জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধুসর স্মৃতি-৭
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ অক্টোবর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১১:৪৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
স্মৃতিগুলি আর ধুসর থাকলো কই? সবইতো এখন টাটকা তরতাজা। যে আগুনে ঘি ঢেলে দেশ শাসনের ঘর গৃহস্তি করার খোয়াবে বর্তমান শাসক দল ২০১৮ সালে নিশি রাতের ভোট সম্পন্ন করে আজকে যেভাবে রাজাধিরাজ সেজে দেশের উন্নয়নের সিঁড়ি গাঁথা শুরু করেছে তার রেশ কি সহজে থামবে! ক্ষমতার মোহ বড়ই দুর্বিনীত এক ফনা তোলা গোক্ষুর। শেষ ছোবল মারার আগ পর্যন্ত তার এই ভয়ঙ্কর ফনা সর্বদা উদ্যত থাকে। কাগজ কলমের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার এই জনপদে প্রকৃত অর্থে চলছে এক শ্বৈরাচারী শাসন বলয়ের দূরাচারী মাফিয়া তন্ত্র। বর্তমানকে নিয়ে বেশী বলার সুযোগ কম। কারন প্যাগাসাস নামক অক্টোপাশের থাবার নীচে আজ গোটা বাঙালী জাতি। এছাড়াও পরম্পরার শেকড় বাকড় ও বিশ্বস্ত অনুগামীদের দ্বারা অক্টোপাশের মত জড়িয়ে রেখে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে যেভাবে নিজেদের কর কমলে ন্যস্ত ও বিনীত রাখা হয়েছে তাতে করে এটা অন্ততঃ বলা যায় যে চক্রব্যুহ ভেদ করা বড়ই দুস্কর। পাশাপাশি ভিত শক্ত না করে প্রভু ভৃত্যের দৃশ্যমানতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ফোকলা করা হচ্ছে তাতে করে এসবের স্থায়িত্ব ক্ষণস্থায়ী ভঙ্গুর বলে মনে করার যথেষ্ট কারন রয়েছে। গত পনের বছরে মিডিয়া সমূহের একচেটিয়া কর্তৃত্ব, ব্যাংক বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের মালিকানায় নিজেদের খবরদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে শিক্ষক ছাত্রদের সমিতি ইউনিয়ন থেকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের উচ্ছেদ, সিভিল প্রশাসনে পোস্টিং ও পদায়ন হয় ঠিকুজির ফালনামা দেখে, শৃংখলা বিভাগের নিয়োগ পদায়নে আরো বেশী কম্বিং স্টাইলের যাঁচাই বাছাইয়ের এন্তেজাম। সর্বোপরি দেশের চালিকা শক্তির প্রতিটি আঙ্গিনায় বলশেভিক স্টাইলে নিজেদের কর্তৃত্বের বহরে এখন এক'শতে এক'শ করেই তারা তাদের মাফিয়া রাজ বহাল করেছে। সেক্ষেত্রে দেশ পরিচালনার হাল খাতায় তারা বলতেই পারে 'কার ঘাড়ে ক'টা মাথা ভিন্নমত পোষনে সক্ষম'!
আগেই বলেছি বাংলাদেশ রাজনীতির দুটি মেরু অর্থাৎ এ এবং বি যেভাবে কৃত্রিম দেয়াল তুলে সাপে নেউলের অবস্থানে নিজেদের অস্তিত্বের ডংকা বাজিয়ে চলেছে তাতে করে রাজনীতির এই জটিলতা সহজে উপশম হবে বলে মনে করার কোন কারন নেই। দুটিই কট্টর ডানপন্থা ঘরানার রাজনীতির অনুসারী দল। ক্ষমতা বিত্ত বৈভব এগুলোই তাদের ধ্যান জ্ঞান। রাজনীতির স্ট্রাকচারে তৃণমূল হতে উঠে আসা সাধারন পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের এখানে কোন মূল্য নেই। উত্তরাধিকারের গদ্দিনশীন পরম্পরার অঙ্গুলি হেলনে রাজনীতি পরিচালিত হয়। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা কর্মীদের সতুষ্টি লাভের নিমিত্তে দু-পাঁচ বছর পর পর হয়তোবা পার্টি কাউন্সিল হয় কিন্তু তার আধিকারিক নির্বাচিত হন রাজধানীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রূদ্ধদ্বার কক্ষে বসে। সেক্ষেত্রে পরম্পরার শিরোমনির সন্তুষ্টি ও অনুমোদন সাপেক্ষেই তা চুড়ান্ত রূপ নেয়। এভাবেই রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চা অনুশীলিত হয় আমাদের মহান দেশের এই ভূখন্ডে। আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে মহান পিতা কিংবা ঘোষনা পাঠের সিপা্হশালারের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে আমাদের রাজনীতির মাঠে ছড়িয়ে পড়ি। হয়তোবা এই ভেবে যে - রক্ত পরম্পরার সলতেগুলি ছিল বলেই তো আমরা এখনো একাট্টা, বুকে আশা নিয়ে সুদিনের স্বপ্নে জাল বুনতে পারছি। আমাদের আশা - পিতা ও ঘোষকের নেতৃত্বের স্ফুরন তাদের হেরিডিটির মাধ্যমে একদিন জ্বলে উঠবেই। নিন্দুকেরা হয়তো বলে উঠবেন, কেন! দেখতে পাও না! আর কত জ্বলা লাগবে। একজনকে বানিয়েছ দেশরত্ন আর অন্যজন দেশনেত্রী। আর কত! যাহোক, গভীরতায় গলা না ডুবিয়ে হাঁটুজলে পা রেখেই অন্ততঃ বলতে পারি ওরা তো আমাদের আঁধার ঘরে মোমের বাতি। ওদেরকে নিয়েই না হয় স্বপ্নের জাল বুনি।
আমার এই স্মৃতি স্মরনের আলোচনায় ঘটনাপুঞ্জকে প্রধান্য না দিয়ে আমি রাজনীতির গতি প্রকৃতি এবং সেসবের ব্যাখ্যায় বেশী জোর দিয়েছি। দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টি বা জামাতের গুরুত্বও বেশী দিই নি। এমনকি চলমান রাজনীতির ধারায় বামপন্থীদের ভূমিকাকে নিয়েও খুব বেশী উচ্চবাচ্য করি নি। বলিনি জাসদ নামক ধুমকেতু হয়ে পত্তন হওয়া রাজনৈতিক দলটির কথা। কেননা যে উচ্চাশা নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের তরুন যুবারা এর পতাকাতলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেভাবে মুক্ত স্বাধীন দেশের শাসকদের কাছে বলি হয়েছেন তার ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আমরা এখনো পাইনি। তাছাড়া বাঙালী চরিত্রের চিরায়ত সত্যে পরবর্তীতে এই জাসদ নামক রাজনৈতিক দলটি যেভাবে ব্যক্তি নামের সাইনবোর্ডে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তাতে আদর্শের ঠিকুজি তো ব্যক্তির সোলেনামায় ঠাঁই পেয়েছে বলেই মনে হয়। আর কোনদিকেই বা তাকাবো! আওয়ামী লীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টি - কোথায় রাজনৈতিক মূল্যবোধ বা আদর্শের কথা উচ্চারিত হয় বলা যাবে কি! ব্যক্তির ক্যারিশমা দিয়ে চলছে এসব রাজনীতি। সবাই বলে ব্যক্তির চেয়ে দল বড় দলের চেয়ে দেশ। সব কাগুজে ভাঁওতাবাজি। ফাঁকা শ্লোগান ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা দেখেছি বিপর্যয়ের দিনগুলিতে আওয়ামী লীগের নাম সর্বস্ব টংয়ের দোকানগুলি। দেখেছি জাতীয় পার্টির নামে স্রষ্ঠার সামনেই গড়ে উঠা অপভ্রংশগুলি। যদিও বিএনপির কপালে এই কলংকের তিলক এখনো জুটেনি তবে ক্ষমতাসীনদের প্রতিহিংসার ছোবলে এর ছিটেফোঁটা প্রয়াস ঘটলেও বাস্তবে তা হাস্যস্পদে পরিণত হয়েছে বলেই মনে হয়।
দেশ গড়ার কাজে মহান নেতার প্রানান্ত প্রচেষ্টার সেইসব ক্ষনকালের দিনগুলি মনে পড়লেও এখনকার বাস্তবতায় আমরা কি তা মনে রেখেছি! যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে অস্ত্র হাতে ঘুরে ফেরা মুক্তিসেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেয়ার সেই সাড়া জাগানো ঢাকা স্টেডিয়ামের দৃশ্য কি আমরা ভুলে গেছি! দেশের কালোবাজারী, মুনাফাখোর মজুদদার, প্রশাসনের অসৎ কর্মচারী ও চোরাকারবারীদের নিয়ে যে মহা ফাঁফড়ের দিনগুলি গেছে এবং সব মিলিয়ে মহান নেতার সেই হুংকার - লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব, আমরা তো ভুলতে পারি না। তাছাড়া বিদেশী মাড়োয়ারী চক্রান্তের নীলনক্সায় দেশের পাটের গুদামগুলিতে একের পর এক আগুন লাগিয়ে ধংস করার চিত্রগুলি কি সহজে ভুলা যায়। এমনকি সুযোগের মওকা খুঁজা এক শ্রেনীর মানুষের তখনকার সময়ে ১৬ টি জেলায় মোহাজের বা বিহারীদের জন্য গড়ে তোলা হাউজিং স্টেটের বাড়িঘরগুলি দখলে নেয়ার নীরব চিত্র অবিমৃষ্যই হয়ে রইলো। সেদিনের সবুজ বিপ্লবের ডাক, মুসলিম দেশ হিসাবে দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পত্তন, সেতো এগিয়ে যাওয়ারই দিশা। আর্থ সামাজিক উন্নয়নে দেশের জন্য ভাল ভাল প্রকল্প হাতে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়া তাঁর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশের দৃশ্যমান উন্নতি সাধন করেন। কৃষিখাতে এক ফসলী জমিকে তিনফসলী করার উদ্যোগ নিয়ে তিনি সফল হন। তাঁর খাল কাটা কর্মসূচি দেশের কৃষক সমাজে বেশ সাড়া জাগে। তবে জাপান এয়ার লাইন্সের বিমান ছিনতাই থেকে শুরু করে বিমান বাহিনীর বিদ্রোহ এবং সময়ে সময়ে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে সেনা বিদ্রোহের ঘটনাগুলো সামাল দিতে গিয়ে জিয়া প্রশাসনকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। অপর জেনারেল এর দীর্ঘমেয়াদী শাসনকালে সবচেয়ে জন কল্যানমুখী যে কাজটি প্রকৃত অর্থেই গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আপন মনে হয়ে ধরা দেয় তা হোল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতাশালী উপজেলা প্রশাসের গোড়াপত্তন। এটা সত্যিকার অর্থেই একটি জন কল্যানমুখী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলার মানুষের, দুর্ভাগ্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার। গনতন্ত্রে উত্তরন পরবর্তী পরম্পরার সরকার ব্যবস্থা সেই পদ্ধতি বাতিল না করলেও প্রশাসনিক আমলা বলয়ের অক্টোপাশে জড়িয়ে দিয়ে সেই স্বাধীন স্বায়ত্ব শাসিত উপজেলা চেয়ারম্যানশীপকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে অকেজো করে ফেলা হোল।
দেশে কৃষি বিপ্লব হয়েছে। শিল্প বিপ্লব হয়েছে। মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের অনেক কিছুই এখন দৃশ্যমান। তবে নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী পারিবারিক শাসনের গণতন্ত্রে এসে আমরা সামাজিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং নৈতিক অবক্ষয়ের নিম্নস্তরে এসে গড়াগড়ি খাচ্ছি। রাজনীতির ভাষা এখন অশ্রাব্য গালিগালাজে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্যক্তি ঈর্ষা আমাদের রাজনীতির চিরসঙ্গী হয়ে পড়েছে। আর মহান নেতাদের পারিবারিক বলয়ের আশীর্বাদে ক্ষমতার একছত্র নেতৃত্বের চাবি হাতে পেয়ে তারা প্রবল প্রতাপশালী হয়ে সাধারন জনগনের প্রভুত্বের ঢেকুর তুলছেন। যেহেতু তাদের জন্য রাজনীতির মূল সূত্রই হচ্ছে রক্তের পরম্পরা, সেক্ষেত্রে নেতৃত্বের চুড়ায় বসতে তাদেরকে রাজনীতি শিখতে হয়না। রাজনীতির পাঠশালায় তাদেরকে অ আ ক খ পড়তে হয় না। চেয়ারে বসে বরং তারাই আমাদের রাজনীতির হাতে খড়ি দেন। রাজনীতির প্রতিদ্বন্দীতাহীন ক্ষমতা তাদেরকে প্রবল পরাক্রমশালী শাসক বানিয়েছে। আর এভাবেই আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যক্তি ও পরিবার বন্দনার পাঠাগার হয়ে দেশের সাধারন মানুষেকে মুক্তচিন্তার রাজপথ থেকে গলিপথে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
(চলমান)