জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধূসর স্মৃতি- ৬
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ অক্টোবর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:৫৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ক্ষমতার পালা বদলে দেশে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়। তবুও গনতান্ত্রিক ধারার 'বাংলাদেশীয় সংস্করন' অর্থাৎ সন্দেহ, অভিযোগ ও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। এই যে বাংলাদেশীয় সংস্করন কথাটি উচ্চারিত হোল, তা সত্যিকার অর্থেই আমাদের নিজস্ব ধারা। এটাকে 'ধারা' না বলে বরঞ্চ অহংবোধের হীনমন্যতায় নিজেদের জাত চিনানো বলাটাই শ্রেয়। গণতান্ত্রিক চর্চা মানুষকে নৈতিকতা, শিষ্টাচার, সহনশীলতা ও সহমর্মিতায় বলিয়ান করে এবং সে শিক্ষাটি আসে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের পাঠশালা থেকে। কিন্তু বাংলার উঠানে যার পঠন পাঠনের বালাই নেই সেখানে এসব গালভরা মুক্তধারা অনুশীলনের সুযোগ কোথায়! যারা কর্ণধার বা কান্ডারী হয়ে সামনের সারিতে আসেন তারা তো সেই মধ্যযুগীয় রাজা রাজড়াদের উত্তরপুরুষের মতই যজ্ঞ করেই অভিষিক্ত হন। সেক্ষেত্রে রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চার স্থান এখানে কোথায়? "সর্ব সম্মতিক্রমে" বা "বিনা প্রতিদ্বন্দীতায়" কথাগুলো বোধহয় বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের অভিধানেই প্রযোজ্য। এখন তো আবার গ্রামে গঞ্জের স্থানীয় এমনকি জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও এসব বিনা প্রতিদ্বন্দীতা বা সর্ব সম্মতির ঘটনাগুলি দেশ শাসনের টনিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনের দিনে হয়তোবা "মনোনীত"দের মনোনয়নের বিষয়টি এক্স ফ্যাক্টো হয়ে গোদের ফোঁড় হবেন কিনা সেটাও বলা মুস্কিল।
যাহোক দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাগজ কলমের সূচনা হলেও বাস্তবিক অর্থে রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চার স্বচ্ছ্বতা সেভাবে বিকাশ লাভ করেনি। কিংবা এসব নিয়ে চিন্তা করার ফুরসতে কোন প্রাতিষ্ঠান স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করেছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে খ্যাত সেই সংবাদ মাধ্যমগুলি ক্ষমতার পকেটবন্দি হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জিইয়ে রেখেছে বলেই মনে হয়। আর যারা পকেট বা প্যাকেটবন্দি হতে পারেননি তারা হয় নিস্ক্রিয় হয়েছেন নতুবা নিজেদের বুনিয়াদী উদ্দীপনায় দেশান্তরী হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হয়েছেন। গত তিন টার্মের অর্থাৎ ১৯৯১ হতে ২০০১ পর্যন্ত স্বস্তির নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় বাংলার মানুষ নিজেদের পছন্দের গণতান্ত্রিক চর্চায় সাম্যতা পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু শাসক হিসাবে যাদেরকে পেয়েছেন তারা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই তিন টার্মের গণতান্ত্রিক চর্চায় দেশে মিডিয়ার আধিক্য বেড়েছে, ব্যংক বীমা আর্থনৈতিক প্রবাহ বেড়েছে, বেড়েছে উচ্চশিক্ষার নাম সর্বস্ব তিন কামরার বিশ্ববিদ্যালয় নামক ডিগ্রি দেয়ার দোকানঘর। বাস্তবিক অর্থে সবগুলোই হয়েছে মহাজনী মুদিখানার আদলে। আর শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রচার আর পসারের বাহুল্যতায় বুঁদ থেকে হেন অপকর্ম নেই যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ন্যুনতম পর্যায়ে পড়ে বলে মনে হয়! রাজনৈতিক অর্বাচীনতা সেটাই হবে যেটা আমার দেশকে বিভক্ত করে দুটি মেরু তৈরী করতে সাধারন মানুষকে উচ্ছৃংখল করে। একটি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে কাগজ-কলমের বৈধতা দিতে গিয়ে সমাজ রাষ্ট্রে যখন অরাজক উন্মত্ততার সৃষ্টি হয় তখন সেটা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা না বলে তাকে স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কিইবা বলা যায়।
ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন তড়িঘড়ি করে বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' ঘোষনা করে আইন পাশ করা হোল তখন এই জনপদের তরুন যুবা ও বিরুদ্ধবাদী মানুষজনের মধ্যে এক প্রতিশোধ ও হিংসার আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ছবি ও প্রতিকৃতি নিয়ে বিরোধী উচ্ছৃংখল কর্মীদের রাজপথে তা ছিঁড়ে টুকরো করে পদদলিত করতে দেখা গেছে। সাধারন মানুষের হৃদয়ে সেদিনের রক্তক্ষরন কি মুছে ফেলা যাবে! কার অদূরদর্শিতার ফসল হয়ে এই অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হোল এবং জাতীয় জীবনে এই ঘৃণার ঘা তৈরী করা হোল তার পোষ্ট মর্টেম কি রাজনীতির উঠানে কোনদিন হবে? পরবর্তী দুই দশকের ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতায় দেশে রাজনৈতিক সুষ্ঠতা ও স্বচ্ছ্বতা এসেছে কি? বঙ্গবন্ধুর সার্বজনীনতা প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতায় কোন্ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী ক্ষমতাসীনরা বাঙালীর মন ও মননে ঢুকার অনুশীলন করেছেন - বলা যাবে কি? ওই মহান নেতাকে নিয়ে একটি গোষ্ঠীর এত অত্মরোম্ভিতা কেন? কেন জয় বাংলা শ্লোগানে ব্র্যাকেট বন্দি করে তাকে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পকেটে রাখার এত আয়োজন! তিনি তো বাংলা ও বাঙালীর শিরোমনি। রাজনীতি ও ক্ষমতায়নের উর্ধে তিনি। কেন দেশের বৃহত্তম একটি গোষ্ঠী তাঁকে নিয়ে এখনো দ্বিধাদ্বন্দে আছেন। এই ভুল ভাঙ্গাবেন কে? সে হেমিলিয়ন আজ কোথায়? শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার বড়ি হিসাবে নিয়ে শ্লোগান - মিটিং - মিছিল আর পাঠ্য পুস্তকে তাঁকে নিয়ে দুপাতা লিখে দিলেই কাজ কি শেষ? আওয়ামী ক্ষমতালিপ্সুদের মনে রাখা প্রয়োজন তিনি জাতির পিতা। একটি রাষ্ট্রের মহান স্থপতি হয়ে তিনি বাঙালী অস্তিত্বের অহংকার। তাকে নিয়ে অহংকার করা যায়, গর্বে গর্বিত হওয়া যায়। কিন্তু তাকে নিয়ে রাজনীতির বিকিকিনি করা যায় কি?
কি হোল, কেন হোল, কি হওয়া উচিত ছিল এসব নিয়ে হৈ হুল্লোড় না করে রাজনীতির মুক্ত চিন্তায় আমরা কি কোনদিন এসব নিয়ে ভেবেছি! কেয়ার টেকারের তিনমাসের বয়স চব্বিশ মাস কেন হোল, ক্যান্টনমেন্টের উর্দিওয়ালারা কোন্ অছিলায় দেশ শাসনের ফ্রন্ট লাইনে এসে গেল,রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় তার বিশ্লেষন করে আমরা কি এর পোষ্ট মর্টেম করেছি! সে সময়ের নব্বই দিনের কেয়ার টেকার যখন সামরিক মদদপুষ্ট হয়ে সাত'শ বিশ দিনের পরমায়ু পেল তখন বাংলার সাধারন মানুষ তাদের ব্যুরাক্র্যাটিক ও মিলিটারী মিশেলের লম্বা হাতগুলো দ্বারা প্রতিপদে পিষ্ট হয়েছে বলে মনে হয়েছে। ফলে মানুষের মনে অনির্বাচিত কেয়ার টেকারের স্বচ্ছ্বতা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। আর সেই চিন্তাকে সামনে রেখে ২০০৯ - ২০১৪এর হাসিনা সরকার তার সংসদীয় নিরঙ্কুশতার ক্ষমতাবলে সংবিধানের নতুন সংযোজন 'কেয়ার টেকার' ব্যবস্থাটি উপড়ে ফেলে নির্বাচনের ছড়িটি নিজের হাতে তুলে নিলেন। এ কর্মটি হাতে নেয়ার আগে একবাও কি তাদের জনগনের কথা মনে আসে নি? পরবর্তী সময়ে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোল, মিছিল হোল, মিটিং হোল, ভাংচুর হোল, মার-মার কাট-কাট ধাঁচের হরতালও হোল। কিন্তু জমিন ছাড়তে কেউ রাজি হোল না। ক্ষমতার এক গুয়েমী জনপদে হতাশার জন্ম দিল। সাধারন মানুষ আস্তেধীরে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমগ্ন হোল। রাজনীতির তঞ্চকতা এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাব সাধারন মানুষের কাছে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হোল। ফলে রাজনীতির দুটি পক্ষ নিজেদের ক্ষমতার কামড়া কামড়িতেই মত্ত হয়ে উঠলো। আর রাজনীতির ভাষা এবং এর প্রয়োগ এত নিম্নস্তরে পৌঁছালো যে এটা নিয়ে সাধারন মানুষের ন্যুনতম আগ্রহ রইলো না।
এলো দু'হাজার চৌদ্দ এর নির্বাচন। কেয়ার টেকার বাতিল হয়ে এখন তা হবে সিটিং সরকারের অধীনে। এই এক দশকের স্মৃতিকে আর ধুসর বলি কেমন করে। সবই তো তাজা টসটসে। নির্বাচন হবে, নির্বাচন হতে দেয়া হবে না - এই যুদ্ধংদেহী অবস্থায় দেশে হরতাল মিটিং মিছিল অবরোধ সমানতালে চলতে থাকলো। দেশের মানুষ নিরাপত্তা হীনতায় পড়ে গেল। রাজনীতির নতুন সংস্করন জ্বালাও পোড়াও এবং পেট্রোল বোমার ব্যবহারে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সূত্রপাত হোল। আইন শৃংখলা বাহিনীর সহযোগী হিসাবে নয়া জামানার হেলমেট বাহিনীর আবির্ভাব ঘটলো। চৌদ্দর নির্বাচনের আগে দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলো। জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হোল। রাজনীতির এই সহিংসতায় কারা ক্ষতিগ্রস্ত হোল আর কারা লাভবান হোল তার খতিয়ানে না গিয়ে বলা যায় দেশ তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বেড়ি পরে মধ্যযুগীয় পরম্পরার রূঢ়তায় স্নাত হোল। ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা এতই মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে এল যে ভোট না করেও 'বিনা প্রতিদ্বন্দিতা' নামক রাজা রাজড়ার আদলে একটি পক্ষ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় আসন পেয়ে সরকার গঠনের বৈধতায় অভিষিক্ত হোল। ২০১৪ এর নির্বাচনী সহিংসতা ও ভোট না করেও বিনা প্রতিদ্বন্দিতার এমপি হওয়ার মহড়ায় বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হোল।
(চলমান)