জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধুসর স্মৃতি-৫
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০১:৪৫ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
নব্বইয়ের গনভ্যুত্থানের পর দেশে গনতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা সূচিত হয়। যে গনতান্ত্রিক পথ চলার বিষয়টি আবছা আলোছায়ায় লুকোচুরি করে চলেছে এতদিন, তা এবার প্রকাশ্য হয়ে সামনে এল। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এখন দুই নারী নেত্রীর করতলে। দুজনেই গৃহবধুর আঙ্গিনা থেকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। প্রয়োজনের তাগিদে দুজনকে বড় দুই প্ল্যাটফরমের দায়িত্বে আসতে হয়েছে। দুজনেরই রাজনীতির উঠানে আগমন হয়েছে বড় দুই দলের ভাঙ্গন ও বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর নির্মম প্রস্থানের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল শুরু হয় এবং ব্যক্তি নামে আওয়ামী লীগ কয়েক টুকরো হয়ে যায়। এমতাবস্থায় দলের অস্তিত্ব অটুট রাখার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধুর বিদেশে থাকা জীবিত দুই কন্যা হাসিনা শেখ ও রেহানা শেখের উপর ভরসা করে দলের নীতি নির্ধারক ও তৃণমূলের নেতা কর্মীদের উদ্যোগ নিতে হয়। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৮১ সনের প্রথম দিকে। পাশাপাশি ঘাতকের বুলেটে অকাল প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়ার পত্নী গৃহবধু বেগম খালেদা জিয়া বিশৃংখল ও ভাঙ্গনের মুখে পতিত বিএনপির দায়িত্ব নিয়ে দলকে উজ্জীবিত করে তাতে প্রানের সঞ্চার করেন। দুই বড় দল আওয়ামী লীগের আট দলীয় জোট এবং বিএনপি নেতৃত্বের সাত দলীয় জোটের যুগপত আন্দোলনের ফসল হিসাবে নব্বইয়ের গন অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ফলে শ্বৈরাচারী এরশাদশাহীর পতন ঘটে।
১৯৯১ হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাঙালী মুক্ত নিঃশ্বাসে তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বচ্ছতায় স্বস্তি পেয়েছে। তবে যে বিষয়টি নিয়ে বাংলার মানুষ বার বার হোঁচট খেয়েছে তা হোল রাজনীতি ও তার প্রায়োগিক চর্চা। উত্তরাধিকার পরম্পরার রাজনীতি দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সৃষ্টি করেছে পরিবার কেন্দ্রিকতার এক ভয়ংকর একনায়ক শাসন। তার চারপাশে গঠিত হয়েছে দলদাস চাটুকারের বলয় যা প্রকারন্তরে একনায়ক তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার রড সিমেন্ট বালু কংকর ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক ক্ষোভ ও আক্ষেপ নিয়েই এই জড় পদার্থগুলোর সঙ্গে রাজনীতির দলদাসদের তুলনা করা হোল এই কারনে যে পঁচাত্তরের সেই নারকীয় দিনগুলিতে অতিভক্তির সেইসব বীর পুরুষদের পিতৃ হত্যার প্রতিবাদে টু-শব্দটিও করতে দেখা যায়নি। তারা তো বড় বড় তকমা লাগানো যোদ্ধা ছিল। মুক্তিবাহিনীকে টেক্কা দিয়ে তারা তো নেতাকে খুশী করার জন্য মুজিব বাহিনীর কর্তা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের দাদাগিরি তো আমরা দেখেছি। কি সব নির্লজ্জ রাজনীতি। সে সময় রাজনীতির শাখা প্রশাখা এত বাড় বাড়ন্ত যে তাদের অবাধ বিচরনে তখন রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রশাসন শিক্ষা ও সমাজ কাঠামোর প্রতিটি অলিগলিতে তা অবাধ হয়ে যায়। গণতন্ত্রের অতি সুবিধা লাভের সুযোগ এবং গনতান্ত্রিক চর্চার অতি ব্যবহারে দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোই যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে সে সময়। গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তনের ফলে মানুষ ভেবেছিল এবং আশা করেছিল, এবার হয়তোবা স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্নপ্রকাশের পর যেসব অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে গুমোট বা জট বেঁধেছে তার সুরাহা গনতান্ত্রিক আচরনের মাধ্যমে সুরাহ হবে। কিন্তু তা হয়নি। দেশে দুটি পক্ষ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলতে দ্বিধা নেই, আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে এমনভাবে জনগনের মাঝে হাজির হোল যে প্রথম ধাক্কাতেই তারা জানিয়ে দিল ওই মহান নেতা শুধুমাত্র তাদেরই সম্পদ। অর্থাৎ সরল অংককে ভগ্নাংশে ফেলে দেশ সৃষ্টির চেতনার মূলে পেরেক ঠুঁকে দেয়া হোল। বঙ্গবন্ধু তো বটেই এমনকি জাতির পিতাকে তারা নৌকা প্রতীকে খোলসবন্দী করে দিলেন।
তুলনামূলক আলোচনায় জাতির পিতাকে দেশের সাধারন রাজনীতির আলোচনায় রেখে একটি দলের ঘর গোছানোর অবিবেচক অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সমগ্রতায় কুঠারাঘাত করা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। সে আক্ষেপ নিয়েই তো গোটা বাঙালী সমাজের দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। ওদিকে সদ্য জন্ম নেয়া জনমানুষের ভালবাসায় সিক্ত দল বিএনপি ততদিনে বাংলার জমিনে তার শেকড় ঠিকমতই শক্ত করেছে বলে মনে হয়েছে। নইলে ঘোষনা পাঠের মেজর সাহেব জনতার রাজনীতিবিদ হয়ে কি এমন জাদুর কাঠি বাঙালীর হৃদয়ে বপন করে দিয়েছেন যে গনতান্ত্রিক ধারার প্রথম পরীক্ষায় তাঁর সৃষ্ট বিএনপি দেশ শাসনের ম্যান্ডেট পেয়ে গেল! তবে ম্যান্ডেট পেলে কি হবে! রাজনীতির কঠোর অনুশীলন করেই একজনকে রাজনৈতিক কর্মী হতে হয়। পথ পরিক্রমায় তাকে রাজনীতির হাল ধরতে হয়। সেক্ষেত্রে শত সহস্র বর্ষীয় পরাধীনতার শিকল পরা বাঙালী কোন্ দুঃখে ভাল শাসক হয়ে জনমানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসবেন সেসব ভাবলেই শিহরিত হতে হয়। রক্তে শাসক বলয়ের স্তুতি ও পদসেবা করেই জন্ম জন্মান্তর কাটিয়ে দিতে হয়েছে যাদের তারা আবার কেমন করে ভাল শাসকের কাতারে নিজেকে উপস্থাপন করবে সেটাও শত সহস্র প্রশ্নের একটি।
যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগন নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে গনতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এ ও বি নামক দুটি স্রোতের প্লাটফরম পেলেন, তাদের রাজনৈতিক চরিত্রের পার্থক্য খুব একটা ছিল বা আছে বলে মনে হবার কোন কারন নেই। সেক্ষেত্রে বাংলার রাজনীতির মাদার ভেসেল বলে অহংকার করে যারা দেশ শাসন করতে চায় তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও ঘৃণা ছড়ানোর পথচলায় ইদানীং বাংলার মানুষ ত্যক্ত বিরক্ত বলেই মনে হয়। কেননা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা এবং অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যব্যহারে রাজনীতির মাঠকে কলুষিত করে তারা সাধারন মানুষের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। তবুও বঙ্গবন্ধু একটি ফ্যাক্টর। তিনি একাধারে দেশের স্থপতি এবং ঘোষিত জাতির পিতা। সেক্ষেত্রে তাঁর কারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ও অবদানকে পুঁজি করে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীরা যেভাবে দেশ শাসনের লাটাই হাতে নিয়েছেন সেটা কোন ছাঁচে ফেলা যায় সেটাই শত সহস্র প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
কথাটি উচ্চারণ করা কি নেহাতই কাকতালীয় হবে - যদি প্রশ্ন করা হয় ভারত আন্দোলনের প্রধান নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী কি কংগ্রেসের নেতা ছিলেন? কংগ্রেস দলটির কোন্ পদে ছিলেন তিনি! অথচ তিনিই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা। ঠিক আমাদেরও তাই। আমাদের বাঙলী ও বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ছিলেন ব্যক্তি শেখ মুজিব। তিনি আপামর বাঙালীর প্রিয় বঙ্গবন্ধু। তাঁর নেতৃত্বে বাঙালী আজ বাংলাদেশী হয়ে দুনিয়ার বুকে পরিচিত। বাকী কথাটুকু বলতে গেলে তো আবারো রাজনীতি ও দেশ শাসনের পঙ্কিল কথাগুলো চলে আসে। সেক্ষেত্রে বিএনপির জন্য এই কথাটি অতো জোরেশোরে প্রযোজ্য হবেনা, কারন তাদের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান একজন রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা এবং সেকটর কমান্ডার। সর্বোপরি তিনি ছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের বেতনভুক কর্মচারী। সময়ের চাহিদায়, ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি দেশের শাসন ক্ষমতার শিখরে এসেছেন এবং সামরিক পোষাক ছেড়ে তিনি রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনকার সময়ে রাজনীতির হয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে বাঙলার রাজনীতির মাঠ গরম করে রেখেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে পার্থক্যটা বুঝে নিয়েই এগোতে হবে।
(চলমান)