেদের জৌলুষ আর উপরে উঠার সিঁড়ি গাঁথতেই ব্যস্ত।
কোন্ রাজনীতির পিছনে আমরা দৌড়াচ্ছি! এখানে দেশ গড়ার, রাষ্ট্র বিনির্মানের, সামাজিক দায়বদ্ধতার কোন অঙ্গীকার আছেকি? থাকলেও মানবিক মননশীলতায় সেসব রাজনীতির চাকা আদৌও কোনদিন ঘুরেছে কি? দেশে দুই ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতির অনুশীলন হয়। তাদের পরম্পরাদের নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু ব্যক্তিদ্বয়ের কর্ম সাফল্যের দ্যুতিকে শিরোধার্যে না রেখে তাদের ব্যক্তি ক্যারিশমাকে পুঁজি বানিয়ে আমরা ক্ষমতারোহনের রাজনীতির দ্যুতিয়ালী করে সরলমনা বাঙালীর ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বসে আছি। ফলশ্রুতিতে দেশ বংশ পরম্পরার মধ্যযুগীয় রাজকীয় অবয়বের কাঠামোগত বিন্যাসে বিন্যাসিত হচ্ছে বলে আশংকা করার কারনগুলি স্পষ্টতর হচ্ছে। বংশ পরম্পরার অযোগ্যদের নিয়ে আজকের দিনে আমরা যে রাজনীতির হাট বসিয়েছি সেখানে সাবজেক্ট থেকে অবজেক্টদের দৌরাত্ম্যের দৌড় বেশী হওয়াতে জনপদের নাকাল আজ চরমে পৌঁছেছে।
যতই মুক্তিযুদ্ধ - চেতনা ইত্যাদি নিয়ে রচনা লিখি না কেন, অন্তরে যাদের লুট তারাজ, ধনাঢ্য হয়ে উপর তলার সিঁড়িতে উঠার বাসনা, তাদেরকে নিয়ে আর যা কিছু হোক না কেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার কর্মী হিসাবে তারা অযোগ্য - এটা উচ্চস্বরে আওয়াজ দিয়েই বলা যায়। তাছাড়া প্রতিপক্ষ হিসাবে যারা বাংলার সাধারন জনগনকে নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করছেন তাদের ঠিকুজিও যে খুব স্বাস্থ্যকর সেটা বলা মুস্কিল। আর নাম সর্বস্ব লাল সেলামের ইনকিলাবের দল, যারা আদিকাল হতে এই বাংলায় তাদের অস্তিত্ত্বের ঝান্ডা উঁচু করে রেখেছেন, তারা 'না ঘরকা না ঘাটকা' অবস্থা নিয়েই তাদের ঐতিহ্যের নিশান বয়ে চলেছেন। কিছুটা পর্বত প্রসূত মুসিকসম প্রজাতির আচরনেই তাদের দিনমান চলমান। ধর্মকে সামনে রেখে দ্বিজাতি তত্বের উত্তরাধিকারীর সর্বশেষ উঠান জামাতে ইসলামী বা আরেক পোষাকী জেনারেলের জাতীয় পার্টি তাদের অবস্থাও যে খুব একটা জাতীয় ভিত্তিক তা বলা যাবে না। যদিও ধর্মভীরু বাঙালীর মনের ঈশান কোনে বিক্ষিপ্তভাবে জামাতীদের কিছুটা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে ধর্মের সুবিধাভোগে একশ্রেনীর পীর মাশায়েখ বা আলেম তাদের ভক্তদের নিয়ে বিভিন্ন তরিকায় ভর ক'রে বাংলাদেশের মসজিদ মাদ্রাসা ভিত্তিক দু'চারটা ইসলামী দল গঠন করে তাদের উজ্জ্বলতা দেখানোর চেষ্টা করে, যেটা মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে মেলানো যায় না।
রাজনীতির ধারাবাহিকতায় অর্ধ শতাব্দীর এই বাংলাদেশ মূলতঃ দু'টি স্রোতে গা ভাসিয়েছে এবং এই দু'টি স্রোতেই মিলেজুলে দেশ শাসিত হয়েছে। শাসিত বলাটাই বাঞ্চনীয়। সেই যে সেন পাল মুঘল পাঠান এবং অবশেষে বৃটিশ বেনিয়া শাসন, পরবর্তীতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিন্ জাতীয় শাসন - সত্যিকার অর্থেই সেগুলি ছিল শাসন এবং শোষনের কাহিনী চিত্র। তবে আপন অস্তিত্ত্বের উঠানে পা রেখে বাঙালী বাংলাদেশী হয়ে যখন উঠে দাঁড়ালো, এখনকার এই অর্ধ শতাব্দীর ফালনামায় বাঙালী কি তার বুনিয়াদ নির্মানে স্বচ্ছ্ব হতে পেরেছে? স্বাধীন ভূখন্ডের ঘর গোছানোর ঊষালগ্নে তারা তাদের মহান নেতাকে হারিয়ে নির্বাক হোল, সামরিক লেবাসের উঠানামায় তারা তাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতিকে হারালো। পাকিস্তান ফেরত সেনা নায়কের শাসনে দেশ তার মূল চেতনার আদর্শ বিস্মৃত হোল। কেয়ার টেকারময় পনের বছরের পালা বদলের গনতন্ত্রে বংশ পরম্পরার শাসক পেল। আর এ শতাব্দীর পনের বছরে তারা পেল বংশ পরম্পরার শাসন ও শোষনের বহু বিচিত্র অক্টোপাশের বেড়াজাল। সেই বেড়াজালের চক্রব্যুহে বাঙালী এখন চড়ক পুজার গাঁথা বঁড়শিতে চরকির মত ঘুরপাক খাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
জন্মলগ্নের সূচনাকাল হতে বাংলা ও বাঙালী এদেশের রাজনীতির উঠান হতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জনগন, জয় বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, দুনিয়ার মজদুর এক হও এবং জনতুষ্টির একগাদা শ্লোগান ছাড়া আর কি শুনেছে বা পেয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুস্কিল। তবে তারা দেখেছে বা পেয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকের এক লম্বা ফর্দ। এই ফর্দের আহার অন্ন বা তার শ্রীবর্ধনের যোগান দিতে দিতে গত অর্ধ শতাব্দীতে বাঙালী হাড় হাভাতে ও ফোকলা হয়ে গেছে। যে গণতন্ত্র ও সামাজিক সুষম বন্টনের অগাধ সমুদ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিরিশ লক্ষ প্রানের বিনিময়ে তারা মুক্ত ভূখন্ডের জন্ম দিল, সেই আপন স্বত্ত্বার মাটিতে তারা দুরাচারী শাসক ও লুটেরা মজুতদার ও মুনাফাখোর বেনিয়া ছাড়া কিছু পেল কি? পাকিস্তানী বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে সাম্যতা সৃষ্টির লড়াই করে আজ তারা বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডে বাইশ'শ পরিবারের পদতলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে। সমাজের বিবেক বলে চিহ্নিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজ সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সামাজিক বিন্যাসে এখন স্রেফ ধনী ও দরিদ্রের অস্তিত্ব। বাঙালীর আপন অস্তিত্ত্বের অর্ধ শতাব্দীর উঠানে এইসব রোজনামচা নিয়েই আমদের নিয়ত সংগ্রাম। তবুও আশাবাদী বাঙালী। যেদেশে শেরে বাংলা, ভাসানী সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের মত তেজস্বী সন্তানের জন্ম হয়েছে সে দেশ তার অস্তিত্বের তেজস্বীয়তায় অম্লান থাকবে - এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। পাশাপাশি ক্ষমতার দ্বন্দে উন্মত্ত না হয়ে রাজনীতির প্রকৃত শিষ্ঠাচারে বাংলার মাটি ধন্য হোক - কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনাই করি।